সিনোদ সংক্রান্ত প্রাক্কলন নিয়ে, তারপর যাঁরা যাজকমণ্ডলী ছেড়ে গেছেন তাঁদের অধিকার পুনঃস্থাপন প্রসঙ্গে, আর শেষে সনাতনী-ধর্মবিশ্বাসী[১] সম্প্রদায়গুলি সম্বন্ধে দুমা-য় বিতর্ক থেকে খুবই তথ্যপূর্ণ মালমশলা পাওয়া গেছে, যা ধর্ম আর যাজনতন্ত্রের প্রতি রাশিয়ার রাজনীতিক পার্টিগুলির মনোভাবের বিশেষক। এই মালমশলার একটা সাধারণ সমীক্ষা করা যাক, এতে বিচার-বিবেচনা করা হচ্ছে প্রধানত সিনোদ সংক্রান্ত প্রাক্কলন নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে (উল্লিখিত অন্যান্য প্রশ্নে বিতর্কের হুবহু বিবরণী আমরা এখনও পাই নি)।
দুমা-র বিতর্ক থেকে প্রথম এবং সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে-সিদ্ধান্ত দেখা দিচ্ছে সেটা এই যে, জঙ্গী ক্লেরিকালিজম রাশিয়ায় আছে শুধু তাই নয়, অধিকন্তু সেটা এগোচ্ছে, অপেক্ষাকৃত সংগঠিত হয়ে উঠছে। ১৬ এপ্রিল বিশপ মেত্রফানেস বলেন: ‘দুমা-য় আমাদের ক্রিয়াকলাপের প্রথম-প্রথম পদক্ষেপগুলির সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল আমরা যারা জনগণের ভোট পেয়ে সম্মানিত হয়েছি তাদের উচিত এখানে দুমা-য় পার্টিগত ভেদ-বিভেদের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে পাদরিদের একটামাত্র গ্রুপ গড়া, সেটা তথ্যাদি দিয়ে সমস্ত বিষয় স্পষ্ট করে তুলবে সেটার নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। … এই আদর্শ অবস্থান হাসিল করতে আমরা অপারগ হলাম তার কারণটা কী?… আপনাদের সঙ্গে’ (অর্থাৎ কাদেত আর ‘বাম’দের সঙ্গে) ‘যাঁরা আসন ভাগাভাগি করে নিয়েছেন, দোষটা তাঁদের, অর্থাৎ যেসব যাজক ডেপুটি প্রতিপক্ষের অন্তর্ভুক্ত। সর্বপ্রথমে তাঁরাই গলা চড়িয়ে বলেছিলেন সেটা হতো, ক্লেরিকাল পার্টির উদ্ভব, তার চেয়ে বেশিও নয়, কমও নয়, আর সেটা অত্যন্ত অবাঞ্ছনীয়। রাশিয়ার অর্থোডক্স যাজকমণ্ডলীতে ক্লেরিকালিজম বলে কিছু নেই নিশ্চয়ই – অমনতর প্রবণতা আমাদের কখনও ছিল না, একটা পৃথক গ্রুপ গড়তে চেয়ে আমরা চলছিলাম স্রেফ নীতিবিদ্যা আর নৈতিকতার লক্ষ্য অনুসারে । কিন্তু ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের ভাই-ভাই ভাবের মধ্যে বাম ডেপুটিদের আমদানি-করা অমিলের ফলে যখন এলো অনৈক্য আর বিভাগ তখন আপনারা’ (অর্থাৎ কাদেতরা) ‘তার জন্যে দোষ দিচ্ছেন আমাদের’।
বিশপ মেত্রফানেস তাঁর অশিক্ষিত বক্তৃতাটায় ফাঁস করে বসেছেন গোপন কথাটা: আরে দেখছ না, এটা বামদের দোষ, তারা দুমা-র কিছু-কিছু পাদরিকে বিশেষ ‘নৈতিক’ (মানুষকে ভাঁওতা দেবার জন্যে এই অভিধাটা স্পষ্টতই ‘ক্লেরিকাল’ শব্দটার চেয়ে উপযোগী) গ্রুপ গড়া থেকে বুঝিয়ে বিরত করেছে!
প্রায় একমাস পরে, ১৩ মে বিশপ ইউলোগিয়াস দুমা-য় পড়েন ‘দুমা-য় পাদরিদের প্রস্তাব’: ‘দুমা-য় অর্থোডক্স পাদরিদের বিপুল সংখ্যাগুরু অংশের বিবেচনায়’ … ‘অর্থোডক্স যাজনতন্ত্রের অগ্রণী এবং প্রাধান্যশালী অবস্থানে’র স্বার্থে সনাতনী-ধর্মবিশ্বাসীদের ধর্মোপদেশ প্রচারের স্বাধীনতা, কিংবা সনাতনী- ধর্মবিশ্বাসীদের সম্প্রদায়গুলির অননুমত ক্রিয়াকলাপ, কিংবা সনাতনী-ধর্মীবিশ্বাসী পাদরিদের যাজক উপাধি ব্যবহার, এর কোনটাই চলতে দেওয়া যায় না। রাশিয়ার যাজকদের ‘স্রেফ নৈতিক দৃষ্টিকোণ’ হলো নিছক ক্লেরিকালিজম সেটা পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়ে গেল। দুমা-য় যাজকদের যে-‘বিপুল সংখ্যাগুরু অংশের’ তরফে বলেছেন বিশপ ইউলোগিয়াস সেটা সম্ভবত তৃতীয় দুমা-র ২৯ জন দক্ষিণপন্থী এবং পরিমিত দক্ষিণপন্থী যাজকদের নিয়ে, আর সম্ভবত সেটার মধ্যে আরও পড়েন অক্টোবরিদের দলের[২] আরও ৮ জন যাজক। প্রগতিবাদী[৩] আর শান্তিপূর্ণ নবীকরণ[৪] গ্রুপ-দুটোর ৪ জন যাজক, আর পোলিশ-লিথুয়ানীয় গ্রুপের একজন বোধহয় শামিল হয়েছিলেন প্রতিপক্ষে।
আরো পড়ুন
- অগাস্ট কোঁত দৃষ্টবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী সমাজতত্ত্বের প্রবর্তক
- ফেবিয়ানবাদ বা ফেবিয়ান সমিতি হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী সমিতি
- জাতীবি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষের আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ২০২০ সালের প্রশ্নপত্র
- প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিরোধী হিসাবে নির্বাচিত ব্যক্তি চালিত
- স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মিলের ধারণা হচ্ছে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা সমস্যার সমাধান
- উপযোগবাদ হচ্ছে আদর্শগত নীতিশাস্ত্রের তত্ত্বের একটি গুচ্ছ
- জন স্টুয়ার্ট মিলের রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে উপযোগবাদ, উদারনীতিবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র
- জন স্টুয়ার্ট মিল উনিশ শতকের ইংল্যান্ডের দার্শনিক, যুক্তিবিদ এবং অর্থনীতিবিদ
- সুখবাদ মানুষের সর্বোচ্চ মঙ্গলার্থক শব্দ হিসাবে নীতিশাস্ত্রের একটি মতবাদ
- আনন্দবাদ এমন এক চিন্তাধারা যাতে সকল আনন্দ কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে
- জেরেমি বেনথাম ছিলেন ইংরেজ দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সংস্কারক ও আইনবিদ
- স্বাধীনতা সম্পর্কে মন্টেস্কুর ধারণা দ্য স্পিরিট অফ ল গ্রন্থের স্বাধীনতার আলোচনা
- ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি হচ্ছে মন্টেস্কুর আইন, শাসন ও বিচার ক্ষমতার পৃথকীকরণ
- মন্টেস্কুর আইনতত্ত্ব হচ্ছে দ্য স্পিরিট অব লজ গ্রন্থে প্রদত্ত আইনের ব্যাখা
- মন্টেস্কুর রাষ্ট্রচিন্তা যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সংমিশ্রণে গড়া সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতি
‘দুমা-য় পাদরিদের বিপুল সংখ্যাগুরু অংশের স্রেফ নৈতিক এবং নীতি বিদ্যাগত দৃষ্টিকোণ’টা তাহলে কী (আরও বলা দরকার, সেটা হলো তেসরা-জুনের দুমা)[৫]? বিভিন্ন বক্তৃতা থেকে কয়েকটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি: ‘আমার মোদ্দা কথাটা হলো এই যে, এইসব (অর্থাৎ যাজনতন্ত্রে) সংস্কারের উদ্যম আসা চাই যাজনতন্ত্রের ভিতর দিয়ে, বাইরে থেকে নয়, রাষ্ট্র থেকে নয়, আর বাজেট কমিশন থেকে নয় নিশ্চয়ই। যা-ই হোক, যাজনতন্ত্র হলো স্বর্গীয় এবং চিরন্তন প্রতিষ্ঠান, এর নিয়মাবলি অপরিবর্তনীয়, যেখানে আমাদের জানা আছে রাষ্ট্রীয় জীবনের আদর্শগুলির অদলবদল হতে পারে অবিরাম’ (বিশপ ইউলোগিয়াস, ১৪ এপ্রিল)। বাগ্মীটি ‘ইতিহাস থেকে একটা উদ্বেগজনক তুলনা’ স্মরণ করেন: ২য় ক্যাথারিনের[৬] আমলে যাজনতন্ত্রের সম্পত্তি লোকায়তকরণ। ‘কে জোর দিয়ে বলতে পারে যে-বাজেট কমিশন এই বছর সেটাকে (যাজনতন্ত্রের সম্পত্তি) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন করার কামনা প্রকাশ করেছে সেই কমিশন আগামী বছর সেটাকে রাজকোষে জমা করার এবং তারপর সেটার ব্যবস্থাপন যাজকীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পুরোপুরি সাধারণের কিংবা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরণের কামনা প্রকাশ করবে না? … যাজনতন্ত্রের সংবিধিতে বলা হয়েছে যেহেতু খ্রীষ্টানদের আত্মার ভার ন্যস্ত হয়েছে বিশপদের হাতে, সেক্ষেত্রে যাজনতন্ত্রের সম্পত্তির ভার তাদের হাতে ন্যস্ত হবার ন্যায্যতা তো আরও বেশি।… আজ আপনাদের (দুমা-র ডেপুটিদের) সামনে দাঁড়িয়েছেন আপনাদের পারমার্থিক জননী — ঐশী অর্থোডক্স যাজনতন্ত্র — জন-প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের সামনেই শুধু নয়, অধিকন্তু এই যাজনতন্ত্রের পারমার্থিক সন্তান হিসেবেও আপনাদের সামনে’ (ঐ)।
সাহিত্য প্রসঙ্গে একটি আলোচনা শুনুন
এটা বিশুদ্ধ ক্লেরিকালিজম। যাজনতন্ত্র রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে, যেমন কিনা যা অনাধ্যাত্মিক আর জাগতিক তার ঊর্ধ্বে যা শাশ্বত আর ঐশী সেটার স্থান। যাজনতন্ত্রের সম্পত্তি রাষ্ট্র লোকায়ত করলে সেটা যাজনতন্ত্র ক্ষমা করতে পারে না। যাজনতন্ত্র দাবি করছে একটা নেতৃস্থানীয় এবং প্রাধান্যশালী অবস্থান। সেটার দৃষ্টিতে দুমা-র ডেপুটিরা শুধু নন — কিংবা ততটা নন — জন-প্রতিনিধি, যতটা কিনা ‘পারমার্থিক সন্তান’।
সোশ্যাল-ডেমোক্রাট সুর্কোভ[৭] যা বলেছেন তা নয়, এঁরা যাজকের আলখাল্লা-পরা কর্মকর্তা নন, এঁরা হলেন যাজকের আলখাল্লা-পরা সামন্তবাদী। যাজনতন্ত্রের সামন্তীয় বিশেষাধিকার সমর্থন, মধ্যযুগীয়তার স্পষ্টভাষিত অনুমোদন – এটাই তৃতীয় দুমা-য় বেশির ভাগ পাদরির অনুসৃত কর্মনীতির সারমর্ম। বিশপ ইউলোগিয়াস মোটেই ব্যতিক্রম নন, গেপেৎস্কি-ও[৮] গলাবাজি করেছেন ‘লোকায়তকরণের’ বিরুদ্ধে, সেটাকে তিনি বলেন একটা অসহ্য ‘অন্যায়’ (১৪ এপ্রিল)। যাজক মাশকেভিচ তর্জন-গর্জন করেছেন অক্টোবরি রিপোর্টের বিরুদ্ধে, তাতে চেষ্টা করা হয়েছে ‘আমাদের যাজনতান্ত্রিক জীবনের অবলম্বন রয়েছে এবং নিশ্চয়ই থাকবে যে-ঐতিহাসিক আর ধর্মীয়-অনুশাসনিক ভিত্তি সেটাকে নষ্ট করার … রাশিয়ার অর্থোডক্স যাজনতন্ত্রের জীবন আর ক্রিয়াকলাপকে ধর্মীয়-অনুশাসনিক পথ থেকে এমন পথে ঠেলে দিতে যেখানে … যাজনতন্ত্রের আদত প্রিন্সরা – বিশপরা – অ্যাপসলদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া প্রায় সমস্ত অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন লোকায়ত প্রিন্সদের হাতে।’ … ‘এটা আর কিছুই নয়, এটা হলো শুধু … অন্য কারও সম্পত্তিতে এবং যাজনতন্ত্রের অধিকার আর সম্পত্তিতে অনধিকারপ্রবেশ’। ‘যাজনতান্ত্রিক জীবনের ধর্মীয়-অনুশাসনিক ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করার দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন বক্তাটি, তিনি দুমা-র অধীন করতে চাইছেন অর্থোডক্স যাজনতন্ত্র এবং সেটার সমস্ত আর্থনীতিক ক্রিয়াকলাপ — যে-দুমা হলো আমাদের দেশের অতি বিবিধ লোক নিয়ে, যা বরদাস্ত করা হয় এবং বরদাস্ত করা হয় না উভয় ধর্মমত নিয়ে গড়া প্রতিষ্ঠান’ (১৪ এপ্রিল)।
রুশী নারোদনিকরা এবং উদারপন্থীরা দীর্ঘকাল যাবত নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে আসছেন, কিংবা বরং বলা ভাল আত্মপ্রতারণা করে আসছেন এই ‘তত্ত্ব’টা দিয়ে যে, রাশিয়ায় জঙ্গী ক্লেরিকালিজমের কোনো ভিত্তি নেই, অনাধ্যাত্মিক ক্ষমতার সঙ্গে ‘যাজনতন্ত্রের প্রিন্সদের’ লড়াইয়ের ভিত্তি নেই, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমাদের বিপ্লব[৯] এই বিভ্রান্তিটাকে দূর করে দিয়েছে, যেমন দূর করেছে আরও কতকগুলো নারোদনিক আর উদারপন্থী বিভ্রান্তি। ক্লেরিকালিজম প্রচ্ছন্ন আকারে ছিল যতকাল স্বৈরতন্ত্র ছিল অক্ষত এবং অলঙ্ঘিত। সাধারণভাবে শ্রেণিসংগ্রাম এবং ‘ইতর জনতার’ বিরুদ্ধে ‘যাজকের আলখাল্লা-পরা সামন্তবাদীদের’ চালান সংগ্রাম ‘সমাজ’ আর জনগণের দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন রেখেছিল সর্বশক্তিমান পুলিশ এবং আমলাতন্ত্রকে । কিন্তু সামন্তবাদী স্বৈরাচারী রাজে প্রথম যে-ফাটলটা ধরাল বৈপ্লবিক প্রলেতারিয়েত আর কৃষককুল সেটা দিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ল যা ছিল প্রচ্ছন্ন। প্রলেতারিয়েত আর গণতান্ত্রিক বুর্জোয়াদের আগুয়ান লোকেরা ১৯০৫ সালের শেষে জিতে নিয়েছিল যে-রাজনীতিক মুক্তি, জনসাধারণকে সংগঠিত করার স্বাধীনতা সেটা তারা যেই কাজে লাগাতে শুরু করল অমনি স্বতন্ত্র আর প্রকাশ্য সংগঠনের জন্যে হাত বাড়াল প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিগুলিও। নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্রের আমলে তারা সংগঠিত হয় নি, বড় বেশি খোলাখুলি বেরিয়ে পড়ে নি, সেটা তারা দুর্বল ছিল বলে নয়, সবল ছিল বলে; সংগঠনে আর রাজনীতিক সংগ্রামে তারা অপারগ ছিল বলে নয়, কিন্তু তখনও তারা স্বতন্ত্র শ্রেণি-সংগঠনের সত্যিকার প্রয়োজন বোধ করে নি বলে। রাশিয়ায় স্বৈরতন্ত্র আর সামন্তবাদীদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন সম্ভব বলে তারা মনে করে নি। জনতাকে দমিয়ে রাখতে চাবুকই যথেষ্ট বলে তারা পূর্ণ ভরসা রাখত। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের গায়ে প্রথম-প্রথম ক্ষতগুলোর দরুন সেটাকে যারা সমর্থন করত, সেটাকে দিয়ে যাদের প্রয়োজন ছিল, সেইসব সামাজিক উপাদান প্রকাশ্যে আসতে বাধ্য হলো। ৯ জানুয়ারির ঘটনাগুলি[১০], ১৯০৫ সালের ধর্মঘট আন্দোলন এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর বিপ্লব[১১] যারা ঘটাতে পারল সেই জনসাধারণের বিরুদ্ধে লড়তে শুধু পুরনো চাবুক ব্যবহার করা আর সম্ভব ছিল না। বিভিন্ন স্বতন্ত্র রাজনীতিক সংগঠন গড়ার প্রয়োজন দেখা দিল; কৃষ্ণশতক সংগঠিত করে সম্মিলিত অভিজাত পরিষদকে[১২] চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তৃতাবাগীশিতে প্রবৃত্ত হবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল, প্রতিক্রিয়াশীল যাজকদের একটা স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে সংগঠিত করা প্রয়োজন হয়ে পড়ল ‘যাজনতন্ত্রের প্রিন্স বিশপদের’ পক্ষে।
তৃতীয় দুমা-র এবং রুশ প্রতিবিপ্লবের তৃতীয়-দুমা কালপর্যায়ের একটা নমুনাসই উপাদান হলো এই যে, বাস্তবিকই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর এই সংগঠনটা প্রকাশ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, বাড়তে শুরু করেছে দেশজোড়া পরিসরে, আর দাবি করেছে বিশেষ কৃষ্ণশতক বুর্জোয়া ‘পার্লামেন্ট’। জঙ্গী ক্লেরিকালিজম স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে; রাশিয়ার সোশ্যাল-ডেমোক্রাসিকে এখন থেকে ক্লেরিকাল এবং ক্লেরিকালবিরোধী বুর্জোয়াদের মধ্যে সংঘাতে বারবার পর্যবেক্ষক এবং অংশগ্রাহী হয়ে দাঁড়াতে হবে। যা বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকে পৃথক হয়ে যেতে সক্ষম এমন একটা বিশেষ শ্রেণিতে সম্মিলিত হতে প্রলেতারিয়েতের আনুকূল্য করাটা যদি হয় আমাদের সাধারণ কাজ, তাহলে সমাজতান্ত্রিক আর বুর্জোয়া ক্লেরিকালিজম-বিরোধিতার মধ্যে পার্থক্যগুলিকে জনসাধারণ্যে বোধগম্য করতে দুমা-র মঞ্চ সমেত প্রচার আর আলোড়নের প্রত্যেকটা উপায় ব্যবহার করাটা হলো ঐ কাজের একটা অঙ্গ-উপাদান।
অক্টোবরি আর কাদেতরা যারা তৃতীয় দুমা-য় দাঁড়িয়েছে চরম দক্ষিণপন্থী আর ক্লেরিকালদের এবং সরকারের বিরুদ্ধে তারা যাজনতন্ত্র আর ধর্ম সম্বন্ধে বুর্জোয়াদের মনোভাবের বাস্তব প্রয়োগ প্রদর্শন করে আমাদের পক্ষে এই কাজটা বিস্তর সহজ করে দিয়েছে। সনাতনী-ধর্মবিশ্বাসীদের সংক্রান্ত প্রশ্নটা, যেমন কাদেতরা তেমনি অক্টোবরিরাও সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এই ব্যাপারটা, আর ১৭ অক্টোবর যেটার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়[১৩] তারা সেই ‘সংস্কারের পথ ধরেছে’, যদিও অল্পস্বল্প পরিসরে, এই ব্যাপারটার দিকে এখন বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে কাদেত আর তথাকথিত ‘প্রগতিবাদী’দের বৈধ প্রচারণায়। আমরা যাতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহান্বিত তা হলো এই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত নীতিটা, অর্থাৎ গণতন্ত্রী কাদেত বলে যাঁরা অভিহিত হতে চান তাঁদের সমেত সাধারণভাবে বুর্জোয়াদের ধর্ম আর যাজনতন্ত্র সম্বন্ধে মনোভাব। প্রাধান্যশালী যাজনতন্ত্রের সঙ্গে সনাতন-ধর্মবিশ্বাসীদের সংঘাত, আর সনাতন-ধর্মবিশ্বাসীদের সঙ্গে বাঁধা এবং আর্থিক ব্যাপারে এমনকি তাদের মুখাপেক্ষী অক্টোবরিদের (শোনা যায় ‘গলোস মস্কভি’-র টাকা যোগায় সনাতন-ধর্মবিশ্বাসীরা) আচরণ সংক্রান্ত অপেক্ষাকৃত গৌণ প্রশ্নের দরুন আমরা কিছুতেই ভুলে বসতে পারি নে মূল প্রশ্নটাকে — সেটা হলো শ্রেণি হিসেবে বুর্জোয়াদের স্বার্থ আর কর্মনীতি সংক্রান্ত প্রশ্নটা।
কাউন্ট উভারভ-এর[১৪] বক্তৃতাটার দিকে একটু মনোযোগ দেওয়া যাক; সাধারণ অভিমতের দিক থেকে তিনি অক্টোবরি, কিন্তু তিনি অক্টোবরি গ্রুপ ছেড়ে গেছেন। সোশ্যাল-ডেমোক্রাট সুর্কোভ-এর পরে বলতে উঠে তিনি শুরুতেই নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটা নিয়ে বিবেচনা করতে অস্বীকার করেন, যেভাবে বিবেচনা করেছিলেন শ্রমিকদের ডেপুটিটি। যাজনতন্ত্রের কোনো-কোনো আয় এবং যাজক-পল্লীর তহবিলের খরচ-খরচা সম্বন্ধে দুমা-কে তথ্য দিতে সিনোদ আর মহা-অভিশংসক[১৫] নারাজ বলে উভারভ তাঁদের শুধু সমালোচনা করেন। অক্টোবরিদের অফিশিয়াল মুখপাত্র কামেনস্কি[১৬] প্রশ্নটাকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে ধরে (১৬ এপ্রিল) দাবি করেন ‘অর্থোডক্স ধর্মবিশ্বাসের তাকত বাড়াবার উদ্দেশ্যে’ যাজক-পল্লীগুলিকে জিইয়ে তোলা চাই। তথাকথিত ‘বাম তরফের অক্টোবরি’ কাপুস্তিন[১৭] এই ধারণাটাকে বিস্তারিত করেন। ‘জন-জীবনের দিকে’ — তিনি চড়া গলায় বলে ওঠেন, ‘গ্রামীণ জনসমষ্টির জীবনের দিকে তাকালে আমরা আজ, এখনই দেখতে পাই একটা শোচনীয় তথ্য: ধর্মীয় জীবন টলমল করছে, মানুষের নৈতিক মূলসূত্রগুলির সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র ভিত্তি টলছে। … পাপ সংক্রান্ত ধারণার জায়গায় আসতে পারে কী, কী আসতে পারে বিবেকের নির্দেশের স্থলে? সেসবের জায়গায় নিশ্চয়ই আসতে পারে না শ্রেণিসংগ্রাম এবং অমূলক কিংবা অমূক শ্রেণির অধিকার সংক্রান্ত ধারণা। ঐ মর্মান্তিক ধারণাটা বদ্ধমূল হয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। কাজেই নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে ধর্মের টিকে থাকতে হলে, সেটাকে সমগ্র জনসমষ্টির নাগালের মধ্যে থাকতে হলে এই ধর্মের বাহকদের থাকা চাই উপযুক্ত কর্তৃত্ব।…’
ধর্মের প্রভাব পর্যাপ্ত নয়, সেটা সেকেলে হয়ে পড়েছে, এটা বুঝে, ‘যাজকীয় আলখাল্লা-পরা কর্মকর্তারা’ যাজনতন্ত্রের কর্তৃত্ব নামিয়ে দিচ্ছে, তারা শাসক শ্রেণিগুলির ক্ষতি পর্যন্ত করছে এটা উপলব্ধি করে প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়াদের মুখপাত্রটি ধর্মের তাকত বাড়াতে চাইছেন, জনসাধারণের উপর ধর্মের প্রভাব প্রবল করতে চাইছেন তিনি। জনসাধারণের উপর যাজনতন্ত্রের প্রভাব জোরদার করাবার জন্যে, জনসাধারণের বুদ্ধি ঘুলিয়ে দেবার যেসব উপায় এতই স্থূল, এতই সেকেলে, এতই বস্তাপচা যাতে সেগুলো দিয়ে আর মতলব হাসিল করা যায় না তার অন্তত কোনো-কোনোটার জায়গায় অপেক্ষাকৃত মার্জিত এবং উন্নত ধরনের উপায় চালু করার জন্যে অক্টোবরিটি লড়ছেন ক্লেরিকালিজমের বাড়াবাড়ি এবং পুলিশী গার্জেনির বিরুদ্ধে। জনসাধারণের মাথা ঘুলিয়ে দেবার জন্যে পুলিশী ধর্ম আর যথেষ্ট নয়; আমাদের চাই অপেক্ষাকৃত মার্জিত, অপেক্ষাকৃত হালফিল, অপেক্ষাকৃত কুশলী ধরনের ধর্ম, যেটা ফলপ্রদ হবে স্বশাসিত যাজকপল্লীতে ― এটাই পুঁজি দাবি করছে স্বৈরতন্ত্রের কাছে।
এই বিবেচনাধারার একেবারে সমান-সমান শরিক হলেন কাদেত কারাউলভ[১৮]। এই ‘উদারপন্থী’ বেইমানটি (যিনি নারোদনায়া ভলিয়া[১৯] থেকে ক্রমে অভিব্যক্ত হয়ে যান দক্ষিণ তরফের কাদেতদের মাঝে) চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করেন ‘যাজনতন্ত্রের জাতীয়করণভঙ্গের’ বিরুদ্ধে, ‘তাতে অর্থ বুঝি গির্জা-ভবন থেকে মানুষের বিপুল অংশটাকে, জনসাধারণকে বাদ দেওয়া’। জনসাধারণ ‘আস্থা হারাচ্ছে’, এটা তাঁর পক্ষে ‘অভিঘাত’ (আক্ষরিক অর্থেই তাই!)। একেবারেই মেনশিকভের কায়দায় তিনি সোরগোল তুলেছেন, কেননা ‘ক্ষয়ে যাচ্ছে যাজনতন্ত্রের বিপুল অন্তর্নিহিত মূল্য … তাতে ক্ষতি হচ্ছে যাজনতন্ত্রের কর্মব্রতেরই শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় কর্মব্রতেরও’। যাজনতন্ত্রের কাজ চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, তই রাজনীতির সঙ্গে যাজনতন্ত্রকে সংযুক্ত করা সম্ভব নয়’, এই প্রসঙ্গে ধর্মান্ধ ইউলেগিয়াস-এর জঘন্য ভণ্ডামিকে তিনি ‘কথাগুলি টুকরো-টুকরো সোনা’ বলে অভিহিত করেন। যাজনতন্ত্র হয়ত ‘আজকের চেয়ে বেশি ক্ষমতা অর মাহাত্ম্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট মহৎ আর ঐশী কাজ সমাধা করবে প্রেম আর মুক্তির খ্রীষ্টীয় ভাব অনুসারে’, শুধু এই কারণে তিনি কৃষ্ণশতকের সঙ্গে যাজনতন্ত্রের জোটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
কারাউলভের এইসব ‘গীতল কথা’ নিয়ে দুমা-র মঞ্চ থেকে হাসাহাসি করে কমরেড বেলোউসভ[২০] বেশ করেছেন। তবে এমন উপহাস পর্যাপ্ত নয়, মোটেই পর্যাপ্ত নয়। কাদেতদের দৃষ্টিভঙ্গিটা অক্টোবরিদের দৃষ্টিভঙ্গির মতো একেবারে একই; সাধারণ রুশী যাজকেরা এখনও বাস করে অতীতের মাঝে, তারা এখন যাজনতান্ত্রিক ভাঁওতাবাজি যেভাবে চালায় তার চেয়ে মার্জিত প্রণালীতে মানুষকে ধর্মীয় মাদক দিয়ে বিভ্রান্ত করার জন্যে ‘সভ্যভব্য’ পুঁজির চেষ্টাই তাতে শুধু প্রকাশ পায়: এটা স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার ছিল — আর প্রথম উপযোগী সুযোগেই তা করা দরকার দুমা-র মঞ্চ থেকে।
মানুষকে মানসিক দাসদশায় রাখার জন্যে চাই যাজনতন্ত্র আর কৃষ্ণশতকের মধ্যে যথাসম্ভব ঘনিষ্ঠ জোট — এটা ‘হন্যে জমিদার’ আর বৃদ্ধ দের্জিমোর্দা বললেন তাঁদের মুখপাত্র পুরিশকেভিচের[২১] জবানি। ভুল করছেন, মশাইরা — প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়ারা পালটা জবাবে বলে তাঁদের মুখপাত্র কারাউলভ-এর জবানি: এই প্রণালী ধরলে জনসাধারণকে চিরকালের মতো ধর্ম থেকে ভিন্নমুখী করেই দেবেন শুধু। এখন আমাদের চলা দরকার অরও চালাক-চতুর উপায়ে, আরও কায়দা করে, অরও বুদ্ধিকৌশল খাটিয়ে: কৃষ্ণশতকের বড় বেশি বোকা আর স্থূল এজেন্টটিকে সরিয়ে দেওয়া যাক, যুদ্ধ ঘোষণা করা যাক ‘গির্জার জাতীয়করণভঙ্গের’ বিরুদ্ধে, আর যাজনতন্ত্র রাজনীতির ঊর্ধ্বে এই মর্মে বিশপ ইউলোগিয়াস-এর ‘টুকরো-টুকরো সোনার কথাগুলি’কে লিখে দেওয়া যাক আমাদের পতাকায়। একমাত্র এই উপায়েই শ্রমিকদের অন্তত কাউকে-কাউকে, বিশেষত পেটি বুর্জোয়া আর কৃষকদের কাউকে-কাউকে আমরা বোকা বানাতে পারব, জনসাধারণের বিরাট অংশকে মানসিক দাসদশায় রাখার জন্যে ‘নির্দিষ্ট মহৎ এবং ঐশী কাজ’ হাসিল করতে নবীকৃত যাজনতন্ত্রকে সাহায্য করতে পারব।
আমাদের উদারপন্থী পত্র-পত্রিকাগুলি, তার মধ্যে ‘রেচ’ পত্রিকাও, ইদানীং মনোযোগ নিবদ্ধ করে স্ত্রুভে অ্যান্ড কোং-কে নিন্দা করছে তাঁরা ‘ভেখি’ নামে সংকলনটির সংগঠক বলে। কিন্তু এই সমস্ত আপত্তির যাবতীয় জঘন্য ভণ্ডামি এবং স্ত্রুভে[২২] অ্যান্ড কোং-কে প্রত্যাখ্যান করার এই সমস্ত ব্যাপারের স্বরূপ খুলে ধরে একটা অত্যুৎকৃষ্ট কাজ করেছেন দুমা-য় কাদেতদের অফিশিয়াল মুখপাত্র কারাউলভ। কারাউলভ আর মিলিউকভ[২৩] যা গোপন করেন তা স্ত্রুভে ফাঁস করে দেন। স্ত্রুভে অবিবেচক হয়ে সত্যি কথা বলে ফেলেছেন বলে, বড় বেশি খোলাখুলি অভিপ্রায় প্রকাশ করে দিয়েছেন বলে, শুধু এই কারণে উদারপন্থীরা তাঁর উপর দোষারোপ করছেন। ‘ভেখি’-র নিন্দা করে এবং কাদেত পার্টিকে সমর্থন করতে থেকে উদারপন্থীরা জনসাধারণকে ভাঁওতা দিচ্ছেন অতি নির্লজ্জভাবে: অবিবেচনাপ্রসূত-স্পষ্টভাষিত কথার নিন্দা করছেন, আর করে চলছেন ঠিক তাই যা ঐসব কথার সঙ্গে মানানসই।
আলোচ্য বিষয়গুলি নিয়ে বিতর্কের সময়ে দুমা-য় ক্রুদোভিক-দের আচরণ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলার নেই। যেমন সবসময়ে, একটা লক্ষণীয় পার্থক্য প্রকাশ পেয়েছিল কৃষক ত্রুদোভিক আর বুদ্ধিজীবী ত্রুদোভিক-দের মধ্যে, তাতে শেষোক্তরা অসুবিধায় পড়েন, সেটা কাদেত-দের পিছন-পিছন চলতে তাঁদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যগ্রতার দরুন। রঝকোভ[২৪] নামে একজন কৃষক তাঁর বক্তৃতায় রাজনীতিক চেতনার ষোলআনা অভাবের পরিচয় দেন বটে, তিনিও রুশী জনসংঘ[২৫] সম্বন্ধে কাদেত-দের মামুলি কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করে ধর্মবিশ্বাস জোরদার করতে নয়, সেটা ভাঙতে আনুকূল্য করেন। কোনো কর্মসূচি বাতলাতে তিনি অপারগ হন। পক্ষান্তরে, তিনি যখন সাদামাঠা ধরনে স্পষ্ট, অসজ্জিত সত্যকথা বলতে আরম্ভ করেন যাজকদের আদায়গুলো সম্বন্ধে, পাদরিদের জবরদস্তির সংগ্রহ সম্বন্ধে, বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা বাবদ কিভাবে তারা টাকা ছাড়াও আরও চায় ‘এক-বোতল ভদ্কা, জলখাবার এবং এক-পাউন্ড চা, আর কখনও-কখনও এমন কিছু যে-বিষয়ে এই মঞ্চ থেকে উল্লেখ করতেও আমি ভয় পাচ্ছি’ (১৬ এপ্রিল, হুবহু বিবরণ, ২২৫৯ পৃঃ) সেই সম্বন্ধে — ততখানি আর সহ্য হলো না কৃষ্ণশতক দুমা-র। দক্ষিণের আসনগুলো থেকে উঠল উৎকট গর্জন। জবরদস্তির আদায় সম্বন্ধে এই সাদাসিধে কৃষকটির বক্তৃতা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্যে ধার্য ‘দেয়ক’-শ্রেণির এই ফিরিস্তি জনসাধারণের মনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে যে কোনো পরিমাণ তত্ত্বীয় কিংবা কর্মকৌশলগত ধর্মবিরোধী এবং যাজনতন্ত্রবিরোধী ঘোষণার চেয়ে বেশি, এটা বুঝে কৃষ্ণশতকরা চিল্লাতে থাকল — ‘এ তো মানহানিকর, এতো বরদাস্ত করা যায় না’! তৃতীয় দুমা-য় স্বৈরতন্ত্রের কট্টর সমর্থকদের দঙ্গলটা তখন তাদের নোকরকে — দুমা-র সভাপতি মেইয়েনদোর্ফ[২৬]-কে — ভয় দেখিয়ে রঝকোভ-কে বসিয়ে দেবার বিনির্দেশ দিতে বাধ্য করে (সোশ্যাল-ডেমোক্রাটরা, আর তাঁদের সঙ্গে কিছু-কিছু ত্রুদোভিক, কাদেত এবং অন্যান্যরা সভাপতির এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ পেশ করেন)।
কৃষক ত্রুদোভিক রঝকোভ-এর বক্তৃতাটি খুবই আনাড়ি হলেও, ধর্মের সপক্ষে কাদেত-দের কপটাচারী, সুপরিকল্পিত প্রতিক্রিয়াশীল সমর্থন এবং কৃষকের আদিম, অজানত, কাটখোট্টা ধরনের ধর্মপরতার মধ্যে বিপুল ব্যবধানটা এতে চমৎকার প্রদর্শিত হলো, — কৃষকের জীবনযাত্রার পরিবেশ থেকেই — তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং তার অজানতে দেখা দেয় জবরদস্তির আদায়ের বিরুদ্ধে যথার্থ বৈপ্লবিক ক্ষোভ এবং মধ্যযুগীয়তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে লড়ার আগ্রহ। জনসাধারণের বিরুদ্ধে ধর্মকে নবীকৃত এবং তাকতদার করতে বদ্ধপরিকর প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি হলো কাদেত-রা। রঝকোভ-রা হলেন বৈপ্লবিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রতিনিধি, এই গণতন্ত্র অনুন্নত, রাজনীতিক চেতনায় হীনবল, পদদলিত, ঊন-স্বতন্ত্র, অনৈক্যগ্রস্ত, তবু ভূস্বামী পাদরি আর স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৈপ্লবিক কর্মশক্তির প্রায় অফুরন্ত ভাণ্ডারে ঠাসা।
রোজানভ[২৭] নামে বুদ্ধিজীবী ক্রুদোভিক কাদেত-দের কাছাকাছি পৌঁছন রঝকোভ-এর চেয়ে অনেক কম অজানতে। ‘বাম’-এর একটা দাবি হিসেবে যাজনতন্ত্রকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত করার কথা রোজানভ উল্লেখ করতে পারলেন, কিন্তু ‘যাজকমণ্ডলী রাজনীতিক সংগ্রাম থেকে বাদ পড়বে এইদিক দিয়ে নির্বাচনী আইন সংশোধন’ সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়াশীল, পেটি বুর্জোয়া বুলি থেকে বিরত থাকতে পারলেন না। একজন নমুনাসই, মধ্যম ধরনের কৃষক যখন তার জীবনযাত্রা কেমন সে-সম্বন্ধে সত্য কথা বলতে শুরু করে তখন যে-বৈপ্লবিক মেজাজের প্রকাশ ঘটে সেটা মিলিয়ে যায় বুদ্ধিজীবী ত্রুদোভিকের বেলায়, সেটার জায়গায় আসে অস্পষ্ট এবং কখনও-কখনও বাস্তবিকই খারাপ কথাবার্তা। এই শততম বার, সহস্রতম বার দেখা যাচ্ছে এই সত্যটা প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, সামন্তবাদী মনোভাবাপন্ন ভূস্বামীদের যাজকের আলখাল্লা-পরা সামন্তবাদীদের, স্বৈরতন্ত্রের সামন্তীয় মনোভাবাপন্ন সমর্থকদের উৎপীড়নকর এবং মারক জোয়ালটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে রাশিয়ার কৃষকজন সক্ষম হবে একমাত্র যদি তারা চলে প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে।
শ্রমিক পার্টি এবং শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি সোশ্যাল-ডেমোক্রাট সুর্কোভ-ই দুমা-য় একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিতর্কটাকে যথার্থ উঁচু মূলনীতির স্তরে উন্নীত করেন এবং মূল প্রশ্নটা ছেড়ে অবান্তর কথায় না গিয়ে বলেন যাজনতন্ত্র আর ধর্ম সম্বন্ধে প্রলেতারিয়েতের মনোভাব কি, আর এই বিষয়ে কি হওয়া উচিত সমস্ত অটল এবং তেজী গণতন্ত্রীদের মনোভাব। ‘ধর্ম জনগণের পক্ষে আফিমস্বরূপ’ … ‘মাদক সেবন করিয়ে মানুষের চেতনানাশ করছে যেসব মারাত্মক জন-শত্রু তাদের জন্যে একটি কানা-কপর্দকও নয় সাধারণের অর্থ থেকে’ — একজন সমাজতন্ত্রীর এই সিধে বলিষ্ঠ স্পষ্টভাষিত রণধ্বনি অনুরণিত হলো কৃষ্ণশতক দুমা-র উদ্দেশে চ্যালেঞ্জের মতো, আর তাতে সাড়া দিল লক্ষ-লক্ষ প্রলেতারিয়ান, তারা এটাকে ছড়িয়ে দেবে জনসাধারণের মধ্যে, দিন এসে গেলে কিভাবে এটাকে বৈপ্লবিক কর্মে পরিণত করতে হয় সেটা তারা বুঝবে।
৬ নং সোৎসিয়াল-দেমোক্রাৎ,
৪ (১৭) জুন, ১৯০৯
আরো পড়ুন
- ধর্ম প্রসঙ্গে গ্রন্থের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
- লেনিনবাদী বিশ্বদৃষ্টিতে ধর্ম
- সংগ্রামী বস্তুবাদের তাৎপর্য
- যুব লীগের কর্তব্য
- রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর খসড়া কর্মসূচি থেকে ধর্ম প্রসঙ্গে
- নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেসে বক্তৃতা
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- ধর্ম এবং যাজনতন্ত্রের প্রতি মনোভাব অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণি আর পার্টি
- ধর্ম প্রসঙ্গে শ্রমিক পার্টির মনোভাব
- লেভ তলস্তয় – রুশ বিপ্লবের দর্পণ
- সমাজতন্ত্র ও ধর্ম
- লেনিন রচিত ধর্ম প্রসঙ্গে বইয়ের পূর্বকথা ও সূচিপত্র
টিকা
[১] সনাতনী-ধর্মবিশ্বাসীরা ― ১৭ শতকে রুশী অর্থোডক্স যাজনতন্ত্র থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল যেসব ভিন্নমতাবলম্বী।
[২] অক্টোবরিরা ― ‘সতরই অক্টোবরের সংঘ’-র সদস্যরা; বৃহৎ পুঁজিপতিদের এই নামে রাজতান্ত্রিক পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে। জারের ১৯০৫ সালের ১৭ অক্টোবরের ইস্তাহারের প্রতি সমর্থন সূচিত হয় নামটায়, রাশিয়ায় ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি ছিল এই ইস্তাহারে। অক্টোবরিদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপই ছিল জনবিরোধী; বৃহৎ পুঁজিপতিদের এবং পুঁজিবাদী ধারায় যারা মহল চালাত সেইসব ভূস্বামীর স্বার্থ সুরক্ষিত করতে খিদমত করত এই ক্রিয়াকলাপ। জার সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র নীতি সমর্থন করত অক্টোবরিরা। অক্টোবর বিপ্লবের পরে অক্টোবরিরা কাদেত পার্টির সঙ্গে মিলে এবং বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করেছিল সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
[৩] প্রগতিবাদীরা ― রুশী উদারপন্থী-রাজতন্ত্রী বুর্জোয়াদের একটা গ্রুপ; অক্টোবরি আর কাদেতদের মাঝামাঝি জায়গায় ছিল এদের অবস্থান।
[৪] শান্তিপূর্ণ নবীকরণ পার্টি ― বাণিজ্য আর শিল্প ক্ষেত্রের বৃহৎ বুর্জোয়া এবং বৃহৎ ভূস্বামীদের একটা পার্টি।
[৫] ১৯০৭ সালে ৩(১৬) জুন জার সরকার একটা কূদেতা ঘটায়, তাতে দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় দুমা ভেঙে দেওয়া হয় এবং পরিবর্তিত করা হয় দুমা নির্বাচনের আইন। তৃতীয় দুমা বসেছিল ১৯০৭ সালে নভেম্বর মাসে। শ্রমিক আর কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব আগেই ছিল সামান্য, সেটা আরও অনেকটা কমে যায় নতুন আইনে। দুমা-য় আধিপত্য ছিল কৃষ্ণশতক আর কাদেতদের।
[৬] ক্যাথারিন, দ্বিতীয় (১৭২৯-১৭৯৬) ― রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী (১৭৬২-১৭৯৬)।
[৭] সুর্কোভ, প. ই. (১৮৭৬-১৯৪৬) – সোশ্যাল-ডেমোক্রাট, তৃতীয় দুমা-র ডেপুটি।
[৮] গেপেৎস্কি, ন. এ. – ভূস্বামী, ধর্মযাজক। তৃতীয় ও চতুর্থ দুমার ডেপুটি।
[৯] ১৯০৫-১৯০৭ সালের প্রথম রুশ বিপ্লব।
[১০] সেন্ট পিটার্সবুর্গের কল-কারখানার শ্রমিকেরা তাদের স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে শোভাযাত্রা করে শীত প্রাসাদে গিয়েছিল ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি, তাদের পদদলিত দশা এবং ষোলআনা অধীকারহীনতার বিবরণ-দেওয়া আবেদনপত্র তারা পেশ করতে চেয়েছিল জারের কাছে। জারের হুকুমে সৈন্যরা গুলি চালায় এই শান্তিপূর্ণ নিরস্ত্র মিছিলের উপর, মানুষ নিহত হয়েছিল এক হাজারের বেশি, আর আহত হয়েছিল আরও প্রায় পাঁচ হাজার। এই পাবিক কাণ্ডের জবাবে ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’ স্লোগান তুলে বিক্ষোভ প্রদর্শন আর ধর্মঘটের স্রোত বয়ে গিয়েছিল সারা দেশে। শুরু হলো প্রথম রুশ বিপ্লব।
[১১] সারা-রাশিয়া রাজনীতিক ধর্মঘট হয়েছিল ১৯০৫ সালে অক্টোবর মাসে, ১৯০৫ সালে ডিসেম্বর মাসে মস্কোয় হয়েছিল একটা সশস্ত্র অভ্যুত্থান।
[১২] সম্মিলিত অভিজাত পরিষদ — সামন্ত ভূস্বামীদের একটা প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে।
[১৩] বিপ্লবের ফলে আতঙ্কিত জারের একখানা ইস্তাহার প্রচারিত হয় ১৯০৫ সালের ১৭ অক্টোবর, তাতে সংবিধান এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি ছিল। এটা ছিল শ্রমিকদের ভাঁওতা দেবার জন্যে রাজনীতিক চাতুরি ছাড়া কিছুই নয়।
[১৪] উভারভ, আ. আ. — বড় জমিদার, অক্টোবরি পার্টির সভ্য, তৃতীয় দুমা-র ডেপুটি।
[১৫] সিনোদ-এর মহা-অভিশংসক ছিলেন সংস্থাটার প্রধান।
[১৬] কামেনস্কি, প. ভ. — বড় ভূস্বামী, অক্টোবরি পার্টির সভ্য, তৃতীয় দুমা-র ডেপুটি।
[১৭] কাপুস্তিন, ম. ইয়া. (১৮৪৭-১৯২০) — বড় ভূস্বামী, অক্টোবরি পার্টির সভ্য, তৃতীয় দুমা-র ডেপুটি।
[১৮] কারাউলভ, ভ. আ. (১৮৫৪-১৯১০) — কাদেত, তৃতীয় দুমা-র ডেপুটি।
[১৯] ‘নারোদনায়া ভলিয়া’ (‘জনগণের ইচ্ছা’) স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ করবার উদ্দেশ্যে ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নারোদনিক নৈরাজ্যবাদীদের পার্টি। এটা টিকে ছিল উনিশ শতকের নবম দশকের মাঝামাঝি অবধি।
[২০] বেলোউসভ, তেরেন্তি অসিপভিচ – সোশ্যাল-ডেমোক্রাট, তৃতীয় দুমা-র ডেপুটি।
[২১] পুরিশকেভিচ, ভ্লাদিমির মিত্রফানভিচ (১৮৭০-১৯২০) — মস্ত ভূস্বামী, উন্মত্ত প্রতিক্রিয়াশীল, রাজতন্ত্রী।
[২২] স্ত্রুভে, পিওতর বের্নগার্দভিচ, (১৮৭০-১৯৪৪) — উনিশ শতকের শেষ দশকে ‘বৈধ মার্কসবাদ’-এর অগ্রণী প্রবক্তা; পরে কাদেতী পার্টির অন্যতম নেতা; অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লবী দেশান্তরী।
[২৩] মিলিউকভ, পাভেল নিকোলায়েভিচ (১৮৫৯-১৯৪৩) —কাদেতী পার্টির নেতা, ইতিহাসকার; অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে (১৯১৭) সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে লড়েন।
[২৪] রঝকোভ, গ. এ. – কৃষক, তৃতীয় দুমা-র ডেপুটি।
[২৫] রুশী জনসংঘ ― রাজতান্ত্রিক কৃষ্ণশতক সংগঠন।
[২৬] মেইয়েনদোর্ফ, আ. ফ. – অক্টোবরী পার্টির সভ্য, তৃতীয় ও দ্বিতীয় দুমা-র ডেপুটি।
[২৭] রোজানভ, ন. স. – চিকিৎসক, তৃতীয় দুমা-র ডেপুটি।

ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (২২ এপ্রিল, ১৮৭০ – ২১ জানুয়ারি, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।