অর্থনীতিবাদ বিরোধী সংগ্রাম (ইংরেজি: The fight against Economism) হচ্ছে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলশেভিকবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য যা পার্টিকে রাজনৈতিক সংগ্রামে দক্ষ করে। অর্থনীতিবাদকে পরাজিত করে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি কাজ করে থাকে। যেসব সংগঠন কেবলমাত্র অর্থনীতিবাদী কাজে ব্যাপৃত থাকে সেগুলোকে সাধারণভাবে সংস্কারবাদী ও সুবিধাবাদী সংগঠন বলা হয়ে থাকে।
রাশিয়ার জারের স্বৈরতন্ত্রী আমলে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি গঠন সম্পর্কে লেনিনের যেসব বহুমুখী পরিকল্পনা ছিল সেসব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে, সংশোধনবাদ, সুবিধাবাদ ও অর্থনীতিবাদবিরোধী সংগ্রামে। অর্থনীতিবাদীরা লেনিনের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বিন্দু মাত্র বিলম্ব করেনি। তারা ঘোষণা করল যে জারের বিরুদ্ধে সাধারণ রাজনৈতিক সংগ্রাম চালানো সকল শ্রেণির প্রধানত বুর্জোয়া শ্রেণির কর্তব্য; সুতরাং তাতে শ্রমিক শ্রেণির গুরুতর কোনো স্বার্থ নাই, কেননা উচ্চহারে মজুরি উন্নততর কাজের অবস্থা প্রভৃতি নিয়ে মালিকদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংগ্রাম চালানোই শ্রমিক শ্রেণির প্রধান স্বার্থ।
অর্থনীতিবাদীদের যুক্তি ছিল যে, জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানো বা জারতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন করা কমিউনিস্টদের [সোস্যাল ডেমোক্রাটদের] প্রথম ও প্রধান কর্তব্য নয় ‘সরকার ও মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সংগ্রামের জন্য সংগঠন সৃষ্টি করাই তাদের কাজ। সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সংগ্রামের অর্থ তারা বুঝত উন্নততর কারখানা আইন আদায়ের সংগ্রাম। ‘অর্থনীতিবাদীরা’ দাবি করত যে, এভাবে ‘অর্থনৈতিক সংগ্রামকেই রাজনৈতিক রূপ দেওয়া সম্ভব হবে’। কিন্তু লেনিন অর্থনীতিবাদ বিরোধী সংগ্রাম পরিচালনা করে দেখিয়ে দেন, শ্রমিক শ্রেণির প্রধান কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করা।
শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন সম্বন্ধে খোলাখুলি বিরোধিতা করার সাহস তখন আর ‘অর্থনীতিবাদীদের’ ছিল না। কিন্তু তাদের মত ছিল এই যে, পার্টিকে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের পরিচালক করা উচিত নয়, শ্রমিক শ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করাই উচিত নয়, পরিচালন করা তো দূরের কথা, পার্টির উচিত আন্দোলনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তা অনুধাবন করা ও তা থেকে শিক্ষা লাভ করা।
অর্থনীতিবাদীরা আরও বলত যে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে সচেতন অংশের সমাজতান্ত্রিক চেতনা ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সাংগঠনিক ও পরিচালনাকারী ভূমিকা উপেক্ষণীয় বা প্রায় উপেক্ষণীয়। শ্রমিকদের চিন্তাকে সমাজতান্ত্রিক চেতনার স্তরে উন্নীত করা কমিউনিস্টদের [সোস্যাল ডেমোক্রাটদের] উচিত নয়, বরঞ্চ কমিউনিস্টদের [সোস্যাল ডেমোক্রাটদের] উচিত সাধারণ মজুর কিংবা মজুর শ্রেণীর আরও পশ্চাৎপদ অংশের স্তরে নিজেদের নামিয়ে আনা ও মানিয়ে চলা। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা বিস্তারের চেষ্টা না করিয়া বরং যতদিন না শ্রমিক শ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত চেতনা আপনা হতে তাহাদের সমাজতান্ত্রিক চেতনায় পৌঁছিয়ে দেয় ততদিন অপেক্ষা করা উচিত। এই স্বতঃস্ফূর্ততার পক্ষে ওকালতি করতে গিয়েই অর্থনীতিবাদীরা আনে শ্রেণিচ্যুত হবার ধারণা।
পার্টি সংগঠন বিষয়ে লেনিনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা সম্বন্ধে ‘অর্থনীতিবাদীরা’ বলত যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ওপর রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করা হচ্ছে জবরদস্তির সামিল। ‘ইস্ক্রা’র পাতায় পাতায় এবং বিশেষ করে ‘কি করিতে হইবে?’ শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থে লেনিন ‘অর্থনীতিবাদ’ বিরোধী বা সুবিধাবাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংগ্রাম চালান এবং সেসব চিন্তাকে বিধ্বস্ত করে দেন।
(১) লেনিন দেখালেন যে শ্রমিক শ্রেণিকে সাধারণ রাজনৈতিক সংগ্রাম হতে সরিয়ে রাখার অর্থ হচ্ছে মালিক ও সরকারকে অটুট অবস্থায় রেখে দিয়ে শ্রমিকদের চির দাসত্বের দন্ডে দন্ডিত করার শামিল। মালিক ও সরকার পক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সংগ্রামের অর্থ পুঁজিপতিদের কাছে নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রয়ের সময় দর বাড়াবার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন মার্কা লড়াই। কিন্তু শ্রমিকরা পুঁজিপতিদের কাছে নিজেদের শ্রমশক্তি বেচবার সময় দর বাড়াবার জন্য লড়েই ক্ষান্ত হতে চায় না, যে পুঁজিবাদ তাদেরকে শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে ও শোষণ সহ্য করতে বাধ্য করছে সেই পুঁজিবাদেরই উচ্ছেদ চায়। কিন্তু যতদিন পুঁজিবাদের পাহারাদার কুকুরের মতো জারতন্ত্র শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের পথ রোধ করিয়া রয়েছে, ততদিন শ্রমিকরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ও পূর্ণ সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম গয়ে তুলতে পারবে না। সুতরাং পার্টি ও শ্রমিক শ্রেণির কর্তব্য হলো অবিলম্বে জারতন্ত্র অপসারিত করে সমাজতন্ত্রের রাস্তা পরিষ্কার করা।
(২) লেনিন দেখালেন যে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততাকে বাহবা দেওয়া পার্টির যে ভূমিকা রয়েছে তা অস্বীকার করা, পার্টিকে কেবল ঘটনার পর্যবেক্ষকরূপে নামিয়ে আনার অর্থ হল ‘লেজুড় নীতি’ প্রচার করা, (খভোস্তিজম) পার্টিকে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের লেজুড়ে পরিণত করা, আন্দোলনের নিষ্ক্রিয় শক্তিতে পরিণত করা, পার্টি যে কেবল স্বতঃস্ফূর্তির ধারা আলোচনা করতে পারে এবং ঘটনাবলীকে যথানির্দিষ্টভাবে চলতে দেয় এই কথা বলা। এই প্রচারের অর্থ হল পার্টির ধ্বংস সাধনের জন্য নিজেদের পার্টি নিয়ে শত্রুতা করার জন্য হাজির রয়েছে, তখন শ্রমিক শ্রেণির নিরস্ত্র অবস্থায় ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হলো শ্রমিক শ্রেণির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা।
(৩) লেনিন দেখালেন যে শ্রমিক শ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের স্তুতিতে মাথা নত করা, চেতনার গুরুত্বকে হেয় করা, সমাজতান্ত্রিক চেতনা বা মতবাদকে হেয় করার অর্থ হলো প্রথমত সেই শ্রমিকদেরই অপমান করা, যাদেরকে ঐ চেতনা আলোকের মত আকৃষ্ট করেছে; দ্বিতীয়ত, পার্টির চোখে মতবাদের মূল্যকে হেয় করা, অর্থাৎ যে যন্ত্রের সাহায্যে পার্টি বর্তমানকে বুঝতে পারে ও ভবিষ্যতকে দেখতে পায় সেই যন্ত্রকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা; এবং তৃতীয়ত, সুবিধাবাদের কাদায় একেবারে এমনভাবে নিমজ্জিত হওয়া যে আর উদ্ধারের উপায় পর্যন্ত থাকে না। লেনিন বলেছেন, ‘বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কোনো বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না। যে পার্টি সবচেয়ে অগ্রগামী নীতি দ্বারা পরিচালিত সেই পার্টিই কেবল পারে অগ্রণী সংগ্রামী বাহিনীর ভূমিকা পূর্ণ করতে পারে।’ (লেনিন সিলেকটেড ওয়ার্কস, ইংরেজি সংস্করণ, মস্কো, ১৯৪৭, পৃষ্ঠা ১৬৩-৬৪)।
(৪) লেনিন দেখালেন যে, ‘অর্থনীতিবাদীরা’ যখন বলে যে, শ্রমিক শ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হতেই সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ গড়ে উঠতে পারে, তখন তারা শ্রমিক শ্রেণিকে প্রতারণা করে, কারণ প্রকৃতপক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হতে নয়, বিজ্ঞান হইতেই সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের উৎপত্তি হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণিকে সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবার প্রয়োজনকে অস্বীকার করে ‘অর্থনীতিবাদীরা’ বুর্জোয়া মতাদর্শের পথ পরিষ্কার করেছিল, সেই মতাদর্শ যাতে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে প্রবেশ করে বিস্তার লাভ করিতে পারে তার ব্যবস্থা প্রশস্ত করেছিল এবং তারই ফলে শ্রমিক শ্রেণি ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে মিলনের কথাকে কবর দিয়ে বুর্জোয়াদের সাহায্য করছিল।
লেনিন বলেন, শ্রমিক আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততার স্তুতি ‘সচেতন অংশের ভূমিকা, সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির ভূমিকাকে হেয় প্রতিপন্ন করবার সর্ব প্রকার চেষ্টার অর্থ হলো শ্রমিকদের মধ্যে বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রভাবকে শক্তিশালী করা- যাহারা পার্টিকে হেয় প্রমাণ করে তাহারা ইহা কামনা করুক বা না করুক।’ (ঐ, পৃষ্ঠা ১৭৩)।
লেনিন আরও লেখেন: ‘বুর্জোয়া অথবা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের মধ্যে শুধু একটাকেই আমাদের বেছে নিতে হবে। মাঝামাঝি কোনো পথ নেই। সুতরাং কোনো ক্রমে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে হেয় করা কিংবা সামান্যতম মাত্রায় এ পথ হতে সরে আসার অর্থ হলো বুর্জোয়া মতাদর্শকে শক্তিশালী করা।’ (ঐ পৃষ্ঠা ১৭৪-১৭৫)।
(৫) অর্থনীতিবাদীদের এইসব ভুলভ্রান্তি একত্রে বিচার করে লেনিন সিদ্ধান্ত করেন যে শ্রমিক শ্রেণিকে পুঁজিবাদের কবল হতে উদ্ধারের জন্য সমাজ বিপ্লবের যে পার্টি দরকার তারা তা চায়নি, তারা চেয়েছিল এমন এক ‘সমাজসংস্কারকের’ দল যারা পুঁজিবাদী শাসনকে কায়েম রাখে, এবং এই কারণেই ‘অর্থনীতিবাদীদের’ সর্বহারা শ্রেণির মূল স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতক সংস্কারবাদী বলা যায়।
(৬) সব শেষে লেনিন দেখালেন যে ‘অর্থনীতিবাদ’ শুধু রুশ দেশে একটা আকস্মিক ব্যাপার নয়, শ্রমিক শ্রেণির ওপর বুর্জোয়া প্রভাব বিস্তারের এটাই একটা অস্ত্র, সুবিধাবাদী বার্নস্টাইনের যে অনুবর্তীরা মার্কসবাদকে মেজে ঘষে নিচ্ছিল পশ্চিম ইউরোপে কমিউনিস্ট [সোস্যাল ডেমোক্রাটিক] দলগুলিকে সুবিধাবাদীদের শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছিল; মার্কসের ‘সমালোচনা করবার পূর্ণ অধিকার’ সম্বন্ধে বুলি আওড়িয়ে তারা মার্কসবাদের পুনর্লিখন দাবি করিছিল (এজন্য সেটাকে বলা হয় পুনর্লিখনবাদ বা সংশোধনবাদ); বিপ্লব, সমাজতন্ত্র ও সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের নীতি পরিহার করার দাবি তারা করছিল। লেনিন দেখালেন যে, রুশ ‘অর্থনীতিবাদীরা’ বিপ্লবী সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র ও সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব পরিহার করা সম্বন্ধে অনুরূপ নীতি অনুসরণ করছিল।
লেনিন উপরোক্ত বেশ কয়েক ধরনের অর্থনীতিবাদ বিরোধী সংগ্রাম পরিচালনা করে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তাকে সৃজনশীলভাবে অনুশীলন করে পার্টি চিন্তাকে এগিয়ে নেন। লেনিনের এই লড়াকু পদ্ধতি লেনিনবাদের ভিত্তি তৈরি করে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।