কৌটিল্যের মণ্ডলতত্ত্ব বা কৌটিল্যীয় কূটনীতি হচ্ছে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোচনা

কৌটিল্যের মণ্ডলতত্ত্ব বা মণ্ডল মতবাদ বা কোটিল্যীয় কূটনীতি (ইংরেজি: Mandal Theory বা Diplomacy of Kautilya) বা ষষ্ঠাঙ্গনীতি হচ্ছে কৌটিল্যের আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক বা পররাষ্ট্র বিষয়ক রাজনৈতিক চিন্তাধারা। কৌটিল্য তাঁর গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন সবিশেষ গুরুত্ব সহকারে।

সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তার ও পররাজ্য দখলের লক্ষ্যে রাজাকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। এই সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রগুলোকে কৌটিল্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্যে সন্নিবেশিত করেছেন যা মণ্ডল নামে খ্যাত। মণ্ডলের আওতায় মোট ১২ জন রাজা ও তাঁদের রাজ্যকে রাখা হয়েছে যাদের মধ্যে কার সঙ্গে কীরকম সম্পর্ক স্থাপিত হবে তার ওপর উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজার সাফল্য নির্ভরশীল।

কৌটিল্যের মণ্ডলতত্ত্ব

কৌটিল্যের মণ্ডলতত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে একজন বিজিগীষু রাজাকে কেন্দ্র করে যিনি নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করবেন এবং এ উদ্দেশ্যে অবশিষ্ট ১১ জনের সঙ্গে শত্রুতা বা মিত্রতা বা মাঝামাঝি সম্পর্ক স্থাপন করবেন। বিজিগীষু রাজার সম্মুখভাগে ৫ জন রাজা আছেন: অরি (শত্রু), মিত্র (বিজিগীষুর বন্ধু), অরি-মিত্র (শত্রুর বন্ধু), মিত্র-মিত্র (বিজিগীষুর বন্ধুর বন্ধু) এবং অরি-মিত্র-মিত্র (শত্রুর বন্ধুর বন্ধু)। বিজিগীষু রাজার পশ্চাদভাগে রয়েছেন: পাঞ্চিগ্রাহ (শত্রু), আক্রন্দ (বন্ধু), পাঞ্চিগ্রাহাসার (পশ্চাদভাগের শত্রুর বন্ধু) এবং আক্রন্দাসার (পশ্চাদভাগের বন্ধুর বন্ধু)। তাছাড়া মণ্ডলে মধ্যম (মধ্যবর্তী রাজা) এবং , উদাসীন (নিরপেক্ষ রাজা) রাজাও রয়েছেন। 

মধ্যম রাষ্ট্র কারও নিজস্ব রাষ্ট্রের সীমান্তে কিংবা তার নিকটতম শত্রুর সীমান্তে অবস্থিত এবং উভয়কেই (নিজস্ব রাষ্ট্র বা এর শত্রুকে) সাহায্য করতে সমর্থ। উদাসীন রাষ্ট্র উপরোক্ত যে  কোনো রাষ্ট্রের সীমান্তের বাইরে অবস্থিত, তবে অত্যন্ত শক্তিশালী বা কারও নিজস্ব রাষ্ট্র, শক্ররাষ্ট্র বা মধ্যম রাষ্ট্রকে একযোগে কিংবা পৃথক-পৃথকভাবে সাহায্য করতে বা এদের যে কোনোটিকে পৃথক-পৃথকভাবে প্রতিহত করতে সমর্থ। সুতরাং মণ্ডলতত্ত্বে চারটি উপমণ্ডল কল্পিত হয়েছে যেগুলো বিজিগীষু, অরি, মধ্যম ও উদাসীনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বিজিগীষু উপায় (শান্তিনীতি) ও গুণের (যুদ্ধ-কৌশল) মাধ্যমে ত্রিশক্তি (জ্ঞান, কোষ ও বীরত্ব) প্রয়োগ করে মণ্ডলকে এমনভাবে বিন্যস্ত করবেন যাতে সর্বাধিক ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জন করতে পারেন।

মধ্যম ও উদাসীন রাজারা নিরপেক্ষতার মাধ্যমে মণ্ডলে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখেন। সুতরাং কৌটিল্য মধ্যম ও উদাসীন রাজাদের সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হবার জন্য বিজিগীষু রাজাকে সুনির্দিষ্টভাবে উপদেশ দেন।

আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের ষষ্ঠাঙ্গনীতি

আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৌটিল্য ছয়টি নীতি নির্দেশ করেছেন: সন্ধি, বিগ্রহ (যুদ্ধ), আসন (নিরপেক্ষতা), যান (অগ্রগমন), সংশ্রয় (জোট গঠন) এবং দ্বৈধীভাব (দ্বৈতনীতি)। এগুলো একত্রে ‘ষষ্ঠাঙ্গনীতি’ নামে পরিচিত। শত্রুর তুলনায় বিজিগীষু রাজা যখন দুর্বল অবস্থানে থাকেন তখন তিনি শান্তি (সন্ধি) স্থাপন করবেন। কৌটিল্য অকারণে যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না, কারণ এতে অর্থ, শক্তি ও প্রাণের হানি ঘটে। কিন্তু যখন যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং বিজিগীষু রাজা নিশ্চিত হন যে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ্য তার আছে তখন তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হবেন।

বিজিগীষু সাধারণত একজন দুর্বল শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন, তবে দুর্বল রাজা পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করলে তার সঙ্গে শান্তি স্থাপন করবেন। শান্তি কিংবা যুদ্ধের নীতি অনুসরণের ফলে যদি বিজিগীষু রাজার লাভ কিংবা শত্রুর ক্ষতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকে তাহলে তিনি নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করবেন। যখন বিজিগীষু রাজা তার শত্রুকে আক্রমণ করতে অসমর্থ কিন্তু নিজেকে রক্ষার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী তখন তিনি শান্তির আড়ালে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। যখন বিজিগীষু রাজা নিজের বিপদ অপ্রতিরোধ্য ও অত্যাসন্ন দেখেন তখন তার কর্তব্য অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে জোট গঠন করা। যদি মণ্ডলের সম্মুখস্থ শক্তিগুলো (মিত্র ও মিত্র-মিত্র) কার্যকর না থাকে তবে মণ্ডলের পশ্চাতে অবস্থিত মধ্যম অথবা উদাসীনের নিকট আশ্রয় নিতে পারেন। যখন আর অন্য কোনো উপায় থাকে না তখন বিজিগীষু রাজা দ্বৈতনীতি অনুসরণ করবেন অর্থাৎ শত্রুরাষ্ট্রের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে বন্ধুত্ব বজায় রেখে গোপনে তার বিরুদ্ধে বৈরী তৎপরতা চালাবেন।

কৌটিল্য কূটনীতি প্রয়োগের চারটি হাতিয়ারের উল্লেখ করেছেন: সাম (সন্তুষ্টি বিধান), দান (উপহার ও উৎকোচ প্রদান), ভেদ (বিভেদ সৃষ্টি) এবং দণ্ড (সামরিক শক্তি প্রয়োগ)। রাজা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ঐ চারটি হাতিয়ার শত্রুদের বশীভূত করার কাজে ব্যবহার করবেন। যে সকল রাজা শক্তিহীন, যুদ্ধক্লান্ত কিংবা মিত্রলাভে ইচ্ছুক বিজিগীষু রাজা তাদেরকে সাম ও দানের দ্বারা এবং শক্তিশালী রাজাদের বিভেদের বীজ বপন করে ও সামরিক শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে বশীভূত করবেন ।

তথ্যসূত্র

১. বায়েজীদ আলম, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃষ্ঠা ৩৮-৪০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!