জাঁ জ্যাক রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব হচ্ছে সামাজিক চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়

রাষ্ট্রদর্শনে সাধারণ ইচ্ছা বা গণ অভীপ্সা (ফরাসি: volonté générale) বলতে বোঝায় সমগ্র জনগণের ইচ্ছা। এই শব্দটি অষ্টাদশ শতকের ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাকস রুশোর দ্বারা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। “সাধারণ ইচ্ছা”,  রুশো যেমন ব্যবহার করেছিলেন, শব্দটি দেখা দেয় ফরাসি বিপ্লবের সময় রচিত মানবাধিকার ও নাগরিকের ঘোষণাপত্রের (ফরাসি: Déclaration des droits de l’Homme et du citoyen) ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে।[১]

রুশোর রাষ্ট্র-তত্ত্বমূলক বিখ্যাত গ্রন্থ সোস্যাল কন্ট্রাক্ট বা সামাজিক চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হচ্ছে ‘জেনারেল উইল’ বা ‘সাধারণ ইচ্ছা’। রুশো সাধারণ ইচ্ছা প্রত্যয়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন অষ্টাদশ শতকে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বাধীনতার লড়াইতে ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের উপর জোর প্রদান করেছেন, অপরদিকে তেমনি তিনি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যক্তির ইচ্ছা বা স্বাধীনতা যে মূল নয়, মূল যে মানুষের যৌথ চেষ্টায় সৃষ্ট সমাজসত্তা, তাকেও যুক্তিগতভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।[২]

রুশোর রাষ্ট্রদর্শনের অন্যতম প্রধান তিনটি অঙ্গ হলো সামাজিক চুক্তি, সার্বভৌমত্ব এবং সাধারণ ইচ্ছা। সাধারণ ইচ্ছা প্রত্যয়টির সূত্রে আরও দুটি প্রত্যয় এসে পড়ে: প্রকৃত (actual) অভীপ্সা ও বাস্তব (real) অভীপ্সা। ব্যক্তিমানুষের প্রকৃত অভীপ্সা তার সহজাত প্রকৃতি সঞ্জাত এবং অযৌক্তিক। এই অভীপ্সা সাময়িক ও বর্তমান কালেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেটা আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক এবং স্বভাবতই সমাজকল্যাণের সঙ্গে জড়িত নয়। এই অভীপ্সা সংকীর্ণ ও স্ববিরোধী।

পক্ষান্তরে ব্যক্তি মানুষের বাস্তব অভীপ্সা তার সমাজকল্যাণ-চিন্তার সঙ্গে জড়িত যুক্তিশীল অভীপ্সা। বাস্তব অভীপ্সা মানুষের নিজের স্বার্থ অপেক্ষা জনস্বার্থকেই বড় করে দেখে। বাস্তব অভীপ্সার মধ্য দিয়েই ব্যক্তি ও সমাজের সমন্বয় ঘটে। এই অভীপ্সা স্থায়ী, সাময়িক নয়। স্বার্থবুদ্ধি থাকে মুক্ত থাকার দরুন বাস্তব অভীপ্সা লােকের যথার্থ মুক্তিস্পৃহাকে প্রতিফলিত করে। বড় আকারে দেখা দেয় সর্বজনীন স্বার্থ ও কল্যাণ, ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে নিবদ্ধ থাকে না; সমাজকে প্রাধান্য দেয় এবং তার ভিত্তি হলো যুক্তিশীলতা। আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে মানুষ বাস্তব অভীপ্সা উপলদ্ধি করে। প্রতি মানুষের মধ্যে একাধারেই থাকে উভয় অভীপ্সা।

গণ-অভীপ্সার কাজ হলো সর্বজনের বাস্তব অভীপ্সার সংযোগ ও সমন্বয় ঘটানো। সাধারণত লোকের প্রকৃত অভীপ্সাই দেখা দেয়। কিন্তু মানসিক দোটানায় ক্রমে বাস্তব অভীপ্সার জয় হয়। গণ-অভীপ্সা বিভিন্ন লোকের বাস্তব অভীপ্সার একটি সমন্বিত রূপ। তার মধ্যে কারও আত্মত্যাগের প্রশ্ন ওঠে না। গণ-অভীপ্সা সমাজের সর্বজনীন উচ্চতর আদর্শকে তুলে ধরে। যথোচিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গণমঙ্গল সম্পর্কে লোকের চেতনা গণ-অভীপ্সার মাধ্যমে মূর্ত হয়ে ওঠে। গণ-অভীপ্সা সার্বভৌম শক্তি অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভীপ্সা নয়। জনস্বার্থে গণ-অভীপ্সা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্রিয়াশীল হয়। রুশোর এই গণ-অভীপ্সা প্রত্যয় কিছুটা অস্বচ্ছ। তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে প্রত্যয়টি যত না কার্যকর তার চেয়ে নীতিকথা হিসাবেই বড়।[২]

রুশোর মতে, ব্যক্তির সার্বভৌম ইচ্ছার ভিত্তিতে সৃষ্ট যৌথ সত্তা হচ্ছে রাষ্ট্র বা সমাজ। এই সমাজ একটি ক্রিয়াশীল অস্তিত্ব। এ অস্তিত্বেরও ইচ্ছারূপ শক্তি আছে। এবং এই ইচ্ছা’র উৎস হচ্ছে ব্যক্তির সমাজ বা রাষ্ট্র তৈরি করার ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে ঐকমত্য। রাষ্ট্র বা সমাজ হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইচ্ছা। এবং এই ইচ্ছাই হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছার সাধারণ রূপ। সাধারণ বা জেনারেল এই অর্থে যে এ ক্ষেত্রে সকল ব্যক্তির ইচ্ছাই এক। সকলের ইচ্ছা অভিন্ন। সকলে মিলে যৌথ জীবন যাপনের ইচ্ছা। এবং সমাজ জীবনে এই অভিন্ন ইচ্ছাই হচ্ছে সার্বভৌম। ‘ব্যক্তির ইচ্ছার ভিত্তিতে সমাজ বা রাষ্ট্রের ইচ্ছা’ এই তত্ত্বের কারণেই রুশোকে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ প্রবক্তা বলা হয়।[৩]

কিন্তু ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিমুহুর্তে কার্যে যে ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে সে হচ্ছে ব্যক্তির বিশেষ বা ‘পারটিকুলার’ ইচ্ছা। অনেক সময়ে ব্যক্তির এই বিশেষ ইচ্ছার সঙ্গে তার সাধারণ ইচ্ছার বিরোধ ঘটে। ব্যক্তি যখন সচেতন বা অচেতনভাবে যৌথের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হয় তখনি ব্যক্তির ইচ্ছার এই বিরোধের দিকটি প্রকাশিত হয়। রুশো তাঁর ‘সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থে এই তত্ত্বকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সে আলোচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসঙ্গতির প্রকাশ ঘটেছে। তথাপি ‘সাধারণ ইচ্ছার’ তত্ত্ব যে রুশোর রাষ্ট্রদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু এবং রাষ্ট্রদর্শনে এটি যে অনন্য অবদান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।[৩]

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ১২ জানুয়ারি ২০১৯, “রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/encyclopedia/general-will/
২. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৯২-৯৩।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৮২-১৮৩।

রচনাকাল: ১২ জানুয়ারি ২০১৯, নেত্রকোনা বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!