নারীমুক্তি হচ্ছে সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন

নারীমুক্তি বা নারী মুক্তি আন্দোলন (ইংরেজি: Freedom of women) হচ্ছে সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে নারীদের মুক্ত হবার বিভিন্ন রূপের ধারাবাহিক আন্দোলন। উনিশ শতকের শেষার্ধে এই আন্দোলন ইউরোপে শুরু হয়ে তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ শতকের শেষার্ধে নারীবাদ নামে একটি পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লে নারী মুক্তি আন্দোলন হোঁচট খায়।

বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত নারীরা কথা বলতে শিখেছে, তারা আর অবলা নয়। তারা টিশার্ট পরে লোকাল বাসে উঠে চোখে সানগ্লাস পরে পোজ দেয়। যদি বলা হয়, একটু মিছিলে চলেন তবে এসব নারীর ভড়ং কোথায় উবে যাবে। নারী মুক্তির লড়াইটি নিশ্চয় টিশার্ট আর চোখে সানগ্লাস পরে পোজ দেয়ার লড়াই ছিলো না আমাদের পূর্বসুরীদের কাছে।

যেই নারীরা একত্রিত, যুদ্ধক্ষেত্রে আছে। কাঁধে রাইফেল, শত্রুর মোকাবেলা করছে দৃঢ়ভাবে। মানবজাতির গত পাঁচ হাজার বছরের সংগ্রামের রূপ নিয়ে আলোচনা করছে যে নারীরা, সেই নারীদের কি টিশার্ট পরতে হবে; “গাঁ ঘেঁষে দাঁড়াবেন না”? কোনো পুরুষের সাহস হবে সেই নারীদের কাছে ঘঁষার? মাংসপিন্ড এবং মর্যাদাবান মানুষের ভেতরে অনেক ফারাক আছে, সেটি ভুলে নারী যদি হয় প্রচারণা আর পপুলিজমের শিকার?

নারীর মুক্তির লক্ষ্য ছিলো পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি, নারী সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ থেকে মুক্ত না হয়ে নিজেদের মুক্ত করতে পারে না, যেমন প্রলেতারিয়েত নিজেদের মুক্ত না করে মানবজাতিকে মুক্ত করতে পারে না। ফলে নারীমুক্তির অগ্রনেত্রীবৃন্দ যেমন ক্লারা জেটকিন, নাদেজদা ক্রুপস্কায়া, আলেকজান্দ্রা কল্লোনতাই, চিয়াং চিং নিজেদেরকে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেছিলেন।

বাংলাদেশে নারী নিপীড়নের জন্য সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্র এবং পুরুষতন্ত্র দায়ী। এই সমস্যাগুলো থেকে বের হবার জন্য গৃহযুদ্ধ ছাড়া তাত্ত্বিক দিক থেকে কি অন্য কোনো পথ খোলা আছে?

রাজনীতি ব্যর্থ হচ্ছে সামন্তবাদের সাথে পুঁজির দ্বন্দ্বটিকে মিটিয়ে ফেলতে, পুঁজি চাচ্ছে মেয়েরা বাইরে কাজে আসুক, সামন্তবাদ ও পুরুষতন্ত্র এটার বিরোধিতা করছে। যখন রাজনীতি সমাধান দেয় না, তখন যুদ্ধের মাধ্যমেই সমাধান করতে হয়। হাজার হাজার ধর্ষণ আর হত্যার পরেও কি যুক্তি থাকতে পারে, এখনো ন্যায়বিচার বা গ্রেপ্তার বা বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার আদায়ের কথা বলার।

যৌন ব্যবসা পৃথিবীর এখন তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবসার খাত। একাডেমিক ক্ষেত্রে LGBTQ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের আরেক পৃষ্ঠপোষক জনপ্রিয় খাত যেটাও আমার কাছে ব্যবসা মনে হয়েছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদের সাথে সংযুক্ত এখন পুরুষতন্ত্র। এই পুরুষতন্ত্রকে শক্তিশালী করে যে নারীরা তারা বায়োলজিকালী নারী হতে পারে কিন্তু তারাও পুরুষতন্ত্রের লাঠিয়াল। আমরা যদি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র মাধ্যম দেখি তবে দেখব, মূলধারার চলচ্চিত্রগুলো মানুষকে সেই যন্ত্র বানাতে চায় শুধু শ্রম দেবে আর যৌনাঙ্গের ব্যবহার করবে। যার মূল বিষয়টাই হচ্ছে সন্তান উৎপাদন। জনসংখ্যা বাড়লেই সস্তায় শ্রম পাওয়া যাবে, এই শ্রমিক উৎপাদন বাড়াবে, উতপাদিত মুনাফার মালিক হবে সেই কর্পোরেট কোম্পানি।

বাংলাদেশে নিরাজনীতিকরণের রাজনীতিই এখন সবচেয়ে বড় রাজনীতি। ফলে ‘নারীদের বাদ দিয়ে জনগণকে রাজনীতিতে টেনে আনা অসম্ভব’[১]। অরাজনৈতিক নামধারী বাঙালি নারীর পেটগুলো এখন ইউরো-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যের দাস তৈরির যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। বাঙালি নারীরা শুধু সস্তায় বাঙলাদেশের শ্রমিক উৎপাদন করে দেশের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অবদান রাখছে তাই নয়; তারা ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যের কর্পোরেট অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে। কিন্তু আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো বাঙালি নারীদের সন্তানেরা যা বিদেশে করছে তা দাসযুগে দাসেরা যা করতো তাই।

নারী ও পুরুষের সম্পর্ক হচ্ছে একটি সামাজিক সম্পর্ক। নারী ও পুরুষের সম্পর্কই মানুষের কাছে সব থেকে স্বাভাবিক মানবীয় সম্পর্ক, প্রাকৃতিক সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে পুঁজিবাদ পুঁজির ও দাসত্বের সম্পর্কে পরিণত করেছে। কার্ল মার্কস লিখেছেন,

“পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্ক হলো মানব সত্ত্বার সাথে মানব সত্ত্বার সবচাইতে স্বাভাবিক সম্পর্ক। তাই এটি সেই বিস্তৃতি উন্মোচন করে যাতে পুরুষের স্বাভাবিক আচরণ হয়ে গেছে মানবিক, অথবা সেই বিস্তৃতি যাতে তার মাঝে মানবিক সারসত্ত্বা হয়ে গেছে স্বাভাবিক সারসত্ত্বা। এই বিস্তৃতিতে তার মানব স্বভাব তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এই সম্পর্ক আরো একটি বিস্তৃতি প্রকাশ করে। তা হলো পুরুষের প্রয়োজনটি কতদূর মানবিক প্রয়োজন হয়ে উঠেছে; আর তাই তা প্রকাশ করে অন্য ব্যক্তি তার জন্য ব্যক্তি হিসেবে কতটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে_ যে নিরিখে সে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বে একই কালে একজন সামাজিক সত্ত্বা। … এই বিশেষ সম্বন্ধ থেকে মানুষের উন্নতির গোটা স্তরটিকেই মূল্যায়ন করা যেতে পারে।”

১৮৭৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্য বের হয়েছে, সেই পুস্তকে নারি-পুরুষ সম্পর্কে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে উচ্চ ধারণার পরিচয় আছে। তারপর শত বছর পেরিয়ে গেছে। এখন ২০১২ সাল। আজ পর্যন্ত নারীমুক্তি, নারীবাদ ও নারী নিয়ে কয়েক হাজার পাতা লেখা হয়েছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই। সব কথা, সব লেখাই যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় একটি উদ্ধৃতিকে। বর্তমানের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই ধরনের উদ্ধৃতি পুরুষেরা অহরহই ব্যবহার করেন। সেই  উদ্ধৃতিটি হচ্ছে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের ‘মেয়ে মানুষ ভক্তিতে কেঁদে গড়াগড়ি দেয় তবুও কোনো মতে তাকে বিশ্বাস করবে না’। ভাবতে অবাক লাগে এইরকম একটি নোংরা উদ্ধৃতি কীভাবে এখনো দিব্যি বেঁচে আছে এবং উদ্ধৃতিদাতা এখনও দেবতা হিসেবে পূজিতও হচ্ছেন।

আমাদের নারীমুক্তি বিষয়ে কাজ করা দরকার। কিন্তু এটা ভোলা উচিত হবে না যে পুরুষতন্ত্রের একটা অর্থনীতিও আছে। বাংলাদেশের নারী-পুরুষেরা ইউরোপ-আমেরিকায় যত সহজে শ্রমদাস সরবরাহ করতে পারে তত সহজে কিন্তু নারীর যথার্থ মুক্তির রাস্তাগুলো খুঁজে বের করতে পারে না। কারণ নারীমুক্তির চিন্তাটি এই কথা বলে যে নারীমুক্তি নারী-পুরুষ উভয়ের মুক্তির অধীন।

তথ্যসূত্র:

১. ভি আই লেনিন, আন্তর্জাতিক নারী দিবস; ৪ মার্চ, ১৯২১
২. কার্ল মার্কস, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি ১৮৪৪, জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১২, পৃষ্ঠা-৮৭-৮৮

Leave a Comment

error: Content is protected !!