ফেবিয়ানবাদ বা ফেবিয়ান সমিতি বা ‘ফেবিয়ান সোসাইটি’ (ইংরেজি: Fabian Society, Fabianism) হচ্ছে প্রাচীন রোমের বিখ্যাত সমরবিদ ফ্যাবিয়াস-এর নামের ভিত্তিতে ঊনবিংশ শতকের ইংল্যাণ্ডের একদল গণতান্ত্রিক সমাজবাদী চিন্তাবিদের প্রতিষ্ঠিত সমিতি। ব্রিটিশ এই সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের উদ্দেশ্য হলো গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের নীতিগুলিকে বিপ্লবী উৎখাতের পরিবর্তে ধীরে ধীরে এবং সংস্কারবাদী প্রচেষ্টার মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেওয়া। ফ্যাবিয়ান সোসাইটি ঐতিহাসিকভাবে বামপন্থী উদার ঐতিহ্যের ধারা হিসেবে আমূলসংস্কারবাদের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
রোমের সমরবিদ ফ্যাবিয়াসের নাম গ্রহণ করার কারণ এই সমরবিদ সেকালে (খ্রি. পূ. ৩২২-২৯৫) কারথেজের সঙ্গে রোমের যুদ্ধে যে কৌশল গ্রহন করেছিলেন সে কৌশলের বৈশিষ্ট্য ছিল ‘বিলম্বিতকরণ’। ল্যাটিন শব্দ ‘কাংটেটর’-এর অর্থ হলো বিলম্বকারী। ফ্যাবিয়াসকে তাই ‘কাংটেটর’ বলা হতো। ফ্যাবিয়াস কার্থেজের প্রখ্যাত সমরবিদ হানিবলের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ পরিহার করে যুদ্ধ প্রলম্বিত করে পরিশেষে হানিবলকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
আধুনিককালে, ঊনবিংশ শতকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন যখন বিস্তার লাভ করতে থাকে তখন ইংল্যাণ্ডের গণতন্ত্রবাদী বেশ কিছু সমাজবাদী পুঁজিবাদের সঙ্গে সরাসরি মারাত্মক সংঘর্ষ বা বিপ্লবকে পরিহার করে ক্রমান্বয়ে প্রচারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্বকে গ্রহণ করেন। তাঁদের তত্ত্বের সারমর্মকে প্রকাশের জন্য ‘ফ্যাবিয়াস’ নামের ভিত্তিতে তাঁদের সমিতিকে ফ্যাবিয়ান সমিতি বলে অভিহিত করেন। ফ্যাবিয়ান সমিতি সূচনাকলের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ, সিডনী ওয়েব, সিডনী অলিভার এবং গ্রাহাম ওয়ালাস।
১৮৮৯ সনে ‘ফ্যাবিয়ান নিবন্ধাবলী’ বা ‘ফ্যাবিয়ান এসেজ’ নামক গ্রস্থ প্রকাশের মাধ্যমে এই সমিতির প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই সমিতির উদ্যোগে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে এই কমিটি থেকে ইংল্যাণ্ডের লেবার পার্টির উদ্ভব ঘটে। প্রায় ১৯১৪ সন পর্যন্ত ফ্যাবিয়ান সমিতির কার্যক্রমে জোর ছিল। এই সময়ে সমিতির সদস্যসংখ্যা ১৫০০০ এবং স্থানীয়ভাবে প্রায় ১০০০টি সমিতিতে পৌঁছেছিল। ১৯২০ ও ত্রিশের দশকে সমিতির কার্যক্রমে ভাটা পড়ে।
১৯৩৯ সনের দিকে এ্যাটলী, জি.ডি.এইচ. কোল প্রমুখ রাজনীতিক নেতা এবং লেখকের উদ্যোগে সমিতিটিকে পুনর্গঠিত হতে দেখা যায়। এর পরেও ফ্যাবিয়ান সমিতি কার্যক্রমের, বিশেষ করে এদের ‘ক্রমান্বয়বাদী’ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রকাশ নানা সম্মেলন আহবান, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে ঘটতে দেখা যায়। ইংল্যাণ্ডের লেবার পার্টিকে ফ্যাবিয়ান সোসাইটির বা ফেবিয়ানবাদ চিন্তাধারার প্রধান ফলশ্রুতি এবং উত্তরাধিকারী বলে বিবেচনা করা চলে। বিভিন্ন সময়ে পার্লামেন্টে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে প্রায় ১৩০ জন সদস্য ফ্যাবিয়ান সমিতিভুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে হ্যারলড উইলসনের নাম উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ২২ মে ২০১৯, “ফ্যাবিয়ান সমিতি হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী সমিতি”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/literature/on-fabian-society/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।