সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজ হচ্ছে বেসামরিক নাগরিকদের সম্মেলন

সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ, পুরুষ সমাজ, জন সমাজ, লোক সমাজ, অ-রাষ্ট্রীয় সমাজ বা বেসামরিক সমাজ (ইংরেজি: Civil society) হচ্ছে নাগরিকদের রাজনৈতিক সম্মেলনের বিন্দু। অনেকে একে সিভিল সমাজও বলে থাকেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুশীল সমাজ আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্র সংরক্ষণ, উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি তথা সার্বিকভাবে রাষ্ট্র যন্ত্রকে অধিক কার্যকরী ও ফলপ্রসূ করতে সুশীল সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। একথায় রাষ্ট্রকে জনকল্যাণধর্মী রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের বিকল্প নেই।[১]

সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই আধুনিক পাশ্চাত্য সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবে এই সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজ শব্দ দুটি গড়ে উঠেছে। সুশীল সমাজ নামের এই ভাবনাটিকে রাজনৈতিক তত্ত্বে ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে ব্যবহার করা হয়েছে রাষ্ট্রের সাথে সন্নিবদ্ধ অবস্থানে;— ফলে এই রাজনৈতিক অবস্থানটি সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই আধুনিক পাশ্চাত্য রাজনৈতিক চিন্তার প্রধান আলোচনা হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে।

সুশীল সমাজ শব্দবন্ধটি উদারতাবাদী থেকে মাকর্সবাদীরা, অর্থাৎ রাজনৈতিক বর্ণালির সকলেই ব্যবহার করেছেন। তবে মার্কসীয় দর্শনে এই চিন্তাকে কিছুটা উপেক্ষা করা হয়েছে বলা যায়। পাশ্চাত্য সভ্যতায় সুশীল সমাজকেন্দ্রিক ভাবনার একটি নির্দিষ্ট পথ কোনােদিনও ছিল না। উদারতাবাদী চিন্তাধারায় এই বিষয়ে বহু মত ও পরিবর্তন হয়েছে। এসব মত তৈরি হবার কারণ হচ্ছে সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরােপে সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশসমূহের ভাঙন, যে ঘটনার সূচনা উনিশশো আশির দশকের শেষের দিকে শুরু হয়েছিল, এবং দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়নের ঘটনা।

সুশীল সমাজ একুশ শতকে উন্নত দেশে বসবাসকারী দাতাদের নিপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে সহায়তা করার প্রধান যুক্তি ও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুশীল সমাজের প্রধানতম উদাহরণ হলো, অন্তত, এই বিশ্বায়িত দুনিয়ায় অসংখ্য এনজিও বা বেসরকারী সংস্থাগুলি। এই শব্দ দুটি আজকাল অনেক র‍্যাডিক্যাল গােষ্ঠীও বহুভাবে ব্যবহার করছে যারা বিভিন্ন স্বৈরতন্ত্রী শাসনের অধীনতায় থেকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বার্থে সংগ্রাম করছে, এমনকী সমাজের দুর্বলতরও প্রান্তিক অংশের স্বার্থ সংরক্ষণে কর্মসূচি গ্রহণ করছে। সুশীল সমাজ শব্দবন্ধটি একুশ শতকে তাই সমগ্র পৃথিবী জুড়ে ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যবস্থায়, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বহুবিধ প্রেক্ষিতে এবং অনেক সময়ই বিপরীত অর্থে। কিন্তু সবক্ষেত্রেই এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব একুশ শতকের রাজনৈতিক কাজে অনস্বীকার্য।

পাশ্চাত্য সমাজে আধুনিকতার সূচনার সময় এই প্রত্যয়টিকে ব্যবহার করা হয়েছিল একটি স্বাধীন, মুক্ত এলাকা হিসাবে, ব্যক্তি-মানুষের স্বার্থে, ও সর্বশক্তিমান ও সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে। যদিও সুশীল সমাজ কথাটির মূল অর্থটি স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে এখনাে কিছুটা বিদ্যমান। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, উত্তর ঔপনিবেশিক ও উত্তর সমাজতান্ত্রিক সমাজগুলিতে এই ধারণাটি বহু রকমের অর্থ পরিগ্রহ করেছে।

উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, সাবেক সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশগুলিতে উদাহরণস্বরূপ সুশীল সমাজের সেভাবে কোনাে অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু সেখানে পার্টির বা রাষ্ট্রের শক্তিতে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হত। ফলশ্রুতিতে ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং ১৯৯১-এ সােভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফলে রাষ্ট্র ভাবনাতেই বিভিন্ন সুশীল সমাজের গ্রুপগুলি তাদের আন্দোলনের ভিত তৈরি করতে উৎসাহিত হয়েছিল। পােল্যান্ডের সলিডরিটি আন্দোলন এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সুশীল সমাজের অর্থ উত্তর উপনিবেশিক সমাজগুলিতে বিভিন্নজনের কাছে আলাদা আলাদা বার্তা বহন করেছে। বহুমুখী রাজনৈতিক আন্দোলন, তা সে বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক বা উদারতাবাদী বা নয়া সামাজিক আন্দোলন; সকলকেই সুশীল সমাজের বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। এই পৌর বা সিভিল সমাজ শব্দদ্বয় বহু ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের গঠন, তার রক্ষা পাওয়া ও তাকে মহিমান্বিত করবার চিন্তার সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে, এই বেসামরিক শব্দ দুটিকে একটি সুনির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্ক বা সামাজিক কাঠামাে অর্থাৎ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের মুক্ত কাজের এলাকাকে উপলব্ধির প্রয়োজনেও ব্যবহার করা হচ্ছে।[২]

তথ্যসূত্র

১. মো. আবদুল ওদুদ (১৪ এপ্রিল ২০১৪। “জর্জ উইলহেলম ফ্রেডরিক হেগেল”। রাষ্ট্রদর্শন (২ সংস্করণ)। ঢাকা: মনন পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ৪০২-৪০৩।
২. শোভনলাল দত্তগুপ্ত, রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়সমূহ, তৃতীয় পত্র “রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ” নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ৭-৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!