ফ্রিডরিখ হেগেলের সুশীল সমাজ ধারণাটির সীমাবদ্ধতাসহ ব্যাখ্যা

সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটি (ইংরেজি: Civil Society) ধারণাটি, হেগেলের বিবেচনায়, টিকে আছে রাষ্ট্রের পরিসরে। তাঁর মতে, মানবিক ও সামাজিক বিকাশের এই ধারায় রাষ্ট্র হচ্ছে পরম স্তর। কেবল ‘সিভিল সোসাইটি’ কখনোই সর্বজনীন স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না। এজন্য দরকার রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র ‘সিভিল সোসাইটি’র সর্বজনীন গুণাবলি টিকিয়ে রাখে। ‘সিভিল সোসাইটি’ হলো সর্বজনীনতার পরিসরে এমন ব্যক্তিবর্গের সংঘবদ্ধতা, যারা কেবল নিজ নিজ জীবন ধারণে সক্ষম।

কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ হেগেলের রাষ্ট্র আর ‘সিভিল সোসাইটি’র পারস্পরিক সম্পর্ককে অনেকটা উল্টো দিক থেকে দেখেছেন। মার্কসের কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র ‘সিভিল সোসাইটি’র ওপর নিভরশীল। কারণ প্রতিটি সমাজের শ্রেণিবিভাজনের প্রভাব রাষ্ট্রের গঠনে পরিষ্কারভাবে ফুটে থাকে। এ বিবেচনায় অর্থনৈতিক বিষয়াদির সঙ্গেও ‘সিভিল সোসাইটি’র সম্পর্ক সরাসরি। আরও এগিয়ে মার্কস রাষ্ট্রের বাইরের সবকিছুকেই ‘সিভিল সোসাইটি’র অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাই সর্বহারার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান ‘সিভিল সোসাইটি’র ধ্বংসও জরুরি বলে ঘোষণা করেন মার্কস। যে ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত ছিলেন মার্কসের চিন্তার দোসর এঙ্গেলস।

হেগেলের রাষ্ট্রচিন্তায় সুশীল সমাজের ধারণাটি উল্লেখযোগ্য। হেগেল রাষ্ট্রকে শুধু বিচ্ছিন্ন ও পৃথক পৃথক ব্যক্তির সমষ্টি হিসাবে দেখেন নি। তাঁর চোখে রাষ্ট্র ব্যক্তি মানুষের সমষ্টি, বিভিন্ন শ্রেণি, অর্থনৈতিক সংস্থা ও জনসমাজের সমবায়ও বটে। ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের নিরিখে বিচার করতেই হেগেল সুশীল সমাজ বা ‘Civil Society’র ধারণাটি নিয়ে এসেছেন। হেগেলের দর্শনে রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজের পার্থক্য এবং উভয়ের বিশেষত্ব এক কৌতূহলপ্রদ আলোচনা সন্দেহ নেই। হেগেলের এই বিশ্লেষণ থেকেই রাষ্ট্র ও সমাজের মূলগত পার্থক্য বিষয়ে পরবর্তীকালে রাষ্ট্রচিন্তাবিদেরা আলোকিত হয়েছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিতর্কে হেগেল অবশ্যই রাষ্ট্রের পক্ষ অবলম্বন করেছেন।

সুশীল সমাজ বলতে হেগেল বুঝেছেন ব্যক্তি স্বার্থের ভিত্তিতে গঠিত সামাজিক সংস্থাসমূহকে। এই সংস্থাগুলিতে মিলিত হবার পেছনে কাজ করে মানুষের কিছু বস্তুগত সুখ, সুবিধা ও খামখেয়ালি আচরণকে তৃপ্ত করার বাসনা। পারস্পরিক সুবিধা বা নির্ভরশীলতার নীতিতে এই সংস্থাগুলি গঠিত হলেও এগুলির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত কিছু সামগ্রিক সুবিধা লাভ করা যায় না তা নয়। হেগেল অবশ্য সুশীল সমাজের নেতিবাচক দিককেই প্রধানত উপস্থিত করেছেন। সুশীল সমাজ উপস্থিত হয়, কিন্তু অচিরেই অন্তর্হিত হয়, কারণ এই সমাজ আধিক্য, দুঃখ, সামাজিক দুর্নীতির আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। ব্যক্তি বা বিশেষ স্বার্থের অখণ্ড স্বার্থে সংযুক্তি না ঘটলে, স্বাধীন বাস্তব সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যুক্তির প্রকাশ না ঘটলে সত্যিকারের প্রগতি সম্ভব নয়। সুশীল সমাজ প্রয়োজনের রাজ্যে পৌঁছবার রাস্তা বটে, কিন্তু স্বাধীনতার রাজ্যে কখনই নয়।

হেগেল লক্ষ্য করেছেন সুশীল সমাজ একদিকে সম্পদের সৃষ্টি ও সমাবেশে সাহায্য করে অন্যদিকে সৃষ্টি করে নীচ দারিদ্র্য নিম্নশ্রেণির মানুষ; হেগেলের কথায় penurious rabble. যখন সুশীল সমাজ অপ্রতিহতভাবে কাজ করে তখন একই সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় জনসংখ্যা, শিল্প ও সম্পদের প্রাচুর্য, দারিদ্র্য ও নৈতিক অধঃপতন। এই সমাজে দেখা যায় স্বার্থের লড়াই, বিপুল চাহিদা, প্রতিযোগিতা, বিভেদ ও বৈরিতা। মুনাফা, কাজের বিভাগ, পরস্পর নির্ভরতা, দৈন্য, দারিদ্র্য সবকিছুই এখানে পাশাপাশি আসে। প্রকৃত স্বাধীনতা, যুক্তির প্রকাশ, বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটবার সুযোগ এখানে তেমন নেই। ক্রমশঃ এই সমাজে মানুষের ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতা কমে যায়, সাধুতা বা মহত্ব অপসারিত হয়। মানুষ হয়ে পড়ে সম্পূর্ণভাবে আত্মকেন্দ্রিক। এই অবস্থাই সৃষ্টি করে ‘ক্লিষ্ট, নিঃস্ব, নিচু শ্রেণির মানুষ’ । এই সমাজে সম্পদ কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয় যার স্বাভাবিক পরিনতি বিভেদ, দারিদ্র্য।

হেগেল সুশীল সমাজের তিনটি ব্যবস্থার কথা বলেছেন। এগুলি হলো চাহিদার ব্যবস্থা, ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা পুলিশ ও কর্পোরেশন। এই সমাজের তিন সম্প্রদায় হলো কৃষক, ব্যবসায়ী ও রাজন্যবর্গ বা আমলা। কৃষকেরা নিজের ইচ্ছা ব্যতিরেকে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। ব্যবসায়ী শ্রেণি তার জীবিকা নির্বাহের জন্য তার ব্যবস্থা বৃত্তির উপরই নির্ভরশীল। এদের কাজ উপকরণ যোগানো। নিজেদের ইচ্ছা বুদ্ধিবৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন মানুষের চাহিদা ও কাজের মধ্যে যোগযোগের ভূমিকা পালন করে এরা। রাজন্যবর্গ বা আমলার কাজ হলো সমাজের সার্বিক স্বার্থকে দেখা। এদের নিজেদের শ্রম করতে হয় না। বিচার, পুলিশ ও প্রশাসন লোকদের ব্যক্তিগত ও সম্পত্তির নিরাপত্তার প্রয়োজনে সৃষ্টি।

হেগেল মনে করেন সুশীল সমাজের মধ্যে সমৃদ্ধির সুযোগ থাকলেও, এই সমাজের অসঙ্গতি ক্রমশই একে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। স্বাভাবিক ঐক্য বা শান্তি বলে এখানে কিছু নেই। দারিদ্র্য, বৈষম্য, বিরোধিতাই এই সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা। সুশীল সমাজ নিজের আভ্যন্তরীণ সম্ভাবনা বা সামর্থ্য দিয়ে এই দারিদ্র্য বা বৈষম্য বোধ করতে পারে না। কেমনভাবে সুশীল সমাজে অসঙ্গতি ও ব্যর্থতার মধ্য থেকে সৃষ্টি হয় নতুন সম্ভাবনা, নতুন শক্তি সেকথা বলেছেন হেগেল। সুশীল সমাজের মধ্যে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকে বটে কিন্তু এ রাষ্ট্রব্যবস্থা অর্থাৎ বিচার, প্রশাসন, আইন প্রভৃতি এখানে যুক্তির নির্দেশে কাজ করে না। প্রকৃত রাষ্ট্র হবে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের মধ্যে সামাজিক প্রয়োজন বা ব্যবস্থাদি থাকবে কিন্তু সুশীল সমাজ ধারণাটি থাকবে না। নাগরিক বা সুশীল সমাজের গুণগুলি এই রাষ্ট্র গ্রহণ করবে এবং বজর্ন করবে এর দোষ ত্রুটিগুলি।

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র

১. মো. আবদুল ওদুদ (১৪ এপ্রিল ২০১৪। “জর্জ উইলহেলম ফ্রেডরিক হেগেল”। রাষ্ট্রদর্শন (২ সংস্করণ)। ঢাকা: মনন পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ৪০১-৪০২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!