হ্যারল্ড লাস্কি সাম্যের প্রশ্নে উদারনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সামাজিক সাম্যের পক্ষে

হ্যারল্ড জোসেফ লাস্কি (ইংরেজি: Harold Joseph Laski, ৩০ জুন, ১৮৯৩ – ২৪ মার্চ, ১৯৫০) ছিলেন একজন সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ গণতন্ত্রী ডানপন্থী। সাম্যের প্রশ্নে অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির ভাবনা হচ্ছে উদারবাদ ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সামাজিক স্বার্থ ও আর্থিক নিরাপত্তার সমন্বয়। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী গণহত্যাকারী ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা হিসেবে তিনি পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান চাননি। ফলে তার সাম্যচিন্তা ছিল একটি আজগুবি অবাস্তব চিন্তা।

আর্নেস্ট বার্কার সাম্য ও স্বাধীনতার প্রশ্নে স্বাধীনতাকে আগে রেখেছেন। তার যুক্তি সাম্য বিভাজন আনে, কিন্তু স্বাধীনতার লক্ষ্য মানুষকে একত্রিত করা। লাস্কি স্বাধীনতা ও সামোর মধ্যে এই ধরনের পার্থক্য করেন না। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতা ও সাম্য একই আদর্শের দুটি পিঠ। সাম্য স্বাধীনতার উদ্দেশ্যকে রূপায়িত করে। সমতা হলো স্বাধীনতার বাস্তবায়ন। 

অ্যালেক্স তকেভিল (A. Tocqueville) বা লর্ড অ্যাকটনের (Lord Acton) মতো লাস্কি সাম্য বলতে সকল মানুষের প্রতি একই আচরণ (Identity of Treatment) বোঝেন না। আবার সমতা বলতে একথাও মানেন না সবার শ্রমের সমান পুরস্কার থাকবে। সমতার প্রশ্নে তিনি মনে করেন, সকলের ব্যক্তিত্বের বিকাশে সমান সুযোগ। বার্কার সমতার প্রশ্নে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নি কিন্তু আইনি সংশোধন চেয়েছেন। লাস্কি কিন্তু সমতার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কৃতিত্ব তেমন উল্লেখযোগ্য এমনটা মনে করেন না। তিনি লক্ষ করেছেন, একজনের পরাধীনতার মূল্যেই এসেছে অন্যের স্বাধীনতা। অসাম্যের জগতে কতিপয়ের ইচ্ছাই মর্যাদা পেয়েছে এবং রাষ্ট্রের উপর তারাই আধিপত্য করেছে।

সাম্যের মানদণ্ড নির্ধারণে হ্যারল্ড লাস্কি

সাম্যের তিনটি মানদণ্ড উপস্থিত করেছেন লাস্কি: (১) কোনো বিশেষ সুবিধার উপস্থিতি থাকবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কার্যালয়ে চাকরি পাবার ক্ষেত্রে নাগরিকের মধ্যে কোনো পৃথকাচরণ করা যাবে না। (২) সকলের পর্যাপ্ত সুযোগের খোলাখুলি উপস্থিতি থাকবে। সমতার এই ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকই যাতে তার মন ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করার সুযোগ পায়, বিশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভার অপচয় না ঘটে, প্রত্যেক কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকে সেটা দেখতে হবে। (৩) সামাজিক লভ্যাংশের ভাগ সকল নাগরিককে কীভাবে দেওয়া যাবে সমতা হলো এই সমানুপাতিকতার সমস্যা। এটি মূলত অর্থনৈতিক সমস্যা, লাস্কির মতে এ হলো প্রাথমিক প্রয়োজনের পর্যাপ্ততার সমানুপাতিকতা। একদল অভুক্ত থাকবে আর আন্যদল পর্যাপ্তভাবে পাবে এই বিভেদের অপসারণ চাই। এর অর্থ সকলকে একই হারে বেতন বা আর্থিক সুবিধা দেওয়া নয়। দেখা দরকার এক্ষেত্রে ব্যাপক কোনো ব্যবধান যেন না থাকে। 

হ্যারল্ড লাস্কি চান মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে সম্পদের প্রয়োজন বা মূল্য নির্ধারিত হোক। লাস্কি চান শুধু সম্পদের সমতা নয়, আর্থিক ক্ষমতারও সমতা। এর জন্য প্রয়োজন শিল্পের জগৎ থেকে শৃঙ্খলমুক্ত দায়িত্বহীন ইচ্ছার অপসারণ অর্থাৎ সঠিক নীতির ভিত্তিতে গৃহীত হোক সিদ্ধান্ত। জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পগুলি যথা ব্যাংক, কয়লা, বিদ্যুৎ, পরিবহণ, খাদ্য ও বাসস্থানের যোগান ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক সমতার স্বার্থেই। লাস্কি চান না শিল্পক্ষেত্রে প্রভু-ভৃতের এক যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াক (Laski : Grammar of Politics)।

পুঁজিবাদ নয়, লাস্কির আস্থা সমাজতন্ত্রে। জনগণের সামাজিক স্বার্থ ও আর্থিক নিরাপত্তার স্বার্থে সমাজতন্ত্রকেই তিনি স্বাগত জানান তার ‘Liberty in Modern State’, ‘Democracy in Crisis’ প্রভৃতি গ্রন্থে। তবে সমাজতান্ত্রিক সমাজের কঠোর ও নিষ্পেষণের শাসন নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি চান সেই সমাজতন্ত্র, সুস্থ জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র হবে যার ভিত্তি। সাম্যের প্রশ্নে তার সুপারিশ আর্থিক ও রাজনৈতিক পীড়ন নয়, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটুক, রাষ্ট্র হয়ে উঠুক দায়িত্বশীল।

তথ্যসূত্র

১. দেবাশীষ চক্রবর্তী, রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়সমূহ, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ৫৪-৫৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!