যুক্তফ্রন্টের সারবস্তু ও রূপ

জর্জি দিমিত্রভ
জর্জি দিমিত্রভ

বর্তমান পর্যায়ে যুক্তফ্রন্টের মৌল সারবস্তু (Basic Content) কি এবং কি হওয়া উচিত? শ্রমিক শ্রেণির বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থগুলি রক্ষা করা এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমেই পুঁজিবাদী দেশগুলিতে যুক্তফ্রন্টের যাত্রা শুরু ও তার প্রধান আধেয় হওয়া উচিত।

আমরা শুধুমাত্র সর্বহারার একনায়কত্বের সংগ্রামের আবেদনের মধ্যে আমাদের সীমাবদ্ধ রাখব না। আমরা জনগণের অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন থেকে উদ্ভুত এবং তাদের সংগ্রামী ক্ষমতার সঙ্গে সুসমঞ্জস শ্লোগান ও সংগ্রামের ধরণ খুঁজে বের করে নিশ্চয়ই সেগুলির প্রস্তাব তুলে ধরব।

ফ্যাসিবাদী বর্বরতা ও পুঁজিবাদী লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করতে জনগণের আজ অবশ্য করণীয় কি কি, আমরা তা নির্দেশ করব।

মেহনতি জনগণের অতীব প্রয়োজনীয় স্বার্থগুলি রক্ষার জন্য নানা মতের শ্রমিক সংস্থাগুলির যৌথ কর্মধারার মাধ্যমে ব্যাপকতম যুক্তফ্রন্ট গঠনের জন্য আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব। এর অর্থ হলো:

প্রথমত, সংকটের পরিণতিকে প্রকৃতপক্ষে শাসক শ্রেণিদের—পুঁজিবাদী ও ভূস্বামীদের কাঁধে এক কথায় ধনীদের কাঁধে স্থাপন করার জন্য যৌথ সংগ্রাম।

দ্বিতীয়ত, মেহনতি জনগণের অর্জিত সাফল্য ও অধিকারগুলি রক্ষার জন্য বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাগুলি হরণের ও সব রকমের ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রাম।

তৃতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের আসন্ন বিপদের বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রাম, যা সেই যুদ্ধের প্রস্তুতিকে ব্যাহত করবে।

অবস্থার পরিবর্তনের সংগে সংগ্রামের পদ্ধতি ও রূপে দ্রুত পরিবর্তন আনার জন্য আমরা নিশ্চয় নিরলসভাবে শ্রমিক শ্রেণিকে প্রস্তুত করব। আন্দোলন যতই অগ্রসর হবে এবং শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য দৃঢ় হবে আমরা আরও অগ্রসর হব এবং পুঁজির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার বদলে আক্রমণের প্রস্তুতি চালাব—উদ্দেশ্য হবে এক ব্যাপক রাজনৈতিক ধর্মঘটী সংগঠন। এই রকম ধর্মঘটের একটি নিশ্চিত শর্ত হবে নিজ নিজ দেশের প্রধান প্রধান ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে তার মধ্যে নিয়ে আসা।

কমিউনিস্টরা অবশ্যই এক মুহূর্তের জন্যও তাদের কমিউনিস্ট শিক্ষা, সংগঠন ও জনগণের ব্যাপক সমাবেশের যে স্বতন্ত্র স্বকীয় স্বাধীন কাজ তা পরিত্যাগ করতে পারে না এবং করা উচিত নয়। কিন্তু তবুও শ্রমিকদের কাছে ঐক্যবদ্ধ কর্মধারার পথ সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে একই সংগে সর্বহারার শ্রেণিশত্রুর বিরুদ্ধে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, শোধনবাদী ট্রেড ইউনিয়ন ও মেহনতি মানুষের অন্যান্য সংস্থাগুলির যৌথ কর্মধারার শর্ত সম্বলিত স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজন আছে। এই সব ক্ষেত্রেই স্থানীয় চুক্তির মারফৎ স্থানীয় সংগঠনের দ্বারা আঞ্চলিকভাবে জনগণের কর্মধারার বিকাশের ওপর প্রধান গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্তগুলিকে নিষ্ঠার সংগে পালন করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্ষমাহীনভাবে যুক্তফ্রন্টের শরিক কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার দ্বারা এই যৌথ কর্মপন্থার বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ চালাবার প্রয়াসকে জনসমক্ষে উন্মোচিত করব। চুক্তি ভংগ করার কোনো প্রচেষ্টার, যে ধরণের প্রচেষ্টার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, উত্তরে আমরা জনগণের কাছে আবেদন করব কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অক্লান্তভাবে বিচ্ছিন্ন যৌথ কর্মধারাকে পুনঃস্থাপনের সংগ্রাম চালিয়ে যাব।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুক্তফ্রন্টের বাস্তব রূপায়ন বিভিন্ন দেশ, সেখানকার শ্রমিক সংস্থাগুলির অবস্থা ও চরিত্র, তাদের রাজনৈতিক স্তর, বিশেষ বাস্তব পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতি, ভিন্নতা প্রভৃতি অনুসারে বিভিন্ন আকার ধারণ করবে।

যুক্তফ্রন্টের এই বিভিন্ন রূপের মধ্যে এইগুলি থাকতে পারে, যেমন: নির্দিষ্ট উপলক্ষে অথবা ব্যক্তিগত দাবিতে বা সাধারণ কর্মপন্থার (যুক্ত মোর্চার) ভিত্তিতে শ্রমিকদের সুসংহত মিলিত কর্মধারা যা এক একটি ঘটনায় চুক্তি দ্বারা স্থির করা হবে; পৃথক পৃথক শিল্প সংস্থায় অথবা সমগ্র শিল্পে সংহত কর্মধারা; স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক স্তরে সংহত কর্মধারা; শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সংগ্রাম সংগঠনের জন্য, জনগণের রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনার উদ্দেশ্যে, ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে যৌথ আত্মরক্ষা গড়ে তোলার জন্য সুসংহত কর্মধারা; রাজনৈতিক বন্দি ও তাদের পরিবারবর্গকে সাহায্যদানের জন্য ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে সংহত কর্মধারা: যুব ও নারী-সমাজের স্বার্থ রক্ষায় এবং সমবায় আন্দোলন, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ ও ক্রীড়া প্রভৃতির ক্ষেত্রে যৌথ কর্মধারা।

যৌথ কর্মধারার শর্ত সম্বলিত চুক্তি সম্পাদন করেই এবং যুক্তফ্রন্টের শরিক পার্টি ও সংস্থাগুলিকে নিয়ে যোগাযোগ রক্ষাকারী কমিটি গঠন করেই (যেমন ফ্রান্সে রয়েছে) সন্তুষ্ট থাকা আমাদের পক্ষে যথেষ্ট হবে না। সেটি কেবলমাত্র প্রথম পদক্ষেপ। যৌথ কর্মধারার রূপায়নে চুক্তি সম্পাদন হলো একটা পরিপূরক, এটা নিজে হতে কোনো যুক্তফ্রন্ট গঠন করে না। যৌথ কর্মধারা পরিচালনায় সাহায্যের জন্য কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্টদের নেতাদের মধ্যে একটি যোগাযোগ রক্ষাকারী কমিশনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু এইটি নিজে যুক্তফ্রন্টের প্রকৃত বিকাশের জন্য এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটানোর জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়।

কমিউনিস্ট এবং সমস্ত বিপ্লবী শ্রমিকরা কারখানায় কারখানায়, বেকার জনগণের মধ্যে, শ্রমজীবী অধ্যুষিত জেলাগুলিতে, সামান্য শহুরে লোকদের মধ্যে এবং গ্রামে গ্রামে যুক্তফ্রন্টের কোনো দলনিরপেক্ষ, নির্বাচিত (এবং ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বের দেশে যুক্তফ্রন্ট আন্দোলনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শরিকদের মধ্য থেকে মনোনীত) শ্রেণিসংস্থা গঠনের জন্য নিশ্চয়ই প্রচেষ্টা চালাবে। কেবলমাত্র এই ধরণের সংস্থাই যুক্তফ্রন্ট আন্দোলনে অসংগঠিত মেহনতি জনগণের ব্যাপক অংশকেও নিয়ে আসতে, পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জনগণের নিজস্ব উদ্যমের বিকাশে সাহায্য করতে সমর্থ হবে এবং এর ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদী দেশগুলিতে হাজার হাজার নির্দল বলশেভিককে শিক্ষিত করতে যুক্তফ্রন্টের প্রয়োজনীয় সক্রিয় অসংখ্য কর্মী গড়ে তুলতে সমর্থ হবে।

আরো পড়ুন

সংগঠিত শ্রমিকদের যৌথ কর্মধারাই হচ্ছে সূচনা ও ভিত্তি। আমাদের ভুললে চলবে না যে, অসংগঠিত জনগণ নিয়েই শ্রমিকদের বৃহত্তর অংশ গঠিত। তাই ফ্রান্সে সংগঠিত শ্রমিক — কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট ও ও বিভিন্ন ঝোঁকের ট্রেড ইউনিয়ন সভ্যদের সংখ্যা সব মিলিয়ে দশ লক্ষ, কিন্তু শ্রমিকদের মোট সংখ্যা হলো এক কোটি দশ লক্ষ। গ্রেট ব্রিটেনে বিভিন্ন ঝোঁকের ট্রেড ইউনিয়ন ও পার্টির সদস্য আছে প্রায় ৫০ লক্ষ, কিন্তু শ্রমিকদের সর্বমোট সংখ্যা হলো ১ কোটি ৪০ লক্ষ । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কেবলমাত্র ৫০ লক্ষ শ্রমিক সংগঠিত, যেখানে সেদেশে সর্বমোট ৩ কোটি ৮০ লক্ষ শ্রমিক রয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশেই এই একই রকম অনুপাতের হার বর্তমান রয়েছে। “স্বাভাবিক সময়ে’” এই বৃহৎ জনতা রাজনৈতিক জীবনে প্রধানত অংশগ্রহণ করে না। কিন্তু বর্তমানে এই বিশাল জনসমষ্টির মধ্যে ক্রমবর্ধিত হারে গতিবেগ সঞ্চারিত হচ্ছে, রাজনৈতিক জীবনে তারা অংশগ্রহণ করছে এবং রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করছে। ব্যাপক জনসমষ্টির সাধারণ স্তরে যুক্তফ্রন্টকে কার্যকরী, প্রসারিত ও শক্তিশালী করার সর্বোত্তম উপায় হলো কোনো বিশেষ দলনিরপেক্ষ শ্রেণি সংগঠন গড়ে তোলা। এই সংগঠনগুলি অনুরূপভাবে যুক্তফ্রণ্ট-বিরোধীদের দ্বারা শ্রমিক শ্রেণির প্রতিষ্ঠিত ঐক্যবদ্ধ কর্মধারাকে চূর্ণ করার প্রতিটি প্রচেষ্টার পথে সুদৃঢ় প্রাচীর রচনা করবে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!