গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদ কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিনির্ধারণ প্রণালী

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদ বা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বা অন্তর্দলীয় গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদ (ইংরেজি: Democratic centralism) হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সর্ববিধ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিনির্ধারণ প্রণালী। এটি মূলত কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালন ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনীতি ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি এবং তত্ত্ব।[১] ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাঁর কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে লেখায় কর্তৃত্বকে কেন্দ্রিকতাবাদ অর্থে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এঙ্গেলসের মতে জটিল যন্ত্রপাতির বিকাশের সাথে সাথে কেন্দ্রিকতাবাদের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আমরাও দেখি যান্ত্রিক বিকাশের সাথে সাথে কারখানা বা গবেষণাগার বা সংগঠনে কেন্দ্রিকতাবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।[২] 

বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী দেশে পার্টির সঙ্গে যুক্ত সহযোগী সংগঠন, যুব, শ্রমিক এবং অন্যান্য সংস্থার ক্ষেত্রেও এই কর্মপ্রণালী প্রযোজ্য। এই কর্মপ্রণালীর প্রবর্তন করেছিলেন ভি. আই. লেনিন। পার্টির ভিতরে রাজনৈতিক বিষয়ে অবাধ আলোচনা, কর্মকতা নির্বাচনে স্বাধীন সুযোগ, ক্রমোচ্চ স্তর বিন্যস্ত দলীয় কাঠামোয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা এই কর্মপ্রণালীর মূল বৈশিষ্ট্য।

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদ প্রসঙ্গে

শ্রেণিবিভক্ত সমাজ প্রবল শ্রেণির নেতৃত্ব এবং শাসনে পরিচালিত হয়। সেজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের সে সমাজে যথার্থ গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক উদ্যোগ থাকে না। শাসক এবং প্রবল শ্রেণির কেন্দ্রীকতাই তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক তথা শ্রেণিহীন সমাজে একদিকে যেখানে সমাজের সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রয়োজন, তেমনি সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত মানুষের সচেতন এবং সম্মতিসূচক অংশগ্রহণও আবশ্যক। এবং এ কারণেই কেন্দ্রীকতা এবং গণতন্ত্রের ভারসাম্য এবং সমন্বয় অপরিহার্য। এর যে কোনো একটি ব্যত্যয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নানা বিচ্যুতি এবং সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। এ দুটি উপাদানের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি যেমন উপলব্ধি করা আবশ্যক, তেমনি বাস্তব জীবনে উভয়ের প্রয়োগের চেষ্টা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মার্কসবাদীগণ লেনিনের এরূপ উক্তির উল্লেখ করেন যেখানে লেনিন বলেছেন “গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তর এবং ক্ষেত্রের উদ্যোগের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত এবং পরিচালনাকে সংযুক্ত করে সমাজের সামগ্রিক উন্নতি এবং বিকাশকে সম্ভব করে’।[১]

সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক বা কমিন্টার্নের (১৯১৯-৪৩) সময়ে এটা স্পষ্টই ছিল যে কমিউনিস্ট পার্টির কার্য নির্বাহ সার্থক ও সফল হতে পারে যদি তার সংগঠনে যথাসম্ভব কেন্দ্রীকতা থাকে এবং যদি লৌহকঠোর শৃঙ্খলা সবাই মেনে চলে, দলের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব সবার আস্থাভাজন হয় এবং তার অধিকার ও ক্ষমতা অটুট থাকে। কেন্দ্রীকতার অর্থ হলো কেন্দ্রীয় পার্টির হাতে যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকা এবং সর্বস্তরের যাবতীয় পরিবার, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের গঠন ও বিকাশের জন্য সেই সংগঠন বা পার্টির দায়ী থাকা।

কেন্দ্রিকতার অর্থ হলো পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে যাবতীয় ক্ষমতা ন্যস্ত থাকা, যাতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে সুস্থ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা যায়; কলকারখানা, স্কুল-কলেজ, পরিবার থেকে পুলিশি সংগঠন পর্যন্ত; এই বিধি ব্যবস্থায় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়া ও পরিচালনার জন্য দক্ষতাসম্পন্ন গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব নির্বাচন সহজ হয়। কেন্দ্রীকতা এই হিসাবে কিছুটা গণতন্ত্রসম্মত যে তা জনহিতার্থে ক্রিয়াশীল থাকে, যথা ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটায়, পার্টির মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বজায় রাখে, যার ফলে দলীয় কাঠামোর প্রতিটি স্তর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়। তবে যথার্থ কেন্দ্রীকতা ও যথার্থ গণতন্ত্রে দলের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের প্রয়োজনে প্রথমটির আধিপত্য বেশি। তা হলেও মোটামুটিভাবে অন্তর্দলীয় গণতন্ত্রে দলের কর্মপন্থা নির্ধারণ ও রূপায়ণে দলীয় সদস্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে।

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদ প্রণালীতে দলের অধীন সমস্ত ধরনের সংস্থা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়। সেগুলি দলের উচ্চতর সাংগঠনিক স্তরে নিয়মিত রিপোর্ট দাখিল করে। সদস্যদের সৃজনশীল কাজের উদ্যম, কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে সংখ্যালঘিষ্ঠের আনুগত্য প্রত্যাশা করা হয়। অর্থাৎ সংগঠনের উপরিস্থ কর্তৃত্বের সিদ্ধান্ত রূপায়িত করার দায়িত্ব থাকে নিম্নস্তরের সংগঠন ও দলীয় অন্যান্য সংস্থার উপর। এটাকেই বলা হয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা বা অন্তর্দলীয় গণতন্ত্র; সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার নীতি।

লেনিনের সুপারিশক্রমে সোভিয়েত ইউনিয়নে সরকারি কাজকর্মে নানা ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে যে পদ্ধতির প্রচলন হয় সোভিয়েত ও অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ওই পদ্ধতি অনুসরণ করে। তাতে পার্টির মধ্যে সর্ববিধ বিষয়ে অবাধ আলোচনা এবং পার্টির কর্মকর্তা নির্বাচনে অবাধ সুযোগ, একদলীয় রাষ্ট্র ও ক্রমোচ্চ পদবিন্যাসের কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলা বিধেয়। সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক বা কমিন্টার্নের সময় থেকেই স্থির হয় যে পার্টি তার কর্তব্য পালনে সমর্থ হবে যদি তার সাংগঠনিক কাঠামো যথাসাধ্য কেন্দ্রীভূত হয়, লৌহ কঠোর শৃঙ্খলা বজায় থাকে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সর্বস্তরের সদস্যদের আস্থাভাজন এবং শক্তি ও কর্তৃত্বসহ সর্বাঙ্গীণ ক্ষমতাশালী হয়। উল্লেখ্য, কমিন্টার্নের সদস্যপদের জন্য একুশ দফা শর্ত ছিল।

কেন্দ্রিকতার বিধিব্যবস্থা গণতান্ত্রিক, তার আংশিক কারণ হলো যে সেসবের মূলে থাকে জনস্বার্থ, কারণ উৎপাদনে ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করা হয়, অপর একটি কারণ হলো পার্টির মধ্যে অন্তর্দলীয় গণতন্ত্র, যেখানে তলা থেকে উপর পর্যন্ত সমস্ত পদ নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ হয়। মাও সেতুং পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার সঙ্গে জনগণের একটা সম্পর্ক স্থাপনে বিশ্বাস করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতা পরস্পরবিরোধী নয়। বরং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অঙ্গ হিসাবে বিরোধী দুটি সত্তার মধ্যে ঐক্যের এটি এক নিদর্শন বিশেষ।[৩]

দ্রষ্টব্য: গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদ

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৩০।
২. এই বিষয়ে বিস্তারিত পড়ুন, অনুপ সাদি, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদ প্রসঙ্গে, সমাজতন্ত্র, ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা ফেব্রুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা ৭৬-৮১।
৩. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১৮-১৯, ৯৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!