মানব জাতি এবং তার করণীয় প্রসঙ্গে মাওবাদ

মানব জাতি (ইংরেজি: Humankind) এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে কার্ল মার্কস থেকে মাও সেতুং সকল মহান চিন্তাবিদ মতামত প্রদান করেছেন এবং অনুশীলন ও পরীক্ষণ চালিয়েছেন। মাওবাদী চিন্তাধারা মানুষকে সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে দেখেছে।

বিশেষভাবে পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির সরকারসমূহের পতনের পর থেকে, পশ্চিমা সরকারগুলি কল্পনা করেছে যে মাওবাদ একটি ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক ঘটনা ছিল অনেক আগে; এটির সাথে গুরুত্ব সহকারে জড়িত হওয়ার দরকার ছিল না; কারণ ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতের কথিত মৃত্যুতে এটি ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। আজকের শীতল যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও একটি ভিন্ন গল্প পাওয়া যাবে। সমসাময়িক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল শক্তি হচ্ছে মাওবাদ।

মাওবাদ হচ্ছে পরস্পর বিরোধী ধারণার সমষ্টি যা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে মার্কসবাদের সোভিয়েত পোশাক থেকে নিজেকে আলাদা করেছে। একটি অ-পশ্চিমা, ঔপনিবেশিক বিরোধী এজেন্ডাকে মঞ্চের কেন্দ্র প্রদান করে, মাও সেতুং উন্নয়নশীল দেশগুলির বিপ্লবপন্থীদের [Radical] কাছে ঘোষণা করেছিলেন যে রাশিয়ান-শৈলীর কমিউনিজম স্থানীয়, জাতীয় অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া উচিত। স্ট্যালিনের থেকে সরে এসে তিনি বিপ্লবীদেরকে তাদের সংগ্রাম শহর থেকে বের করে এনে এবং গ্রামাঞ্চলের গভীরে গেরিলা যুদ্ধ করতে বলেছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবকতার মতবাদ প্রচার করেছিলেন: বিশ্বাসের নিছক সাহসিকতার দ্বারা – চীনারা এবং অন্য যে কোন জাতির লোকেরা ইচ্ছাশক্তির সাথে – তাদের দেশকে পরিবর্তন করতে পারে। অস্ত্র নয়, বিপ্লবী উদ্যমই ছিল নির্ধারক ফ্যাক্টর ছিল।

বিপ্লবী উদ্যম সৃষ্টির জন্য তিনি পার্টির মানুষদের উপরেই নির্ভর করেছিলেন, মানব প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসবাদী জ্ঞানের সার সংকলন করেছিলেন। তিনি বলেছেন,

 “যেদিন থেকে মানব জাতি শ্রেণীবিভক্ত হয়েছে সেদিন থেকে সর্বাত্মক ভালোবাসা বলে কিছুই নেই। অতীতের সকল শাসক শ্রেণীই এই ধরণের ভালোবাসার বাণী প্রচার করেছে আর অনেক তথাকথিত ঋষি ও জ্ঞানী ব্যাক্তিরাও একই কথা বলে গেছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের কেউই বাস্তব জীবনে তার অনুশীলন করেন নি, কারণ শ্রেণী বিভক্ত সমাজে সেটা অসম্ভব। মানবজাতির প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা তখনই সম্ভব হবে যখন সমগ্র বিশ্বজুড়ে শ্রেণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে।”[১]  

ভি আই লেনিন এবং জোসেফ স্তালিনের মতো মাও সেতুং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে একটি সামরিকায়িত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, তিনিও বিশেষ করে তার শেষ দশকে একটি মূলনীতিকে সমর্থন করেছিলেন, চীনা জনগণকে বলেছিলেন যে “বিদ্রোহ করা ন্যায়সংগত”। মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের (১৯৬৬-৭৬) সময়, তিনি লক্ষ লক্ষ চীনা জনগণকে প্ররোচিত করেছিলেন দলে দলে প্রতিবিপ্লবী বলে মনে করা প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করার জন্য।

মানব জাতি সম্পর্কে তিনি মার্কসবাদী এই নীতি মানতেন যে, মানুষ হচ্ছে এমন এক প্রাণী যে প্রকৃতির নিয়মগুলোকে আবিষ্কার করতে পারে এবং সেগুলোকে কাজে লাগাতে পারে। তিনি মানুষকে এমন একটি শৃঙ্খলা অনুসারী শক্তি তৈরি করতে চেয়েছিলেন যারা বিদ্রোহ করবে।মানুষ সম্পর্কে মাও সেতুং-এর ধারণা ছিলো চমৎকার। যেমন তিনি বলেছেন,

“দুনিয়ার সব জিনিসের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে মূল্যবান। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যতদিন জনগণ থাকবেন ততদিন যে কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটিয়ে দেয়া যাবে।… বিপ্লব সব কিছু পালটে দিতে পারে।”[২]

চীনে আদর্শবাদী তরুণ ছাত্র এবং পার্টির ক্যাডারগণ; উন্নয়নশীল বিশ্বের বিপ্লবের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং ক্ষমতাচ্যুত বিদ্রোহীগণ; প্যারিস, বার্কলে, পিসা, দিল্লিতে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী বিদ্রোহীরা – সকলেই মাওবাদের সীমানা অতিক্রমকারী প্রভাবে উদ্দীপনা অনুভব করেছে।  আমাদেরকে মাওবাদের তার ধারণাগুলিকে নিয়ে আলোচনা করতে হবে এবং মাওবাদকে বিংশ ও একবিংশ শতকের অন্যতম প্রধান চিন্তাধারা হিসাবে পুনরুদ্ধার করতে হবে।

তথ্যসূত্র

১. মাও সেতুং, সাহিত্য ও শিল্পকলা সম্পর্কে ইয়েনানের আলোচনা সভায় প্রদত্ত ভাষণ, উপসংহার।
২. মাও সেতুং; ‘ইতিহাসের ভাববাদি ধারণার দেউলিয়াপনা’ থেকে; ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!