নারীবাদ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন

নারীবাদ (ইংরেজি: Feminism) হচ্ছে একটি পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন, যা মূলত বিশ শতকের ষাটের দশকে দেশে দেশে শুরু হয়েছিল। সত্তরের দশককে সাম্যবাদীদের দিক থেকে মুক্তির দশক ঘোষণা করা হয় গোটা দুনিয়ায়। ষাটের দশকে কমিউনিজমের বিস্তারের বিপরীতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে দুটি মতবাদকে সামনে আনে তা হচ্ছে নারীবাদ এবং মৌলবাদ। সত্তরের দশকে ধর্মীয় ডানপন্থিদের এবং নারী নির্যাতন ও নির্যাতনবিরোধী ছোট ছোট মিছিলকেও প্রচুর প্রচার দেয় বিবিসি। অর্থাৎ পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বকে পেছেন হটিয়ে তারা পুঁজিবাদের সাথে নারীবাদী আন্দোলনকে সামনে নিয়ে আসে।

ইউরোপে আর আমেরিকায় নারীবাদী আন্দোলনের যত ফটো আপনি দেখবেন তার অন্তত অর্ধেক ফটো হচ্ছে পোশাক খুলে ফেলার ফটো। ফেমিনি, ফেমিনিজম, ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট মানেই হচ্ছে পোশাক ছেড়ে দুই একটি মিছিল, পুলিশের সামনে বা রাস্তায় ২০-৫০ জন মহিলার সামান্য বক্তৃতা। এই নারীবাদীরা সেসব নারীদের শত্রু যারা ফিলিপাইনে, সিরিয়ায়, লাতিন আমেরিকায় গণযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে অস্ত্র হাতে।

নারীবাদ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট একটি প্রচারণা পদ্ধতি (Propaganda)। নারীমুক্তির দীর্ঘ ইতিহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট নারীবাদী আন্দোলন দেশে দেশে বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে ১৯৬০-এর দশকের পর ছড়িয়ে পড়ে। ফলে গত অর্ধ শতকে দেখা গেছে যারা নিজেদের নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দেয় তারা নারীমুক্তির বিরোধী।

নারীবাদীরা নারীর শরীর নিয়ে ব্যবসা করার বিরোধী নয়, এরা মুনাফার বিরোধী নয়, নারীবাদীরা এখন পুঁজিবাদেরও বিরোধী নয়। ফলে নারীবাদীরা এখন সাম্রাজ্যবাদের ও পুঁজিবাদের একনিষ্ঠ সহযোগী। সে হিসেবে নারীবাদ সমর্থন করে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্রকে। নারীবাদ ভিত্তিগত ও মর্মগত দিক দিয়ে নারীমুক্তি ও নারীমুক্তি আন্দোলনের বিরোধী। কমিউনিস্ট আন্দোলনের শিক্ষকেরা বলতেন নারীমুক্তি, এটার বিপরীতে বুর্জোয়া চিন্তাবিদেরা আনে নারীবাদের ধারণা।[১]

নারীবাদ সম্পর্কিত ইতিহাস

নারীবাদের গোড়ার কথার মধ্যে যদি প্রবেশ করবার চেষ্টা করি, তাহলে হয়ত নারীবাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা একটু স্বচ্ছ হতে পারে। পশ্চিম ইউরোপে বুর্জোয়া শ্রেণির অভ্যুত্থানের মধ্যেই আজকের নারীবাদের বীজ নিহিত আছে।

বুর্জোয়া শ্রেণি যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ওপরে দাঁড়িয়েছিল, তার শ্রমবিভাজনের রূপটি ছিল লিঙ্গভিত্তিক অর্থাৎ বুর্জোয়া মতাদর্শ অনুসারে পুরুষের জন্য বরাদ্দ হলো বাইরের জগতের উৎপাদনমুখী ভূমিকা। এই ভূমিকাকে মুখ্য ভূমিকা বলে স্বীকার করে নেওয়াটাকেও স্বাভাবিক মনে করা হয়েছিল। আর মেয়েরা তার পরিপূরক হিসাবে পেল অন্দরমহলে প্রজননমুখী ভূমিকা। সন্তানপালন, পরিচর্যা মারফত প্রতিদিন জীবনের নবীকরণ, এই হলো বুর্জোয়া সমাজে স্বীকৃত নারীর সামাজিক ভূমিকা। এখানে উৎপাদনের তুলনায় প্রজনন হয়ে রইল গৌণ। সেজন্যই এই সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের প্রায় দেড়শ বছর পরে ১৯৪৯ সালে ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়া নারীর সামাজিক অবস্থানকে Second Sex (দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত) বলে অভিহিত করলেন প্রতিবাদী স্বরে।

এই প্রতিবাদ অবশ্য আগে থেকেই উচ্চারিত হচ্ছিল। বুর্জোয়া চিন্তাবিদদের মধ্য থেকে আঠার শতকের বুদ্ধিজীবী মেরি উলস্টোনক্রাফট এবং উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল মেয়েদের শিক্ষার ও জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত করে অন্দরমহলে আটকে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এঙ্গেলস ব্যক্তিগত মালিকানাতে পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎস সন্ধানে নারীর বিশ্ব-ঐতিহাসিক পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের গোড়াপত্তন করেন।

পশ্চিমে এইসব কণ্ঠস্বর আবার নতুন করে শোনার এবং শোনানোর প্রবণতা দেখা দিল উনিশ শতকের ষাটের এবং সত্তরের দশকে—যখন ইউরোপ ও আমেরিকাতে নারীবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ল। এই সময় থেকেই নারীবাদ সম্পর্কে মানুষ সচেতন হতে শুরু করল ।

বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ধনতন্ত্র যখন সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে মরিয়া তখন দেখা গেল মেয়েরা রয়ে গেছে দারুণ বৈষম্যের শিকার। কাজের জগতে তাদের স্বীকৃতি কিছুই বাড়েনি, বরং কমেছে। সৃজনশীল শিল্পে তাদের জন্য ধরা থাকে এক ইচ্ছাকৃত এবং সম্মিলিত বিস্মৃতি।

ইতিহাসে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখ থাকে না, সাহিত্যে নারীচিত্রণ প্রায়শই হয় পুরুষের যৌনতার শিকার। বাজারি সভ্যতার প্রধান বাহক যে গণমাধ্যম সেখানে মেয়েদের চিত্রায়ণ ক্রমশ অবদমিত হয়ে পুরুষের লালসার ইন্ধন জোগায়। মেয়েদের ওপরে হিংসাত্মক আচরণের স্বরূপটিও সুখকর নয়। পরিবারের মধ্যে স্বাভাবিকতার মুখোশ পরে অত্যাচার করা হয় নারী ও শিশুদের। নারী আন্দোলন এই নতুনভাবে দেখার রীতিগুলিকে আন্দোলনের কাজে লাগায় ।

সচেতনভাবে নারীবাদ যখন অতীতের দিকে ফিরে তাকায় তখন পিতৃতন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচিত হয় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে। মতাদর্শগত ভিত্তিকে আশ্রয় করে যেসব নারীবাদ গড়ে উঠেছিল, বিভিন্ন নামে তাদের অভিহিত করা হয়, যেমন, উদারনৈতিক নারীবাদ (Liberal Feminism), সমাজবাদী নারীবাদ (Socialist Feminist)। যে নারীবাদ পিতৃতন্ত্রকেই একটি স্বতন্ত্র শোষণ ব্যবস্থা বলে মনে করে তাকে র‍্যাডিকাল নারীবাদ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। র‍্যাডিকাল নারীবাদ অনেকাংশে পুরুষবিরোধী।

তবে নারীর স্বীকৃতির লড়াই নিয়ে এই বিভিন্ন মতাবলম্বী নারীবাদের মধ্যে সাযুজ্য রয়েছে যথেষ্ট, যতই এগুলিকে আপাতবিরোধী মনে হোক না কেন। যেমন ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে দেখলেও বেশিরভাগ নারীবাদী মনে করেন মেয়েদের শরীর বিশেষ করে তাদের প্রজননক্ষমতা ও যৌনতার ওপরে তাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ আরো অনেক বেশি বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং কাজের অধিকার ও তার স্বীকৃতি এইসব ক্ষেত্রেই তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হওয়াটা সমাজের ন্যায়বোধের পরিপন্থী। এরফলে উন্নয়ন লক্ষ্যচ্যুত।

নারীবাদের উৎপত্তি পশ্চিমি শ্বেতাঙ্গ সমাজের মধ্যে হওয়া সত্ত্বেও এর উপযোগিতা আজকে সমাজের শোষিত অংশের মধ্যে বহুলস্বীকৃত। দাসপ্রথা দিয়ে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা যে গরিব খেটে খাওয়া কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়কে চরম অবহেলার জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠিন প্রতিবাদ এসেছে কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের মধ্য থেকে যাদের মধ্যে নোবেল জয়ী ট্যেনি মরিসন অন্যতম। তেমনি পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ফলে যে তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব হয় সেখানেও সমাজ, পরিবার এবং সাম্প্রতিককালে বাজারের শোষণের বিচিত্র বীভৎস চেহারা বেরিয়ে এসেছে নারীবাদী বিশ্লেষণের মাধ্যমে। শিল্পী-সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, গণমাধ্যমের প্রতিবাদী কর্মী, সকলেই সামিল এই কর্মযজ্ঞে।

যে নারী পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ কাজ করে এক-তৃতীয়াংশ স্বাচ্ছন্দ্যভোগ করে (যার মধ্যে আবার শ্রেণি এবং ধর্মীয় অনুশাসনের জন্য বেশিরভাগ নারী বঞ্চিত) তার স্বীকৃতি এবং সমানাধিকারের লড়াইয়ের নাম নারীবাদ। মনে রাখতে হবে নারী এবং পুরুষ সমান মানে তারা এক নয় এবং পুরুষের অধিকার বেশি বলে কিন্তু তারা-ই মনুষ্যজাতির আদল নয়। অর্থাৎ নারীকে নারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নারীর অর্জিত – ক্ষমতার বিশেষ দিকগুলি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে নারীবাদ অনেকাংশে সাহায্য করেছে।

বিভিন্ন মতাদর্শ থেকে গড়ে ওঠা নারীবাদ আজকের চিন্তাজগতে বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের কষ্টিপাথরে এর শেষ যাচাই। নারীবাদের অন্যতম শ্লোগান। Personal is Political—নারীবাদী চেতনা ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়।[২]

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি,  ৭ এপ্রিল ২০১৯, “নারীর মর্যাদা, নারীর লড়াই এবং নারীমুক্তি প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/ideology/leninism/womens-dignity-womens-fight/
২. যশোধরা বাগচী, “নারীবাদ”, সুধীর চক্রবর্তী; বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৩৩৪-৩৩৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!