ফ্যাসিবাদ একটি হিংস্র কিন্তু অস্থিতিশীল শক্তি

জর্জি দিমিত্রভ
জর্জি দিমিত্রভ

বুর্জোয়াদের ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব একটি হিংস্র শক্তি, কিন্তু তা স্থিতিশীল নয়।

ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বের অস্থায়িত্বের প্রধান কারণগুলি কি ?

যদিও বুর্জোয়া শিবিরের মধ্যে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্বকে সে অতিক্রম করার চেষ্টা করছে কিন্তু আসলে সে এই দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তুলছে । ফ্যাসিবাদ অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে হিংসাত্মক উপায়ে ধ্বংস করে তার রাজনৈতিক একাধিপত্য স্থাপন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুঁজিবাদি প্রথার অস্তিত্ব, বিভিন্ন শ্রেণির অস্তিত্ব এবং শ্রেণিগত বিরোধের তীব্রতা অনিবার্যভাবেই ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক একাধিপত্য কমিয়ে দিচ্ছে এবং ধ্বংস করছে। কোনো সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থায় এটা হয় না, যেখানে রাজনৈতিক একাধিপত্যসম্পন্ন একটি দলই সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করছে, কিন্তু যেখানে এই রাজনৈতিক একনায়কত্ব লক্ষ লক্ষ মেহনতি জনতার স্বার্থের সঙ্গে মিলে গেছে এবং আরো বেশি করে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ওপর ভিত্তি করা হচ্ছে। একটি ফ্যাসিস্ট দেশে ফ্যাসিস্ট দল তার একনায়কত্ব বেশিদিন রাখতে পারে না, কারণ শ্রেণি এবং শ্রেণিবিভেদ উঠিয়ে দেওয়া তার লক্ষ্য হতে পারে না। সে বুর্জোয়া দলগুলির আইনসঙ্গত অস্তিত্ব উঠিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের অনেকেরই বেআইনী অস্তিত্ব থাকে, আর কমিউনিস্ট পার্টির এই বেআইনী অবস্থাতেও অগ্রগতি ঘটতে থাকে, সে ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে ওঠে এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বের বিরুদ্ধে সর্বহারার সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়। সুতরাং শ্রেণিবিভেদের আঘাতে ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক একাধিপত্য ধসে যেতে বাধ্য।

ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বের অস্থিতিশীলতার আরেকটি কারণ হলো ফ্যাসিবাদের পুজিপতি-বিরোধী ফাঁকা বক্তৃতা এবং লুণ্ঠনকারীদের মতো একচেটিয়া ব্যবসায়ী বুর্জোয়াদের বড়লোক করে দেওয়ার নীতি—এই দুয়ের মধ্যকার পরস্পরবিরোধিতা ফ্যাসিবাদের শ্রেণিচরিত্র প্রকাশের কাজ সহজ করে দেয় এবং তার গণভিত্তি টলিয়ে দেয় ও সংকীর্ণ করে।

তাছাড়া ফ্যাসিবাদের সাফল্য জনগণকে গভীর ঘৃণা ও ক্রোধ জাগিয়ে তুলে বিপ্লবী করে তুলতে সাহায্য করে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বহারাদের একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রবল উৎসাহের সৃষ্টি করে।

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের (অটার্কি) নীতি অনুসরণ করে এবং জাতীয় আয়ের বেশিরভাগ অংশটাই যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য বাজেয়াপ্ত করে ফ্যাসিবাদ সমস্ত অর্থনৈতিক জীবনকে দুর্বল করে এবং পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক লড়াই আরো জোরদার করে। বুর্জোয়াদের মধ্যে যে সংঘর্ষ শুরু হয় তাকে সে একটি তীব্র এবং কখনও কখনও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের চেহারা দেয়, যার ফলে জনগণের চোখে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়৷ যে সরকার নিজের অনুগামীদের হত্যা করে, যা নাকি গত বছরের ৩০ জুন জার্মানিতে হয়েছিল, যে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট বুর্জোয়া শ্রেণির আরেকটি অংশ সশস্ত্র লড়াই চালাচ্ছে (অস্ট্রিয়ার নাশনাল সোশ্যালিস্টদের ক্ষমতা দখল এবং পোল্যাণ্ড, বুলগেরিয়া, ফিনল্যাণ্ড ও অন্যান্য দেশে আলাদা আলাদা ফ্যাসিস্ট দলের ফ্যাসিস্ট সরকারের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ)—এই চরিত্রের কোনো সরকার বৃহৎ পেটি বুর্জোয়া জনগণের চোখে তার নিজের কর্তৃত্ব বেশিদিন বজায় রাখতে পারে না ৷

শ্রমিক শ্রেণিকে বুর্জোয়া শিবিরের শত্রুতা এবং সংঘর্ষের সুযোগ নিতে হবে, কিন্তু ফ্যাসিবাদ নিজেই নিজেকে ক্ষয় করে ফেলবে, এই ধরণের মোহ তার পোষণ করা চলবে না। ফ্যাসিবাদ আপসে ধ্বংস হবে না। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী কার্যকলাপই একমাত্র বুর্জোয়া শিবিরের মধ্যকার অনিবার্য সংঘর্ষগুলির সুযোগ নিতে পারে এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বকে দুর্বল করে তার পতন ঘটাতে পারে।

বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চিহ্নগুলিকে ধ্বংস করে খোলাখুলি হিংসাকে শাসন ব্যবস্থায় পরিণত করে ফ্যাসিবাদ গণতান্ত্রিক মোহকে নাড়িয়ে দেয় এবং মেহনতী জনতার চোখে আইনের কর্তৃত্ব নষ্ট করে দেয়। এরকম ঘটেছে বিশেষ করে অস্ট্রিয়া ও স্পেনে, যেখানে শ্রমিকরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে। অস্ট্রিয়াতে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও শুটজবুণ্ড এবং কমিউনিস্টদের যে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম তা প্রথম থেকেই ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বের স্থিতিশীলতা টলিয়ে দিয়েছে । স্পেনে বুর্জোয়ারা মেহনতি জনতার ওপর ফ্যাসিস্ট বন্দুক চাপিয়ে দিতে পারেনি। অস্ট্রিয়া ও স্পেনের সশস্ত্র সংগ্রামের ফল হয়েছে এই যে, আরো বেশি সংখ্যায় শ্রমিকরা বিপ্লবী শ্রেণিসংগ্রামের প্রয়োজন বুঝতে পারছে।

হিটলারের জয় ফ্রান্সে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির একটি যুক্তফ্রণ্ট স্থাপনে নিশ্চিত উৎসাহ যুগিয়েছে। হিটলারের জয় শ্রমিকদের মনে কেবলমাত্র জার্মান শ্রমিকদের ভাগ্যে যা ঘটেছে সে বিষয়ে ভয়ই জাগায়নি, শুধু তাদের জার্মান শ্রেণি ভাইদের হত্যাকারীদের সম্বন্ধে মনে ঘৃণাই জ্বালিয়ে তোলেনি, তাদের মধ্যে এই সিদ্ধান্তকে দৃঢ়তর করেছে যে, জার্মান শ্রমিক শ্রেণির ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তাদের দেশে কোনো অবস্থাতেই সেটা ঘটতে দেওয়া যাবে না।

আরো পড়ুন

সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে যুক্তফ্রন্ট গঠনের যে জোরালো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় যে, পরাজয়ের শিক্ষা বৃথা যায়নি ৷ শ্রমিক শ্রেণি এক নতুন ভাবে কাজ করতে শুরু করছে। যুক্তফ্রন্ট গঠনে কমিউনিস্ট পার্টি যে উদ্যোগ দেখিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট এবং বিপ্লবী শ্রমিকরা যে চরম আত্মত্যাগ করেছে তার ফলে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সম্মান অভূতপূর্ব রকমে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে এক গভীর সংকট বেড়ে উঠছে, যা খুব স্পষ্টভাবে দেখা গেছে এবং যা জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির দেউলিয়াপনার সঙ্গে সঙ্গে আরো প্রখর হয়ে উঠেছে!

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক কর্মিরা নিজেদের আরো জোরের সঙ্গে বোঝাতে পারছে যে, সমস্ত বিভীষিকা ও বর্বরতা সমেত ফ্যাসিস্ট জার্মানি শেষ বিশ্লেষণে হলো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বুর্জোয়াদের সঙ্গে শ্রেণি সহযোগিতার নীতির ফল। জনগণ আরো বেশি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছে, যে পথে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক নেতারা সর্বহারাদের নিয়ে গেছে সে পথে আর যাওয়া চলবে না। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের শিবিরে এখনকার মতো আদর্শগত বিভেদ আর কখনোই ঘটেনি। সমস্ত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতেই এখন একটা পৃথকীকরণের কাজ চলছে। তাদের নিজেদের দলের মধ্যেই দুটি প্রধান শিবির গড়ে উঠছে: যেসব প্রতিক্রিয়াশীল লোকজন সমস্ত উপায়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও বুর্জোয়াদের মধ্যেকার জোটকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে এবং যারা অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট বরবাদ করছে, সেই শিবিরের পাশাপাশি আর একটি শিবির তৈরি হচ্ছে বিপ্লবী লোকজনকে নিয়ে, যারা বুর্জোয়াদের সঙ্গে শ্রেণিসহযোগিতার নীতির সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে, যারা কমিউনিস্টদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষপাতী এবং যারা আরো বেশি করে বিপ্লবী শ্রেণিসংগ্রামের দিকে যাচ্ছে। অতএব যে ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতনের ফলে আবির্ভূত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সে আরো বেশি অবক্ষয়ের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। অতএব ফ্যাসিবাদ, — যা শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী আন্দোলন মার্কসবাদকে কবর দেবার অঙ্গীকার করেছিল—তা জীবনের দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রামের ফলে নিজেই শেষ পর্যন্ত তার কবর খুঁড়বে, পুঁজিবাদের কবর খুঁড়বে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!