টমাস হবস মানব প্রকৃতি সম্পর্কে (ইংরেজি: Thomas Hobbes on Human Nature) অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ধারণা পোষণ করতেন যে,মানুষ হচ্ছে স্বার্থপর, লোভী, আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতালিপ্সু। নিম্নে মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা আলোচনা করা হলো:
১. মানুষ মূলত জড় পদার্থ: টমাস হবস মানবপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, মানুষ অন্যান্য জড়বস্তুর ন্যায় একটি পদার্থ। মানবদেহকে তিনি বস্তু এবং মানব মনকে ক্ষয়িষ্ণু পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। দেহও অন্যান্য জড়বস্তুর ন্যায় কার্যকর নীতির অধীন। জড়বস্তু হিসেবে মানুষকে অনুমান করা যায়। মানুষ ও জড়বস্তুর মধ্যে যেটুকু পার্থক্য আছে তা হচ্ছে মানুষের মধ্যে জড়বস্তুর ন্যায় অণু-পরমাণু ছাড়াও যুক্তি নামক আরেকটি বিশেষ অতিরিক্ত উপাদান কাজ করে। যুক্তির সাহায্যে সে চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে চায়, ফলে তার আচরণে কিছুটা অনিশ্চয়তার আশংকা থাকে। অন্যথায় জড় পদার্থের মত আচরণ সম্পর্কে সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেত।
২. কর্মব্যস্ততা: মানবজীবন সর্বদা কর্মব্যস্ত কর্মচাঞ্চল্যের শেষ নেই। মৃত্যু পর্যন্ত চলে কর্মব্যস্ততা।
৩. আকাঙ্ক্ষার মূল লক্ষ্য ক্ষমতা: মানবপ্রকৃতির আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, যদিও সে আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয়, কিন্তু সে তার আকাঙ্ক্ষাকে শুধু বর্তমানের সুখান্বেষণে সীমাবদ্ধ রাখে না। তার আকাঙ্ক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে এমন এক ক্ষমতা যার সাহায্যে সে তার ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার পথ সুগম করতে পারে।
৪. আকাঙ্ক্ষা ও বিতৃষ্ণা: টমাস হবসের মতে, যে জিনিস মানুষের অনুভূতিতে অনুকূল সাড়া জাগায় সে জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ জন্মে এবং তা লাভ করার জন্য সে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। অপরদিকে, যে বস্তু মানুষের অনুভূতিতে প্রতিকূল সাড়া জাগায় তার প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মে। আকাঙ্ক্ষিত বস্তু পেলে মানুষ আনন্দিত হয়, না পেলে। দুঃখবোধ করে। মানুষ যে জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে টমাস হবসের মতে, সেটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যে জিনিসের প্রতি মানুষ বিতৃষ্ণা বোধ করে তা তার জন্য অকল্যাণকর।
৫. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী: মানব প্রকৃতি সম্পর্কে টমাস হবসের এ ধারণাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী বলা চলে। তার মতে, মানুষ সম্পূর্ণভাবে স্বাতন্ত্রবাদী। অপরের সর্বস্ব হরণ করে স্বীয় স্বার্থরক্ষা ও স্বীয় উন্নতি সাধনই তার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি। টমাস হবসের মানবপ্রকৃতির ধারণা ম্যাকিয়াভেলির ধারণার অনুরূপ।
৬. মানুষ উপযোগবাদী: টমাস হবসের মতে, মানুষ সবসময়ই আনন্দ লাভ করতে চায় এবং দুঃখকে এড়াতে চায়। যে জিনিস মানুষের অনুভূতিতে অনুকুল সাড়া জাগায় সে জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ জন্মে এবং তা লাভ করার জন্য সে আকাঙ্ক্ষা করে। আকাঙ্ক্ষিত বস্তু পেলে আনন্দিত হয়, না পেলে দুঃখবোধ করে।
৭. কার্যকারণ নিয়মনীতির অধীন: টমাস হবসের মতে, মানুষ মূলত অন্যান্য জড়বস্তুর ন্যায় কার্যকারণ সম্পর্ক নীতির নিয়মাধীন। তার মতে, মানুষের স্বাধীনতা বা উদ্দেশ্য বলে কিছুই নেই। মানুষ একটি অন্তর্নিহিত শক্তি দ্বারা চালিত হয়। এ অন্তর্নিহিত শক্তির প্রভাবেই মানুষ নিজেকে রক্ষা করার বা আঘাত এড়িয়ে বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে।
৮. অসীম আকাঙ্ক্ষা: টমাস হবসের মতে, মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলে অপর একটি আকাঙ্ক্ষার উদয় হয়। কোন বস্তু একবার ভোগ করার পর তা ভবিষ্যতেও ভোগ করার স্পৃহা জাগ্রত হয়।
৯. স্বার্থপরতা: টমাস হবসের মতে, মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর। তার যাবতীয় কর্মপ্রয়াস, ধ্যানধারণা, আবেগ অনুভূতি স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কাজেই স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই মানুষ কষ্ট পায়।
১০. সব মানুষই প্রায় সমান: টমাস হবস মনে করেন যে, মানুষে মানুষে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আপাতদৃষ্টিতে পার্থক্য লক্ষ্য করা গেলেও মানুষ একে অপরের প্রায় সমান। যে ব্যক্তি দৈহিক দিক থেকে শক্তিশালী সে হয়ত মনের বুদ্ধি ও জ্ঞানের দিক থেকে দুর্বল। আবার যে ব্যক্তি মনের দিক থেকে সবল সে হয়ত দৈহিক বা বুদ্ধির দিক থেকে দুর্বল।
সুতরাং মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত মূলকথা হচ্ছে- মানুষ স্বার্থপর, লোভী, আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতালিপ্সু। টমাস হবসের মতে, রাষ্ট্রের জন্মের আগে মানুষের এ স্বার্থপরতা বা অহংকারবোধের মধ্যে অন্যায় অকল্যাণকর বলে কিছু ছিল না। যখন থেকে রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন থেকেই এগুলোর নৈতিক, বৈধতা বা অবৈধতার প্রশ্ন দেখা দেয়।
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে হবস কতটুকু বাস্তববাদী ছিলেন
মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে হবস যে মতবাদ দিয়েছেন তার প্রেক্ষিতে তাকে কতটুকু বাস্তববাদী (ইংরেজি: How Much Realistic about Human Nature) বলা যায় তা আলোচনা করা হলো। আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমেই জানা প্রয়োজন, হবসের বক্তব্য বাস্তবতার সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল আর কতটুকু ছিল না। অর্থাৎ বাস্তব ক্ষেত্রে হবস এর ধারণা কি পরিমাণ ইতিবাচক এবং কি পরিমাণ নেতিবাচক ছিল তা জানা। নিয়ে মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে হসব এর মতবাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আলােচনা করা হলাে:
ইতিবাচক দিক: হবসের ‘মানবপ্রকৃতি সম্পৰ্কীয় মতবাদ বিশ্লেষণকরণে বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেসব ইতিবাচক দিকসমূহ লক্ষ্য করা যায় সেগুলাে হলাে :
১. মানুষের মধ্যে যুক্তি নামক একটা অতিরিক্ত উপাদান রয়েছে যা তাকে চিন্তাভাবনা করতে সাহায্য করে এবং এর সাহায্যে মানুষ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
২. মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতির অস্তিত্ব আছে বলে সে কোন জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বােধ করে।
৩. মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোন শেষ নেই। একটি আকাঙক্ষা পূরণ হলে অন্য একটি আকাঙক্ষার উদয় হয়।
৪.সকল মানুষই সুখ পেতে চায় এবং দুঃখকে এড়িয়ে চলতে চায়।
৫. মানুষের ভিতর স্বার্থপরতার অস্তিত্ব আছে বিধায় সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
নেতিবাচক দিক: ‘মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে টমাস হবস যে মতবাদ দিয়েছেন তার সেসব দিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় সেসব নেতিবাচক দিকসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. টমাস হবস মানুষকে জড় পদার্থের সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর এ ধারণা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করে। কিন্তু বাস্তবে মানুষই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব।
২. হবস কল্যাণকর ও অকল্যাণকর বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণের যে ধারণা দিয়েছেন তা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ মানুষ কোনো এক দিকে নয় উভয় দিকই গ্রহণ করতে পারে।
৩. সকল মানুষেরই ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে, যা হবস অস্বীকার করেছেন।
৪. হবস স্বার্থপরতা সম্পর্কে যে মতবাদ দিয়েছেন তা ঠিক নয়। কারণ পৃথিবীর সকল মানুষই স্বার্থপর নয়।
৫. হবস প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে সে রাজ্যের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
উপরোক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, টমাস হবস মানব প্রকৃতি সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছেন বাস্তববাদী বলা যায় না। কেননা তার মতবাদের মধ্যে সেসব নেতিবাচক উপাদান রয়েছে সেগুলোই তাকে অবাস্তববাদী বলার জন্য যথেষ্ট। তবে তার মতবাদে যেসব ইতিবাচক উপাদান লক্ষ্য করা যায় সেগুলোকে একেবারে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, বরং তার এসব ধারণা পরবর্তী সময়ের দার্শনিকগণের মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। সুতরাং টমাস হবসের মানব প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা সম্পূর্ণরূপে বাস্তববাদী না হলেও পুরোপুরিভাবে অগ্রহণযোগ্য নয় তা বলা যায়।
তথ্যসূত্র
১. ড. রবিউল ইসলাম, মীর মোশাররফ হোসেন ও অন্যান্য, রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, গ্রন্থ কুটির ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ৩৮৭-৩৮৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।