গান্ধীবাদ (ইংরেজি: Gandhism) বলে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একটি মতবাদ হচ্ছে অবিভক্ত ভারতবর্ষের জমিদার ও শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষাকারী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (১৮৬৯-১৯৪৮ খ্রি.) সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অভিমত। গান্ধীবাদ রাজনীতি ও সমাজনীতির সাথে ধর্মের সংমিশ্রণে গঠিত একটি চিন্তাধারা। অর্থাৎ গান্ধীবাদ হলো বিশেষ একটি জীবনধারা, যার সারমর্ম হলো সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও কুসংস্কারের সেবা করা।[১]
গান্ধী সুসংবদ্ধ কোনো রাষ্ট্রদর্শন প্রবর্তন করেননি। প্রচলিত অর্থে গান্ধীবাদ বলে সুস্পষ্ট কিছু নেই, তবুও যদি কিছু থাকে সেটা হলো বিশেষ একটি জীবনধারা, যার সারমর্ম হলো সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও কুসংস্কারের সেবা করা। গণতন্ত্রের শত্রু গান্ধী জনগণের সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতাকে, ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রেরণাকে পদদলিত করে জনগণকে বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নিগড়ে শতশত বছর ধরে আটকে রাখার অপচেষ্টা করেছিলেন।[২]
গান্ধীবাদ বলতে অহিংসাবাদও বুঝায়। কারণ গান্ধী অহিংসাকে কোনো লক্ষ্য সাধনের কেবল উপায় নয়, অহিংসাকেই চরম লক্ষ্য বলে মনে করতেন। তাঁর মতে অহিংসা ও নৈতিক শক্তি হচ্ছে সকল পরিবর্তনের মূল উপায়। গান্ধীর মতে অহিংসা নিছক একটা কর্মকৌশল নয়। অহিংসা মানবজীবন ও সমাজের মূল ভিত্তি। গান্ধীর অহিংসাবাদের সঙ্গে কাউন্ট লিও তলস্তয়ের নৈরাজ্যবাদী মতের মিল ছিল। বস্তুত গান্ধীর সমাজদর্শনে তলস্তয়ের সমাজদর্শনের সুস্পষ্ট প্রভাবের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘হরিজন’ পত্রিকা এবং আপন স্মৃতিকথা ও তাঁর অপরাপর গ্রন্থে গান্ধীবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। গান্ধী তাঁর অহিংসাবাদ বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে অহিংস অসযোগিতার নীতি দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর রাজনীতিক জীবনের শুরুতে প্রয়োগ করেন। পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের উপায় হিসাবে ভারবতবর্ষে এই পদ্ধতি প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেন।[৩]
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীবাদের প্রয়োগ অবিমিশ্র এবং সর্বদা সার্থক না হলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব, দুরভিসন্ধি, কপটতা এবং অনমনীয়তা ভারত ভূখণ্ডের জনসাধারণের, বিশেষ করে বৃহত্তর হিন্দুসমাজের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা জাগাতে এবং ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে ইংরেজ শাসকদের কাছে সহনশীল করে তুলতে বিপুলভাবে সাহায্য করে।
গান্ধীবাদ কৃষককে ভুমিদাসত্বে বন্দি রাখার মতবাদ
গান্ধীবাদ সামন্ত ও জমিদারশ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী এক প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা। গান্ধী কখনোই কৃষকদের জমির মালিকানা দিতে চাননি। দক্ষিণ এশিয়ার কৃষকরা যাতে শত শত বছর ধরে জমিদারদের গোলামী ও দাসত্বে বন্দি থাকে তা গান্ধী নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। গান্ধী নিজেই বলেছিলেন,
“জনগণ আজ ভূস্বামী ও মুনাফাখোরদের তাদের শত্রু বলে মনে করে না। … জমিদার একটি পদ্ধতির যন্ত্র মাত্র। ব্রিটিশ পদ্ধতির বিরুদ্ধতার সংগে সংগে জমিদারদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করার প্রয়োজন নেই।”[৪]
গান্ধীবাদ একান্তই ব্যক্তিবাদী ধর্মাশ্রয়ী সামন্ত ও বুর্জোয়া কল্পনাবিলাসী দর্শন। সমাজের বৈষম্যের জন্য দুৎখবোধ করলেও গান্ধীবাদে সেই বৈষম্যের মূল কারণ বিশ্লেষিত হয় নি। ফলে অহিংসার মাধ্যমে সব বৈষম্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা বাস্তবে স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। গান্ধীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ভারতীয় সমাজ জীবন হতে হ্রাস পেতে থাকে। গান্ধীবাদের কোনো শক্তিশালী উত্তরাধিকার ভারতীয় সমাজে দৃষ্ট হয় না। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী তিনি গোঁড়া হিন্দু বিনায়ক গডসের গুলিতে নিহত হন।
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ২৩ মে ২০১৯, “গান্ধীবাদ প্রসঙ্গে” রোদ্দুরে ডট কম, দোলন প্রভা প্রকাশিত, ঢাকা, ইউআরএল https://www.roddure.com/international/gandhism/
২. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৮১-১৮২।
৪. মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, “ব্যক্তি বনাম পদ্ধতি”, সত্যেন্দ্রনাথ মাইতি সম্পাদিত গান্ধী রচনা সম্ভার, গান্ধী মেমোরিয়াল কমিটি, পশ্চিমবঙ্গ, এপ্রিল ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৩৬।
রচনাকাল: ২৩ মে ২০১৯ নেত্রকোনা বাংলাদেশ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।