সাম্যবাদ মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের সর্বোচ্চ সামাজিক স্তর

কার্ল মার্কসফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের স্পষ্ট পার্থক্যরেখা আঁকেননি, এমনকি তাঁরা সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের জন্য কোনো রকমের কল্পনারও আশ্রয় নেননি। তাঁরা সমাজতন্ত্রকে বহুক্ষেত্রে সাম্যবাদ হিসেবেই দেখেছেন। সমাজতন্ত্রকে মধ্যবর্তী একটা উৎপাদনব্যবস্থা হিসেবে দেখেননি। তাঁরা দেখিয়েছেন যে পুঁজিবাদের স্বাভাবিক অনিবার্য উত্তরণ ঘটবে এবং পুঁজিবাদকে বাতিল করে সেই প্রক্রিয়াকে পরিচালিত করবে প্রলেতারিয়েত শ্রেণি। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে ক্রমাগত সমাজরূপেরও পরিবর্তন ঘটবে। ক্রমাগত সমস্ত কাজ সামাজিকভাবে সাধিত হবে এবং প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে রাষ্ট্রের। এটাই হলো সাম্যবাদের স্তর যা পুঁজিবাদ পরবর্তী নতুন সমাজব্যবস্থা।

সাম্যবাদ হচ্ছে সাচ্চা আর পূর্ণ মানবতার সমাজ, যেখানে থাকে সমস্ত মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ ও সম্ভাবনা। এই সমাজে বৈষয়িক-প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে বৈষয়িক ও সৃজনশীল সম্পদের প্রাচুর্যের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। সাম্যবাদী সমাজ পরিকল্পনা ভিত্তিক সামাজিক উৎপাদনের সর্বোচ্চ স্তর এবং এই সমাজে শ্রম-উৎপাদনশীলতার সর্বোচ্চ হার অর্জন করা সম্ভব হবে। সাম্যবাদী সমাজে সমাজতান্ত্রিক সমাজের বণ্টনের মূলনীতি ‘প্রত্যেকের কাছ থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী, প্রত্যেককে শ্রম অনুযায়ী’ নীতিটির জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে সাম্যবাদী সমাজের বণ্টনের মূলনীতি ‘প্রত্যেকের কাছ থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী, প্রত্যেককে তার চাহিদা অনুযায়ী’। অর্থাৎ যতটুকু শ্রম ততটুকুই প্রাপ্তি থেকে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু প্রাপ্তির পর্যায়ে মানবসমাজ প্রবেশ করবে। মানুষের আত্মবিচ্ছিন্নতার অবসান হবে। সম্ভব হবে মানুষের সামগ্রিক ক্ষমতার স্ফুরণের। সাম্যবাদে শ্রেণি বিরোধের নিস্পত্তি হবে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি অনাবশ্যক হবে এবং সমাধান হবে বৈষম্যমূলক শ্রম বিভাজনের। লোকজনের সম্পূর্ণ সামাজিক সমতায় সমাজ হয়ে উঠবে শ্রেণিহীন।

সাম্যবাদ অর্থ কোনো গাণিতিক সাম্য নয়। মানসিক ও কায়িক শ্রমের ফসল হিসেবে সমাজের যে উৎপন্ন সম্পদ সৃষ্ট হয় তা যাতে সমপরিমাণ শ্রমের সাথে সম্পর্কিত হয় তাই হচ্ছে সাম্যবাদ। জন্মগত, অবস্থানগত, রাজনৈতিক ক্ষমতাগত প্রভৃতি যে সমস্ত বৈষম্য বর্তমান তা যাতে যোগ্যতার সাথে সম্পর্কিত হয় সেইটাই হচ্ছে সাম্যবাদ। প্রতিভা, দক্ষতা, কর্মক্ষমতা প্রভৃতিতে অবশ্যই মানুষে মানুষে তারতম্য থাকে। এসব হচ্ছে যোগ্যতা, সুযোগ ও চেষ্টার ফল এবং বিশেষ প্রক্রিয়ায় অর্জিত। এগুলো প্রাকৃতিক কোনো স্বাভাবিক বৈষম্য নয়। অথচ দীর্ঘদিন তেমন দেখাটাই অভ্যাসে পরিণত হয়।

শোষণ হচ্ছে সাম্যবাদের বিরুদ্ধে এক অবস্থান। শোষণের থাকলে সাম্যবাদ আসতে পারে না। আর সাম্যবাদ আসতে হবে গোটা দুনিয়ায়। ফলে শোষণমূলক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হচ্ছে সাম্যবাদের বিরুদ্ধে। তাই ব্যক্তির উপর থেকে শোষণ যত কমবে, এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রকে শোষণও তত কমবে। মার্কস এঙ্গেলস লিখেছেন,

“যে পরিমাণে ব্যক্তির উপর অন্য ব্যক্তির শোষণ শেষ করা যাবে, সেই অনুপাতে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির শোষণটাও বন্ধ হয়ে আসবে। যে পরিমাণে জাতির মধ্যে শ্রেণিবিরোধ শেষ হবে, সেই অনুপাতে এক জাতির প্রতি অন্য জাতির শত্রুতাও মিলিয়ে যাবে।”[১]

পুঁজিবাদে মানুষের সব প্রবৃত্তি, মেধা, ঝোঁক মরে যেতে থাকে, থাকে শুধু একটি জিনিস, আর সেটি হচ্ছে মুনাফা। মানুষ তার নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং নিছক উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হতে থাকে। পুঁজিপতি একটি ধাতুখণ্ডের সৌন্দর্য দেখে না, ভাবে তার বাজার দর কত।[২] তার বিপরীতে সাম্যবাদ হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রকৃত অবসান। সাম্যবাদেই মানুষের দেখা বৈষম্যবাদী ইতিহাসের ধাঁধাঁর অবসান ঘটবে। কার্ল মার্কসের মতে সাম্যবাদ হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রথম ইতিবাচক বিলোপ ঘটিয়ে মানুষের আত্মবিচ্ছিন্নতার উচ্ছেদ এবং এইভাবে প্রকৃত মানব প্রকৃতির স্ফুরণ, সত্যিকারের সামাজিক মানবিক সত্ত্বা হিসেবে মানুষের নিজের কাছে নিজের সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন। এই প্রত্যাবর্তন হচ্ছে অতীতের বিকাশের সমস্ত সম্পদকে আলিঙ্গন করে সচেতনভাবে সম্পাদিত প্রত্যাবর্তন। মার্কস আরো লিখেছেন,

“পরিপূর্ণ বিকশিত প্রকৃতিবাদ হিসেবে এই সাম্যবাদ মানবতাবাদের সমান আর পরিপূর্ণ বিকশিত মানবতাবাদ সমান প্রকৃতিবাদ। এটি হলো মানুষ এবং প্রকৃতি আর মানুষের সাথে মানুষের মাঝের দ্বন্দ্বের নিখাদ সমাধান। এটি হলো অস্তিত্ব ও সারমর্ম, জিনিসকরণ ও আত্মনির্ধারণ, মুক্তি ও প্রয়োজনীয়তা, ব্যক্তিস্বতন্ত্র ও প্রজাতির মধ্যকার সংঘাতের সত্যিকারের সমাধান। সাম্যবাদ হলো ইতিহাসের ধাঁধাঁর সমাধান আর তা নিজেও জানে যে সে এই সমাধান।[৩]

ব্যক্তিগত ক্ষমতার সার্বিক চর্চার পরিবেশ কেবলমাত্র সাম্যবাদী সমাজেই সম্ভব। সাম্যবাদী সমাজে জীবনের প্রাথমিক চাহিদারূপে, সমাজের কল্যাণার্থে উপলব্ধ প্রয়োজনরূপে লোকে বিনা পারিশ্রমিকে কমিউনিস্ট শ্রম করতে শুরু করবে এবং তাঁরা জনগণের জন্য সর্বাধিক হিতসাধনে প্রত্যেকের সামর্থ্যের সদ্ব্যবহার করবে। সাম্যবাদে সমাজ চলবে সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে সমাজের সব কাজ ও সামাজিক জীবনের সব ক্ষেত্র পরিচালনায় সচেতন কর্মীর স্বাধীন ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন। লোকজনের কল্যাণ ও সর্বমুখী সুষম বিকাশ পরিণত হবে খোদ কমিউনিস্ট সমাজের অস্তিত্ব ও বিকাশের লক্ষ্য।

সাম্যবাদে সমাজের শ্রেণি বিভাজন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তির ফলে সমাজের সব লোকের সম্পূর্ণ সামাজিক সমতা বাস্তবে রূপলাভ করবে। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ পুঁজির সার্বভৌমত্বের মধ্যে বসবাস করে। ফলে মানুষের স্বাধীনতা বিসর্জিত হয়। পুঁজিবাদে মানুষের অস্তিত্ব হয়ে ওঠে পুঁজির আত্মস্ফীতির জন্য। মানুষের জীবন হয়ে ওঠে পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা বৃদ্ধির জন্য। মার্কস পুঁজিবাদের বিপরীতে সাম্যবাদী সমাজের মধ্যে ব্যক্তির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন ব্যক্তির সম্প্রদায়গত সম্মিলনীর মধ্যে। মার্কস পুঁজিকে বলেন পুঞ্জিভূত শ্রম [stored-up labour] বা মৃত শ্রম। পুঁজিবাদী সমাজে এই মৃত শ্রম বা পুঁজি, যা হলো অতীত, আধিপত্য করে বর্তমানের উপর।[৪] সাম্যবাদী সমাজে বর্তমানই অতীতকে তুলে ধরে। মার্কস এঙ্গেলস লিখেছেন,

“বুর্জোয়া সমাজে জীবন্ত পরিশ্রম পূর্বসঞ্চিত পরিশ্রম বাড়াবার উপায়মাত্র। সাম্যবাদী সমাজে কিন্তু পূর্বসঞ্চিত পরিশ্রম শ্রমিকের অস্তিত্বকে উদারতর, সমৃদ্ধতর, উন্নততর করে তোলার উপায়।

সুতরাং বুর্জোয়া সমাজে বর্তমানের উপর আধিপত্য করে অতীত; সাম্যবাদী সমাজে বর্তমান আধিপত্য করে অতীতের উপর। বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি হলো স্বাধীন, স্বতন্ত্রসত্তা, কিন্তু জীবন্ত মানুষ হলো পরাধীন, স্বতন্ত্র সত্তাবিহীন।”[৫]

সাম্যবাদী বিপ্লব হলো প্রচলিত ধ্যানধারণার সাথে বিরাট বিচ্ছেদ। সাম্যবাদ এলেই পূর্ববর্তী অনেক ধারণারই বদল হবে, অবলুপ্তি ঘটবে। সমাজতান্ত্রিক স্তরের রাষ্ট্রীয় ও সমবায়ী মালিকানার বিপরীতে সাম্যবাদে গড়া হবে এক অখণ্ড সর্বজনীন মালিকানা। সাম্যবাদে থাকবে না কোনো পণ্য-অর্থ সম্পর্ক, সমাজ হবে শ্রেণিহীন, শহর ও গ্রাম, মানসিক ও কায়িক শ্রমের মধ্যকার বিশেষ পার্থক্যগুলো, লোকজনের মধ্যে বিরাজমান সামাজিক অসমতার শেষ জেরগুলো উধাও হয়ে যাবে। মানুষের চেতনা, আচার আচরণ, জীবনযাত্রা হবে ব্যক্তিগত মালিকানার মনোভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার উল্লেখ করেছে,

“সাম্যবাদী বিপ্লব হলো চিরাচরিত সম্পত্তি সম্পর্কের সঙ্গে একেবারে আমূল বিচ্ছেদ; এই বিপ্লবের বিকাশে যে চিরাচরিত ধারণার সংগেও একেবারে আমূল একটা বিচ্ছেদ নিহিত, তাতে আর আশ্চর্য কি।”[৬]

সাম্যবাদে কাজ আর জীবিকার্জনের উপায়মাত্র নয়, কাজ তখন হয়ে দাঁড়ায় জীবনের পক্ষে অত্যাবশ্যক। সমাজের সবাই তখন পূর্ণবিকশিত ব্যক্তি, অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তি, নীতিজ্ঞান, শ্রেয়বোধ আর শরীরের দিক থেকে বিকশিত ব্যক্তি। প্রত্যেকের অবাধ সর্বাঙ্গীণ বিকাশ তখন সমাজের প্রধান লক্ষ্য। সাম্যবাদী সমাজ হলো স্বশাসিত সম্মিলনী বা ঐক্যবদ্ধ মুক্ত মানুষের সমাজ। সাম্যবাদে প্রত্যেকের মুক্ত অবস্থান হবে সকলের মুক্ত অবস্থানের শর্ত। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে মার্কস এঙ্গেলস উল্লেখ করেছেন,

“শ্রেণি ও শ্রেণিবিরোধ সংবলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নেবে এক সমিতি যার মধ্যে প্রত্যেকটি লোকেরই স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত।”[৭]

মার্কস ও এঙ্গেলস সাম্যবাদের আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে পুঁজিবাদী আত্মকেন্দ্রিক সমাজ, স্বার্থপরতা, বৈরিতা ও বিভেদপূর্ণতার সমালোচনা করে এর বিপরীতে যৌথ সামাজিক জীবন [Community life] ও মানবিক সম্মিলনের কথা বলেন। মানুষকে প্রজাতি বন্ধনে সম্পর্কিত করা ও সহযোগিতার মূল্যবোধের [Cooperation] কথা বলেন। উৎপাদন ও বণ্টনের উপর মানুষের যৌথ নিয়ন্ত্রণ ও মানবিক অনুভূতি ও গুণাবলিকে নৈর্বক্তিক ও আত্মগতভাবে মানবিক হয়ে ওঠার কথা বলেন। এ থেকে স্পষ্ট যে, পুঁজিবাদকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যে যৌথ সামাজিক জীবন, সহযোগিতা বা সহমর্মিতা ও মানবিক নৈতিকতাবোধ ক্রিয়াশীল ছিলো। মার্কস ও এঙ্গেলস কমিউনিজমে সমৃদ্ধ মানব সত্তা ও সমৃদ্ধ মানব আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ঘটার কথা বলেন। শোষণ অবসানের মধ্য দিয়ে ‘মানুষ নিজেই নিজের উদ্দেশ্য’ হবে মনে করেন, ব্যক্তি মানুষের ঐতিহাসিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক উত্থানের কথা বলেন। কমিউনিজমে শ্রেণি অবসানের মধ্য দিয়ে মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটবে, শুরু হবে প্রকৃত মানুষের ইতিহাস।[৮]

অর্থনীতিবিদ যদি হয় বুর্জোয়া সমাজের বৈজ্ঞানিক প্রতিনিধিত্বকারী, সমাজতন্ত্রী বা সাম্যবাদীরা হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রলেতারিয় শ্রেণির তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী। সাম্যবাদী সমাজে যে কেউ যে কোনো কাজের সামর্থ্য অর্জন করবে। এই সমাজে নরনারী সর্বাঙ্গীণ উন্নতি লাভে সমর্থ হয়, তাঁদের শিক্ষা হয় সর্বব্যাপী এবং তাঁরা সব রকম কাজ করার উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। সমাজের সাম্যবাদী স্তরে কাজ করার জন্য অন্য কোনো আকর্ষণ বা পুরষ্কারের প্রয়োজন হবে না। কারণ এ সমাজে লোকজনের পক্ষে সামাজিক অগ্রগতির কাজে নিজ নিজ অবদান দেয়া ছাড়া অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না। সাম্যবাদে পেশাগত পরিচয়ের প্রয়োজন থাকবে না। সাম্যবাদে শ্রম জীবনরক্ষার শর্ত হবে না, তা হবে জীবনের ওতপ্রোত অংশ। কার্ল মার্কস লিখেছেন,

“কমিউনিস্ট সমাজের উচ্চতর স্তরে, শ্রমবিভাগের কাছে ব্যক্তির দাসোচিত বশ্যতার এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে দৈহিক ও মানসিক শ্রমের পারস্পরিক বৈপরীত্যের যখন অবসান ঘটেছে; শ্রম যখন আর কেবল জীবন ধারণের উপায় মাত্র নয়, জীবনেরই প্রাথমিক প্রয়োজন হয়ে উঠেছে; যখন ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন শক্তিও বেড়ে গেছে এবং সামাজিক সম্পদের সমস্ত উৎস অঝোরে বইছে_ কেবল তখনই বুর্জোয়া অধিকারের সংকীর্ণ দিগন্তরেখাকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করা সম্ভব হবে, সমাজ তার কেতনে মুদ্রিত করতে পারবে_ প্রত্যেকে দেবে তার সাধ্য অনুসারে, প্রত্যেকে পাবে তার প্রয়োজনমতো।”[৯]

সাম্যবাদী সমাজ বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ায় উৎপাদন আর ভোগ-ব্যবহার সংগঠিত করে। অর্থনৈতিক নিয়মাবলী সম্বন্ধে জ্ঞান প্রয়োগ করে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, পরিকল্পনা অনুসারে অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটায় সকলের মঙ্গলের জন্য। ফলে এই সমাজে মানুষ প্রয়োজনের রাজ্য থেকে স্বাধীনতার রাজ্যে নিজেদের উল্লম্ফন ঘটাতে সক্ষম হবে। মানুষ উৎপাদনের উন্নয়ন ঘটাবে সচেতনভাবে আকাঙ্ক্ষা অনুসারে সকলের মঙ্গলের জন্য, ফলে মানুষ প্রথম হয়ে উঠবে প্রকৃতির সত্যিকার সচেতন মনিব। সাম্যবাদে তাই শ্রম বিরক্তির বিষয় না হয়ে হবে আনন্দের বিষয়। এঙ্গেলস লিখেছেন,

“… পুরনো উৎপাদন পদ্ধতিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিপ্লবায়ন করতে হবে, এবং বিশেষভাবে, পুরনো শ্রমবিভাজনকে বিদায় নিতে হবে। এর স্থান নিতেই হবে এমন একটি উৎপাদন-সংগঠনকে যেখানে, একদিকে, কোনো ব্যক্তি উৎপাদিকা শ্রমে তার নিজের অংশ অন্যের ওপর চাপাতে পারে না_ মানবিক অস্তিত্বের এক স্বাভাবিক অবস্থাকে, এবং যেখানে, অপরদিকে, উৎপাদিকা শ্রম, মানুষকে বন্দি করার সহায়ক না হয়ে, তাদের মুক্তির উপায়ে পরিণত হবে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে সকল দিকে তার সকল শারীরিক ও মানসিক বৃত্তির বিকাশসাধনের এবং সম্পূর্ণ অনুশীলনের সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে_ যেভাবে, সুতরাং, উৎপাদিকা শ্রম বোঝা না হয়ে হবে আনন্দ।”[১০]

সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ কোনো একক একক মস্তিষ্কের আবিষ্কার নয়। এটি হচ্ছে ইতিহাসের অনিবার্য এগিয়ে চলার ফলশ্রুতি। সমাজতন্ত্র হচ্ছে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের অনিবার্য শ্রেণিসংগ্রামের আবশ্যিক পরিণাম। মার্কসবাদ দেখাতে সক্ষম হলো কীভাবে শোষণ ঘটে এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের আবিষ্কারের ফলে পুঁজিবাদের অনিবার্য পতনের পথও মার্কসবাদ দেখালো। শ্রেণি বিভাজনে মানুষ যে তার অখণ্ড সত্তাকে হারিয়েছে, সাম্যবাদেই মানুষ সেই পরিচয়কে ফিরে পাবে। কার্ল মার্কস লিখেছেন,

“নেতিকরণের নেতিকরণ হিসেবে কমিউনিজম হলো সদর্থক ধরন আর তাই তা সেই বাস্তব স্তর যা প্রয়োজন মানব মুক্তি এবং পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াতে ঐতিহাসিক বিকাশের পরবর্তী স্তরের জন্য। কমিউনিজম হলো তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতের আবশ্যকীয় আঙ্গিক এবং গতিশীল নীতি, কিন্তু এমন কমিউনিজম মানব বিকাশের লক্ষ্য, মানব সমাজের আঙ্গিক নয়।”[১১]

সাম্যবাদ হলো সামাজিক প্রগতির সর্বোচ্চ ধরন যা মানুষের কল্যাণে সমাজের সীমাহীন আত্মোন্নতির নিশ্চয়তা দেয়। ইতিহাসের বস্তুবাদী উপলব্ধি অনুসারে সাম্যবাদী গঠন ব্যবস্থা হচ্ছে মানবজাতির সর্বশেষ ধরন এবং তার পরবর্তী বিকাশ ঘটবে সেই সমাজের নিজস্ব পরিসরে। সাম্যবাদী সমাজে সমস্ত উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা মানবজাতির এক বিপুল সমিতির হাতে কেন্দ্রীভূত হবে, রাষ্ট্র পুরোপুরি শুকিয়ে মরবে, অর্থাৎ তখন সরকারি [public] কার্যকলাপের রাজনৈতিক চরিত্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে আর তা পরিণত হবে সমাজের প্রকৃত স্বার্থ দেখাশোনা করার সরল ব্যবস্থাপনায়[১২]। 

সাম্যবাদ ব্যক্তিকে ব্যাপক সামাজিক স্বাধীনতা দেয়। এতে রয়েছে কমিউনের সংস্থাগুলিতে নির্বাচিত হওয়ার ও নির্বাচন করার এবং সমাজের প্রশাসনে অংশগ্রহণের অধিকার; শিক্ষা, বিশ্রাম, বিনোদন ও ছুটির অধিকার; বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজের সুযোগ সুবিধা। সাম্যবাদ ব্যক্তিকে সংস্কৃতির সকল ফলভোগের সুযোগসহ বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় সক্রিয় অবদান যোজনে সাহায্য করে। সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তির পক্ষে সমাজবহিস্থ জীবন অকল্পনীয়, এখানে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের জন্য, তার ক্ষমতার অভিব্যক্তি ও বিকাশের জন্য অনুকূল অবস্থা বিদ্যমান থাকে। স্বাধীনতার নিশ্চয়তাসহ মানুষের সার্বিক বিকাশের যাবতীয় শর্ত সৃষ্টির মাধ্যমে কমিউনিজম কার্যত প্রলেতারীয় মানবতাবাদের বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ করে।[১৩]

তথ্যসূত্র

১. মার্কস এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৪৮, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৪
২. কার্ল মার্কস, ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস ১৮৪৪, ইংরেজি সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৮৮
৩. কার্ল মার্কস, ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস ১৮৪৪, জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৮
৪. আখতার সোবহান খান, মার্কসবাদ ও ন্যায়পরতার ধারণা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৫৮-১৫৯
৫. মার্কস এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৪৮, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪০
৬. মার্কস এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৪৮, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৫
৭. মার্কস এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৪৮, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৬
৮. আখতার সোবহান খান, মার্কসবাদ ও ন্যায়পরতার ধারণা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৭৭
৯. কার্ল মার্কস, গোথা কর্মসূচির সমালোচনা, ১৮৭৫, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ, দ্বিতীয় খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১৮
১০. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, এ্যান্টি ডুরিং, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ৬৪
১১. কার্ল মার্কস, ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস ১৮৪৪, জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৯৮
১২. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ, প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৩১২
১৩. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ১৩৫-১৪৩ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরে ডট কমে ৩১ আগস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত। সেখান থেকে লেখাটি ১৩ জুলাই ২০২২ তারিখে ফুলকিবাজ ডট কমে পুনরায় প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ১৫ জুলাই ২০১৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!