মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে স্বৈরতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা পাকা করবার পদ্ধতি

মৌলিক গণতন্ত্র (ইংরেজি: Basic Democracy) হচ্ছে স্থানীয়, প্রাদেশিক এমনকি পুরো রাষ্ট্রে স্বৈরতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা পাকা করবার পদ্ধতি। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্থানের সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক বর্বর নরপিশাচ ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে দেশের পার্লামেণ্টারী শাসন-ব্যবস্থা বাতিল করেন।[১]

স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আধুনিক বর্বর আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ ১৯৫৯ জারি করেন। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামের এই শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তন মূলত গণতন্ত্র হত্যার একটি কাজ রূপে গণ্য হয়েছিল। এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের পার্লামেণ্ট, প্রাদেশিক পরিষদ এবং প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনে পরোক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা।

শুরুর দিকে এই গণতন্ত্র ছিল একটি পাঁচ স্তরবিশিষ্ট পদ্ধতি। নিচের দিক থেকে শুরু করে এ স্তরগুলো ছিল (১) ইউনিয়ন পরিষদ (পল্লী এলাকায়) এবং শহর ও ইউনিয়ন কমিটি (পৌর এলাকায়), (২) থানা পরিষদ (পূর্ব পাকিস্তানে), তহশিল পরিষদ (পশ্চিম পাকিস্তানে), (৩) জেলা পরিষদ, (৪) বিভাগীয় পরিষদ এবং (৫) প্রাদেশিক উন্নয়ন উপদেষ্টা পরিষদ।[২]

মৌলিক গণতন্ত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচকমণ্ডলীতে ভাগ করা হয়। জনসাধারণ এই নির্বাচকমণ্ডলী প্রেসিডেণ্টকে নির্বাচিত করত এবং যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ এই অধিকার ব্যতীত পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও বিভাগীয় কাউন্সিলে অংশ গ্রহণের কম বেশি অধিকার দেওয়া হয়। এক হাজার অধিবাসীর ভিত্তিতে একজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ প্রথম পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করত। কিন্তু পরবর্তী থানা পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানগনই মাত্র থানা কাউন্সিলের সদস্য এবং থানা কাউন্সিলের সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই জেলা কাউন্সিলে, আবার জেলা কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যদের নির্বাচনে বিভাগীয় কাউন্সিলের সদস্যগণ নির্বাচিত হত। ফলে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটদানের ক্ষমতা নির্বাচকমন্ডলীর নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ কিংবা প্রেসিডেণ্টের নির্বাচনে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ অধিকার ছিল না। স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যায়ের ইউনিয়ন কাউন্সিল ব্যতীত অপর স্তরগুলিতে ক্রমাধিক পরোক্ষ নির্বাচন এবং সীমিত অধিকারের ব্যবস্থা করা হয়।[৩]

পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার, সর্বমোট ৮০ হাজার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ (Basic Democrats) সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন বলে বিধান করা হয়। এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, আইনসভার সদস্য ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতো। মৌলিক গণতন্ত্রে প্রবর্তিত ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী বা বি ডি (বেসিক ডেমোক্রাট) ছিলেন দেশের মূল নির্বাচকমণ্ডলী। জনগণকে এই ব্যবস্থায় মূল নির্বাচকমণ্ডলী বলা যায় না। কেননা, জনগণ রাষ্ট্রপতি, বা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করতে পারতেন না।[৪]

স্বৈরতন্ত্রী অবৈধ প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব খান অভিমত পোষণ করতেন যে, দেশের জনসাধারণ পার্লামেণ্টারী গণতন্ত্রের উপযুক্ত নয়। তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নাম দিয়ে তিনি জনসাধারণকে এই বলে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন যে, জনসাধারণ হচ্ছে মূল এবং সেখানে গণতন্ত্র প্রবর্তন করাই হচ্ছে মৌলিক গণতন্ত্র। এবং মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে সেরা গণতন্ত্র।

কার্যত এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল জনসাধারণকে দেশের জাতীয় সমস্যার আলোচনা ও সমাধানের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার একটি সুকৌশল প্রাচ্য স্বৈরতান্ত্রিক বর্বর প্রচেষ্টা। স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রেও জনসাধারণের কোনো কার্যকর অধিকার ছিল না।

প্রতিটি স্তরে আমলাতন্ত্রকে জনসাধারণের প্রতিনিধিদের উপর খবরদারির অধিকার দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯৫৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ডের প্রতিনিধিগণ স্বায়ত্ত্বশাসনের যে অধিকার ভোগ করত সে অধিকারও মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৬৯-৭০-এর গণআন্দোলনে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন এবং তার মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে।

ক্ষমতায় আরোহণ করার পর জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার সঙ্কুচিত করার প্রবণতা উচ্চতর ধনিক শ্রেণীর শাসকদের একটি সাধারণ প্রবণতা। এছাড়াও সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশসমূহে যে মুৎসুদ্দি শাসকশ্রেণি দেখা যায়, তারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে গণবিরোধী কার্যক্রম চালায়, আইয়ুব খানের এই কাজ ছিলো সেই উদ্দেশ্যে। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ছিল এই প্রবণতারই প্রকাশ।[৫]

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ৪ মে ২০১৯, “মৌলিক গণতন্ত্র প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ইউআরএল: https://www.roddure.com/encyclopedia/basic-democracy/
২. শামসুর রহমান, ৫ মে ২০১৪, বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ইউআরএল: https://bn.banglapedia.org/index.php?title=মৌলিক_গণতন্ত্র
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৭৮।
৪. মো. আনোয়ার হোসেন, মো. গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্য, অপটিমাম পাবলিকেশন্স, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০২২, পৃষ্ঠা ১২৯।
৫. সরদার ফজলুল করিম, পূর্বোক্ত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!