রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনৈতিক চিন্তায় হেগেলের (Hegel’s contribution on Political Thought) অবদান হচ্ছে জার্মান ভাববাদের ভিত্তিকে প্রসারিত করা। ইমানুয়েল কান্টের ভাববাদী চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে ভাববাদী চিন্তার রাজ্যে যারা নব নব দিগন্তের সূচনা করেন তাদের মধ্যে ফ্রিডরিখ হেগেলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঊনিশ শতকে তিনি এ নতুন ভাববাদী চিন্তার জন্ম দেন।
এছাড়াও প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর রচনাবলীর প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় আগ্রহ। তাঁর পরিণত বয়েসের দিনগুলো কেটেছে হাইডেলবার্গ ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা পেশায়। যৌবনে হেগেল ফরাসী বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন এবং জার্মান রাজতন্ত্র ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেন। ফরাসী বিপ্লবের ব্যর্থতা ও নেপোলিয়নের রাজনৈতিক উত্থানের ফলে হেগেলের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা দেয় দ্বৈততা। ইউরোপের বিপ্লবী পরিস্থিতি ও জার্মান বুর্জোয়াদের রক্ষণশীলতা এ দুয়ের প্রভাবে দোদুল্যমানতা দেখা যায় হেগেলের চিন্তাধারায়।[১]
হেগেলের রাষ্ট্রচিন্তা
জার্মান ভাববাদী রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম প্রবক্তা হলেন কান্ট। হেগেল তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার মূলসূত্রগুলো গ্রহণ করেছিলেন কান্ট এর চিন্তাধারা থেকেই। F. Thilly তাঁর ‘‘A History of Philosophy’ (পৃষ্ঠা-৯১) গ্রন্থে বলেছেন, “রাষ্ট্র হবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ন্যায় সমন্বিত এবং ব্যক্তির পুণ্য আত্মার ন্যায়।”[২] হেগেল মূলত দার্শনিক চিন্তাধারার অনুসঙ্গী হিসেবে রাষ্ট্রচিন্তার তত্ত্ব প্রদান করেছেন। নিম্নে রাষ্ট্রচিন্তায় হেগেলের অবদান আলোচনা করা হলো :
১. শক্তিমান সংস্থা:
হেগেলের মতে, “রাষ্ট্র এমন একটি সংস্থা, যা সর্বশক্তিমান। এখানে উদারনীতির কোনো স্থান নেই।” তাঁর মতে, রাষ্ট্র মহাপরাক্রমশালী। তিনি মনে করেন রাষ্ট্রে ব্যক্তির ভূমিকা হলো সবসময় রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা। ব্যক্তি কখনই নিজেকে রাষ্ট্রের বাইরের কোনো সত্তা হিসেবে ভাবতে পারবে না। ব্যক্তি কখনই রাষ্ট্রের বাইরে মর্যাদাবান হতে পারে না।
২. ব্যক্তির বিকাশ:
হেগেলের মতে, ব্যক্তির পূর্ণ বিকাশ সম্ভব কেবলমাত্র রাষ্ট্র পরিচালিত নীতির পরিপূর্ণ অনুশীলন ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। তিনি মনে করতেন যে, ব্যক্তির স্বতন্ত্র ইচ্ছাকে অবশ্যই সর্বজনীন চেতনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে হবে। রাষ্ট্রের অনুমোদিত কোনো নীতির বিরোধিতা বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণকে তিনি অনুমোদন করেন নি। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিপ্লব করার কোনো অধিকার মানুষের নেই।
৩. রাষ্ট্রের উৎপত্তি:
রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিষয়টিকে হেগেল কৃত্রিমভাবে ব্যাখ্যা করেন নি। তিনি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সাহায্যে এটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর চিন্তায় জাতীয় রাষ্ট্রের সম্পর্কিত বিষয়টি বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন সংস্থাকে কোনো মর্যাদা দেন নি। এসব সংস্থাকে তিনি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। ব্যক্তির মর্যাদা স্বীকার না করার চরম পরিণতি আমরা লক্ষ্য করি তাঁরই চিন্তায়।
৪. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অভাব:
হেগেল তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারা সৃষ্টির কোনো ধারণা দেন নি। রাষ্ট্রের জনগণ কিভাবে তাদের সর্বজনীন অধিকার সংরক্ষণ করবে তার উপায় নির্দেশ করেন নি। সরকার যাতে স্বৈরাচারী না হয়, আর সরকার স্বৈরাচারী হলে জনগণ কী ভূমিকা গ্রহণ করবে তা তিনি বলেন নি। অর্থাৎ তিনি গণতান্ত্রিক ভাবধারাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেন নি।
৫. সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি:
হেগেলের চিন্তায় জার্মান ভাববাদের বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিসত্তার চেয়ে সমাজকে বড় করে দেখার যে ধারা রুশো গড়ে তুলেছিলেন তিনি তা পূর্ণরূপে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর চিন্তাচেতনা ছিল রক্ষণশীল। বিজ্ঞান ও নৈতিকতাকে আলাদা করে কান্ট তাদের স্বতন্ত্র ক্ষেত্রের নির্দেশ করেছিলেন। এসব দৃষ্টিভঙ্গিকে একত্রিত করে তিনি তাঁর সমন্বয়ী রাষ্ট্রচিন্তা প্রকাশ করেন।
৬. রাষ্ট্রের কাজ:
হেগেলের মতে, “রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হচ্ছে নৈতিক লক্ষ্য অর্জন। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক যেন নৈতিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায় এবং নৈতিকতা বহির্ভূত কোনো কাজ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখাও রাষ্ট্রের কাজ।” রাষ্ট্রের কাজ হবে জনগণকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে তারা রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মাবলিকেই চরম ও পরম বলে মনে করে।
৭. রাষ্ট্রের মূলনীতি:
হেগেল রাষ্ট্রের তিনটি মূলনীতির কথা বলেছেন, স্বাধীনতা, সাম্য ও স্বনির্ভরতা। রাষ্ট্রের কেউ যাতে স্বাধীনতা বঞ্চিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রতিটি নাগরিক যেন স্বাধীন চেতনার অনুশীলন করতে পারে, রাষ্ট্র সেদিকে নজর দেবে। সফল রূপায়ণের জন্য সাম্য ও স্বনির্ভরতা প্রত্যেকের প্রাপ্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
৮. রাষ্ট্রের ক্ষমতা:
জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের হাতে বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা থাকা দরকার বলে হেগেল মনে করতেন। যে কোনো মুহূর্ত যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার মত ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকতে হবে। জনগণ কর্তৃক রাষ্ট্রের বিরোধিতা তিনি সমর্থন করেন নি। তিনি বলেছেন, যারা রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতা করবে রাষ্ট্র তাদের চরম শাস্তি প্রদান করবে।
৯. সম্পত্তির অধিকার:
হেগেলের মতে, “ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সম্পত্তির অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু সে সম্পত্তি অবশ্যই রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।” ব্যক্তি কতটুকু সম্পত্তির মালিক হতে পারবে এবং সে সম্পদকে সে কিভাবে ব্যবহার করতে পারবে সে ব্যাপারে কিছু রাষ্ট্রীয় নীতিমালা থাকবে। সম্পদের যথেচ্ছা ব্যবহারকে তিনি অনুমোদন করেন না।
১০. রাষ্ট্রের সমাজনির্ভরতা:
রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের বাইরে পৃথক কোনো সত্তা থাকবে না বললেও তিনি ব্যক্তিকে কখনই সমাজের বাইরের উপাদান বলে অভিহিত করেন নি। বাস্তব পরিস্থিতিকে তিনি কখনই অস্বীকার করেন নি। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের অবস্থান সমাজের অনেক উপরে হলেও রাষ্ট্রের অবস্থানে পৌঁছাতে হলে দরকার হয় সমাজের। আর মানুষ এক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।
১১. রাষ্ট্রের গঠনমূলকতা:
উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রকে অবিশ্বাসের চোখে দেখা হয়। হেগেল এসে এ ধারণার বিরোধিতা করে বলেন, রাষ্ট্র কোনো ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান নয়। মানবজীবনে এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সমাজের সার্বিক বিকাশ সাধন ও সমাজের সভ্যদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামাজিক ঐক্য সাধনেও রাষ্ট্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরো পড়ুন
- হেগেলবাদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে রাষ্ট্রদর্শন, ন্যায় ও প্রগতির বহুবিধ এলাকায়
- রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনৈতিক চিন্তায় হেগেলের অবদান আছে জার্মান ভাববাদে
- হেগেলের সুশীল সমাজ সংক্রান্ত ধারণা মার্কস ও অন্যান্যদের প্রভাবিত করে
- ফ্রিডরিখ হেগেলের সুশীল সমাজ ধারণাটির সীমাবদ্ধতাসহ ব্যাখ্যা
- হেগেলের রাষ্ট্রদর্শনে ব্যক্তির স্থান নির্ণয়ের জন্য তাঁর ভাববাদী রাষ্ট্রতত্ত্বের বিশ্লেষণ
- সংবিধান, সার্বভৌমত্ব ও সরকার সম্পর্কে হেগেলের মতের বিস্তারিত আলোচনা
- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিরোধী হিসেবে স্বাধীনতা সম্পর্কে হেগেলের ধারণা
- হেগেলের রাষ্ট্রচিন্তার মূল্যায়ন হয়েছে দর্শন, জার্মান ভাববাদসহ বেশ কিছু বিষয়ে
- হেগেলের আইনতত্ত্ব হচ্ছে আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে হেগেলের ধারণাগুলির মর্ম
- হেগেলীয় রাষ্ট্র হচ্ছে সর্বব্যাপী, সত্য, অভ্রান্ত, ঐশ্বরিক, জাতীয়, জৈব যুদ্ধংদেহী সত্তা
- হেগেলবাদী রাষ্ট্রতত্ত্ব হচ্ছে হেগেলের রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পর্কে ভাববাদী মত
- হেগেলের জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা হচ্ছে জার্মান রাষ্ট্রের চূড়ান্ত উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠ শক্তি
- হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বা দ্বন্দ্ববাদ হচ্ছে বস্তু ও সমাজ সম্পর্কিত অভীক্ষার পদ্ধতি
- হেগেলের সাথে সক্রেটিস, মার্কস ও এঙ্গেলসের দ্বন্দ্ববাদ বিষয়ক আলোচনা
- ফ্রিডরিখ হেগেল ছিলেন জার্মান ভাববাদী দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
সমালোচনা:
হেগেলের রাষ্ট্রচিন্তা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তিনি রাষ্ট্রের যে রূপ অঙ্কন করেছেন তাতে রাষ্ট্রকে একটি স্বৈরাচারী সংগঠন বলে মনে হয়। তিনি রাষ্ট্রে নাগরিকদের স্বাধীনতার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এখানে কোনো স্বাধীনতাই বজায় থাকে না। তার রাষ্ট্রে স্বাধীন মত প্রকাশের প্রকৃতই কোনো অধিকার নেই। রাষ্ট্রীয় নীতি মেনে চলা বাধ্যতামূলক বলে তিনি যে মত প্রকাশ করেছেন তা অত্যন্ত অমানবিক। কেননা রাষ্ট্র নির্ধারিত নীতি অনেক সময় ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থি হতে পারে।[৩]
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, নানাবিধ সমালোচনা থাকলেও হেগেলের রাষ্ট্রচিন্তার অবদান অস্বীকার করা যায় না। তিনি রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক নতুন ধ্যানধারণার প্রবর্তন করেন। রাষ্ট্রের উপযোগবাদী ব্যাখ্যার তিনি যে সমালোচনা করেছেন তা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত মনে হয়। তিনি রাষ্ট্রের যে রূপ অঙ্কন করেন তার মধ্যে ব্যক্তির পূর্ণ বিকাশের মূলসূত্র নিহিত বলেও তিনি মনে করতেন। তাঁর মতে, ব্যক্তির সামাজিকতা রক্ষা ও সামাজিক প্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় হলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ। তিনি রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় দেন। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অনেক চিন্তানায়কের রাষ্ট্রতত্ত্ব পর্যালোচনা করে সেগুলোর সমন্বিত রূপ হিসেবে স্বীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব প্রদান করেন বলে এই মতকে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
তথ্যসূত্র
১. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ১৪২।
২. F. Thilly, ‘‘A History of Philosophy’ p. 91; বাক্যটি এরকম: The state should be organized like the universe at large and the individual virtuous soul.
৩. মো. আবদুল ওদুদ (১৪ এপ্রিল ২০১৪। “জর্জ উইলহেলম ফ্রেডরিক হেগেল”। রাষ্ট্রদর্শন (২ সংস্করণ)। ঢাকা: মনন পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ৪০৩-৪০৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।