এরিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব বা এরিস্টটলীয় রাষ্ট্রের কাজ, চিন্তা, প্রকৃতি এবং সমালোচনা

এরিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব (ইংরেজি: Aristotle’s theory of state) বা এরিস্টটলীয় রাষ্ট্রের কাজ, চিন্তা, প্রকৃতি এবং সমালোচনা হচ্ছে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিস্তারিত চিন্তাধারা। রাষ্ট্রর উৎপত্তি এবং প্রকৃতি বিষয়ে এরিস্টটলের চিন্তা রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে গণ্য হয়। ঈশ্বর রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন বা চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি একথা এরিস্টটল অস্বীকার করেন।

সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক

এরিস্টটল সমাজ (Society) এবং রাষ্ট্রের (state) মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন নি। সমাজের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই যাতে সর্বোচ্চ সুখলাভ করতে পারে তাই হলো সমাজ জীবনের মূল লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্য কিভাবে আয়ত্ত করা যায় তার ব্যবস্থা করাই সমাজের কার্য। এই জন্যই সমাজ বা রাষ্ট্রের স্থান পরিবার ও আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস ব্যক্তির পূর্বে। সুন্দর ও সুসমঞ্জস সমাজ জীবনই ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবনের পূর্ণ পরিণতি। ব্যক্তি ও পরিবার সমাজের অংশবিশেষ এবং সমাজই পূর্ণ সত্তাবিশিষ্ট। 

এরিস্টটলের মতে মানুষ মূলত একটি সামাজিক জীব (Man is a political animal)। অন্য মানুষদের সঙ্গে একত্র বাস করবার এবং সকল ক্ষেত্রে তাদের জীবনের অংশগ্রহণ করবার প্রবৃত্তি প্রত্যেক মানুষের মনেই অন্তর্নিহিত। কেবলমাত্র জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যক সামগ্রীগুলি আহরণ করবার জন্য নয়, পরন্তু মনুষ্য জীবনের সর্বোচ্চ ধরনের অভাবগুলিকে পরিতৃপ্ত করবার জন্যও সমাজ-জীবনের প্রয়োজন।

সুতরাং যৌক্তিক দৃষ্টিতে সমাজ বা রাষ্ট্রের স্থান ব্যক্তি ও পরিবারের পূর্বে। কিন্তু কালের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির স্থান পূর্বে এবং সমাজ বা রাষ্ট্রের স্থান পরে। কয়েকজন ব্যক্তি পরস্পরের অভাব মোচনে সাহায্য করবার জন্য মিলিত হয়ে একটি গ্রামীণ সমাজ গঠন করে, কতকগুলি গ্রাম একত্র মিলিত হয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করে। এরিস্টটল মনে করতেন রাষ্ট্র হলো কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষের সমবায়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান। সেই কারণে তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতামত ব্যক্ত করেন।

বহু ব্যক্তি ও পরিবার দ্বারা গঠিত সুসংহত প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্র। এরিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব রাষ্ট্রীয় ঐক্য সম্বন্ধে প্লেটোর মতবাদ এবং বিশেষত তার পরিকল্পিত সাম্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেছে এবং বলেছে যে, ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি এবং পরিবারের বিলোপ সাধন, অন্তত শাসকশ্রেণীর ক্ষেত্রে, সম্পর্কে প্লেটো যেসব যুক্তি দিয়াছেন সেগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের পক্ষে ঐক্য যে অতি প্রয়োজনীয় সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই ঐক্যের মধ্যে বিভেদের স্থানও থাকা চাই। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে যখন শক্তি, সামর্থ্য ও প্রবণতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রভেদ আছে তখন রাষ্ট্রের মাধ্যমে তাদের চারিত্রিক বিশেষত্বগুলি পূর্ণ বিকাশ লাভ করবে এটাই স্বাভাবিক। একটি রাষ্ট্র বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করবে(Unity in diversity)।

রাষ্ট্র সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করতে হলে রাষ্ট্রের প্রকৃত নাগরিক কারা তা নির্ণয় করতে হবে। এরিস্টটলের মতে রাষ্ট্রের অধিবাসীমাত্রই নাগরিক নয়। যারা রাষ্ট্রের বিধানসভায় (Assembly) যোগ দিয়ে রাষ্ট্রের কার্যে অংশগ্রহণ করবার অথবা বিচারালয়ে বিচারকের আসনে বসবার উপযুক্ত তারাই যথার্থ নাগরিক। সেইজন্য তাঁর মতে শ্রমজীবী, শিল্পী ও নিম্নশ্রেণীর ব্যবসা ও বাণিজ্যে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নাগরিক বলা উচিত নয়, কারণ বিধানসভা অথবা বিচারালয়ের কাজে অংশগ্রহণ করবার মত শিক্ষা বা অবসর তাদের নাই। আর ক্রীতদাসদের সম্বন্ধে বলা যেতে পারে যে, স্বাভাবিক নিয়মানুসারেই তারা কেবলমাত্র অন্য লোকদের সেবা করবারই উপযুক্ত সুতরাং তারা নাগরিক হতে পারে না।[১]

এরিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি

এরিস্টটল মনে করতেন প্রকৃতির বিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রর উৎপত্তি হয়েছে। তিনি বলেছেন, The state belongs to a class of objects which exists in nature, and that man is by nature a Political animal, it is his nature to live in a state. অর্থাৎ প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক উপায়ে রাষ্ট্রর সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের প্রকৃতি হলো রাষ্ট্রে বসবাস করা। সে প্রকৃতিগত ভাবে রাজনৈতিক জীব। সুতরাং তার রাজনৈতিক প্রবণতাই তাকে রাষ্ট্রীয় সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাজনৈতিক প্রাণী হিসেবে তার মধ্যে স্বাভাবিক প্রবণতা গড়ে না উঠলে রাষ্ট্রর উদ্ভব হতো না বলে তিনি মত ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতি প্রদত্ত মুক্তিবাদিতা, চেতনা, বুদ্ধি ও সাংগঠনিক গুণের জন্য মানুষের পক্ষে সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করা ও রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্রর উৎপত্তি সম্ভব হয়েছে।

এরিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব উল্লেখ করে রাষ্ট্র হলো উত্তম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষের সমবায়ে গঠিত সংস্থা। মানুষের সংঘবদ্ধ জীবনের প্রথম প্রকাশ ঘটে পরিবার গঠনের মাধ্যমে। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী নারী-পুরুষ পাশাপাশি বা একত্রে বসবাস করে। বংশ রক্ষা এবং বংশ বৃদ্ধির জন্য নারী-পুরুষ একত্রে বসবাস করে। পরিবার গঠনের পর মানুষ অনুভব করল কেবল পরিবারের দ্বারা সব প্রয়োজন পূর্ণ হচ্ছে না। তাই কতগুলি পরিবার নিয়ে গঠিত হলো গ্রাম, যা পরিবারের তুলনায় উন্নত সংগঠন এবং চাহিদা পূরণেও সক্ষম। গ্রামের মধ্যে থেকে মানুষ তার প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণ করতে পারছিল না। কারণ সমিতির জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের চাহিদারও ব্যপক বৃদ্ধি হয়, যার ফলশ্রুতি হিসেবে গ্রামের থেকে বৃহত্তর সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, বিবর্তনের তৃতীয় স্তরে গ্রামের সমষ্ঠিগত রূপ হিসেবে রাষ্ট্র আবির্ভূত হলো।

রাষ্ট্রর প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অ্যারিস্টটল মনে করেন, রাষ্ট্র যেহেতু একটি স্বাভাবিক সংগঠন তাই মানুষের সবরকম চাহিদার তৃপ্তিসাধন রাষ্ট্রের মাধ্যমেই সম্ভব। রাষ্ট্র ছাড়া স্বার্থের পূর্ণতা অন্য কোথাও সম্ভব নয়। রাষ্ট্র কেবল সর্বোচ্চ কল্যাণের প্রতীক নয়, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংগঠনও বটে। তিনি আরো মনে করেন, রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও অস্তিত্বের পিছনে রয়েছে উপযোগিতা। মানুষ তার বুদ্ধি ও চেতনা দিয়ে অনুভব করেছিল রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আছে, তাই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তি নিজের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে।[২]

তথ্যসূত্র

১. ড কল্যাণ চন্দ্র গুপ্ত, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮
২. গোবিন্দ নস্কর, রাষ্ট্রচিন্তা, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!