এপ্রিল থিসিসের থিসিসসমূহ

বর্তমান বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতের কাজ

৩ এপ্রিল রাত্রের আগে আমি পেত্রগ্রাদে পৌঁছই নি, কাজেই ৪ এপ্রিল সভায় আমি অবশ্য বৈপ্লবিক প্রলেতারিয়েতের কাজগুলি সম্বন্ধে বিবরণী দিতে পারি শুধু আমার নিজের তরফে এবং ঊন-প্রস্তুতিজনিত বাদসাদ দিয়ে।

ব্যাপারটাকে নিজের পক্ষে_ এবং সাধু বিরোধীদের পক্ষে_ অপেক্ষাকৃত সহজ করার জন্যে আমি শুধু  যা করতে পেরেছি সেটা হল এই যে, আমি থিসিস প্রস্তুত করেছি লিখিতভাবে। আমি সেগুলি প’ড়ে শুনিয়ে মূলপাঠ দিয়েছিলাম কমরেড সেরেতেলিকে। আমি সেগুলি পড়েছিলাম দু’বার খুব ধীরে ধীরে: প্রথমে বলশেভিকদের একটি সভায়, তারপরে বলশেভিক আর মেনশেভিক উভয়দের একটি সভায়

নিজের এই ব্যক্তিগত থিসিস আমি প্রকাশ করছি শুধু অতি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক মন্তব্যসহ, যেগুলি ঢের বেশি বিস্তারিতভাবে বিশদ করা হয়েছে বিবরণীতে।

থিসিসসমূহ

১. লুভোব এন্ড কোং এর নতুন সরকারের পুঁজিবাদী চরিত্রের কারণে যুদ্ধটা এই সরকারের অধীনে রাশিয়ার দিক থেকে প্রশ্নাতীতভাবে লুটেরা সম্রাজ্যবাদী যুদ্ধই রয়ে গেছে, সেহেতু এই যুদ্ধের প্রতি আমাদের মনোভাবের দিক থেকে তথাকথিত “বৈপ্লবিক প্রতিরক্ষাপন্থা”-কে সামান্যতম ছাড় দেওয়া চলবে না। বৈপ্লবিক প্রতিরক্ষাপন্থা যথার্থই সমর্থনীয় এমন একটা বিপ্লবী যুদ্ধকে শ্রেণীসচেতন প্রলেতারিয়েত সমর্থন দিতে পারে কেবলমাত্র দুটো শর্তে: (ক) ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে প্রলেতারিয়েত এবং প্রলেতারিয়েতর সাথে মৈত্রীবদ্ধ কৃষকদের সবচেয়ে গরিব অংশগুলোর হাতে; (খ) কথায় নয় কাজে সমস্ত পররাজ্য দখল বর্জন করা হবে। (গ) সকল প্রকার পুঁজিবাদী স্বার্থের সাথে বাস্তবে পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ ঘটান হবে।

ওই সব বৃহৎজন অংশ যারা বৈপ্লবিক প্রতিরক্ষাপন্থায় গণহারে বিশ্বাসী, যারা যুদ্ধটাকে পরদেশ দখলের উপায় হিসেবে গ্রহণ করেন না, যারা যুদ্ধটাকে নিতান্তই একটা আবশ্যকতা হিসেবে গ্রহণ করেন, তারা বুর্জোয়াদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন ঘটনা এমন হলে, বিশেষ স্পষ্টতার সাথে, অধ্যবসায় আর ধৈর্য সহকারে তাদের কাছে তাদের ভুল ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, পুঁজি এবং সম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মধ্যে বিদ্যমান অবিচ্ছেদ্য সংযোগ সম্পর্কটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, আর এটা প্রমাণ করা প্রয়োজন যে, পুঁজির উচ্ছেদ ব্যতিরেকে বলপ্রয়োগে চাপানো নয় এমন চরিত্রের যথার্থ শান্তি দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটান অসম্ভব।

যেসব ফ্রন্টে যুদ্ধটা চলছে সেখানে সৈন্যদের মধ্যে এই অভিমতের সপক্ষে সবচেয়ে জোরাল এবং বহুবিস্তৃত প্রচার অভিধান সংগঠিত করতে হবে।অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন।

২. রাশিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতির বিশেষত্ব হলো এই যে, প্রলেতারিয়েতের শ্রেণীচেতনা ও সংগঠন যথেষ্ঠ শক্তিশালী না থাকার কারণে বিপ্লবের প্রথম পর্বে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে বুর্জোয়াদের হাতে, এই পর্যায় অতিক্রম করে দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্বে, এই পর্বে ক্ষমতা অবশ্যই প্রলেতারিয়েত এবং কৃষকদের সবচেয়ে গরিব অংশগুলোর হাতে হস্তান্তরিত হবে।

এই উত্তরণ বিশিষ্টতা পেয়েছে, একদিকে এটা সর্বোচ্চ আইন সম্মত স্বীকৃত অধিকার সমৃদ্ধ হয়েছে (পৃথিবীতে সকল বিবদমান যুদ্ধরত দেশের মধ্যে রাশিয়া আজ সবচেয়ে স্বাধীন); অন্যদিকে জনগণের উপর বলপ্রয়োগ এখন অনুপস্থিত, আর সবশেষে শান্তি এবং সমাজতন্ত্রের নিকৃষ্ট শত্রু পুঁজিপতিদের সরকারের প্রতি তাদের প্রশ্নাতীত নির্বিচার আস্থা।

বিপুল সংখ্যক প্রলেতারীয় জনরাশি সবে রাজনৈতিক জীবনে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, যা অভূতপূর্বই বটে, এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি আমাদের কাছে দাবি করছে যে, তাদের মধ্যে পার্টি কাজের বিশেষ অবস্থার সাথে আমাদের নিজেদের মানিয়ে নিতে পারার মতো যথোপযুক্ত সামর্থ্যবান হতে হবে।

৩. সাময়িক সরকারের প্রতি কোন সমর্থনই তো নয়; বরং এই সরকারের সকল প্রতিশ্রুতি, বিশেষ করে (পরদেশ) দখল সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি ডাহা মিথ্যা, সেসব স্পষ্ট করে দিতে হবে। এই সরকার, যা পুঁজিপতিদেরই সরকার, সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা থেকে নিজেকে নিবৃত করবে, এই মর্মে অসমর্থনীয় ও মোহ জন্মানো “দাবি”-র জায়গায় এটার স্বরূপ উদঘাটন করতে হবে।

৪. এই বাস্তব অবস্থাটা উপলব্ধি করতে হবে যে, শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলির বেশির ভাগের মধ্যে আমাদের পার্টি সংখ্যালঘু, এখন অবধি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু, আর আমাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একটা জোট যেটার মধ্যে আছে সমস্ত পেটি-বুর্জোয়া সুবিধাবাদীরা, জনপ্রিয় সমাজতন্ত্রী এবং সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারি থেকে শুরু করে অরগানাইজিং কমিটি (চখেইজে, সেরেতেলি আরও সব), স্তেকলোভ, আরও অনেকে, যারা বুর্জোয়াদের প্রভাবের কাছে বশ্যতাস্বীকার করেছে এবং এই প্রভাবকে প্রলেতারিয়েতের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে।

জনগণকে এটা উপলব্ধি করাতে হবে যে, বর্তমান মুহুর্তে শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলিই হচ্ছে বিপ্লবী সরকারের একমাত্র সম্ভাব্য রূপ, সুতারাং যতদিন এই সরকার বুর্জোয়াদের প্রভাবের কাছে বশ্যতাস্বীকার করছে ততদিন আমাদের কাজ হলো ধৈর্যসহকারে অবিচলিত চিত্তে এবং অধ্যবসায়ের সাথে তাদের কর্মকৌশলের ভ্রান্তিগুলোর ব্যাখ্যা তুলে ধরা, যে ব্যাখ্যা জণগণের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব প্রয়োজনগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগৗ।

যতকাল আমরা সংখ্যালঘু হিসেবে রয়েছি আমরা তাদের সমালোচনা আর ভুলভ্রান্তি উদঘাটনের কাজ চালিয়ে যাব, একইসাথে শ্রমিক প্রতিনিধিদের হাতে সমগ্র রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দেওয়ার আবশ্যকতার কথা আমরা প্রচার করব, যাতে করে জনগণ তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের ভুলগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে।

৫. পার্লামেন্টারি প্রজাতন্ত্র নং- শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলি থেকে পার্লামেন্টারি প্রজাতন্ত্রে ফিরে যাওয়া হবে একটা পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ-আমরা চাই সারা দেশে তৃণমুল থেকে উপর পর্যন্ত শ্রমিক, ক্ষেতমজুর আর কৃষক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলির প্রজাতন্ত্র।

পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রের বিলোপসাধন। সকল কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়া চাই, তারা সবাই হবেন যেকোন সময় অপসারণযোগ্য, তাদের কারও বেতন একজন দক্ষ শ্রমিকের গড় মজুরি অতিক্রম করতে পারবে না।

৬. ভূমিবিষয়ক কর্মসূচীতে গুরুত্বের ভরকেন্দ্রটা ক্ষেতমজুর প্রতিনিধি সোভিয়েতের হাতে তুলে দিতে হবে। জমিদারদের সকল ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা প্রসঙ্গে।

দেশের সমস্ত ভূমির রাষ্ট্রীয়করণ সম্পন্ন করতে হবে, ভূমির বিলিব্যবস্থা স্থানীয় ক্ষেতমজুর এবং কৃষক সোভিয়েতগুলির হাতে হস্তান্তর করতে হবে। পৃথক পৃথক গরিব কৃষক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত গুলির নিয়ন্ত্রণাধীনে এবং সরকারী খরচে প্রত্যেকটা বৃহৎ ভূসম্পত্তিতে একটা আদর্শ খামার স্থাপন করতে হবে (স্থানীয় আর অন্যান্য অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এবং স্থানীয় সংস্থাগুলির সিদ্ধান্ত অনুসারে খামারের আকার ১০০ থেকে ৩০০ দেসিয়াতিনা হতে পারে।)

৭. অবিলম্বে দেশের সকল নিয়ন্ত্রণ থাকবে শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতের হাতে।

৮. বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্র “প্রবর্তন করা” আমাদের আশু কাজ নয়, বরং এই মুহুর্তে সামাজিক উৎপাদন এবং এসব উৎপাদিত জিনিস বিলিবন্টনের কাজ শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

৯. পার্টির করণীয়‍ঃ

(ক) অবিলম্বে পার্টি কংগ্রেস ডাকা;

(খ) পার্টি কর্মসূচীতে রদ বদল আনা, প্রধানত

  • সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রশ্নে;
  • রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের মনোভাব প্রসঙ্গে এবং “কমিউন রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের দাবির প্রশ্নে;
  • আমাদের সেকেলে সর্বনিম্ন কর্মসূচী সংশোধন প্রশ্নে;

(গ) পার্টির নাম পরিবর্তন।

১০. একটা নতুন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সোশ্যাল-শোভিনিস্টদের বিরুদ্ধে এবং “কেন্দ্র (Centre – মধ্যপন্থী) এর বিরুদ্ধে একটা বিপ্লবী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অবশ্যই আমাদের নিতে হবে।

একটা মুক্তো নয় কি ?

আমি লিখেছি ঘোষণা করেছি এবং বিস্তারিতভাবে অর্থ করে বলেছি : ‘বৈপ্লবিক প্রতিরক্ষাপন্থায় গণবিশ্বাসীদের বিভিন্ন অংশ যারা… তাদের সততা তর্কাতীত এতদ্দৃষ্টে, তারা বুর্জোয়াদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে এতদ্দৃষ্টে, বিশেষ সম্যকরূপে, অধ্যবসায় আর ধৈর্য সহকারে তাদের কাছে তাদের ভুল ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন…’

তবু যে বুর্জোয়া ভদ্রলোকেরা নিজেদের বলেন সোশ্যাল-ডেমোক্রাট, যাঁরা বিস্তৃত অংশগুলি কিংবা প্রতিরক্ষাপন্থায় গণবিশ্বাসী কোনটাই মানুষ নন, তাঁরা অম্লানবদনে আমার অভিমতটাকে হাজির করেছেন এইভাবে : ‘গৃহযুদ্ধের ঝান্ডা’ (!) (যে সম্বন্ধে একটা কথাও নেই থিসিসগুলিতে, একটা কথাও নেই আমার বক্তৃতায়!) ‘পুঁতে দেওয়া হয়েছে (!) বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের মাঝে (!!)’।

এর অর্থটা কী ? দাঙ্গা-উসকানো উত্তেজনা ছড়ান থেকে, ‘রুস্স্কায়া ভোলিয়া’ থেকে এটা পৃথক কিসে?

আমি লিখেছি, ঘোষণা করেছি এবং বিস্তারিতভাবে অর্থ করে বলেছি : ‘শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলিই একমাত্র সম্ভাব্য আকারের বৈপ্লবিক সরকার, কাজেই… আমাদের কাজ হল তাদের কর্মকৌশলের ভ্রান্তিগুলোর ধৈর্যশীল, প্রণালীবদ্ধ এবং অধ্যবসায়ী ব্যাখ্যা হাজির করা, যে-ব্যাখ্যাটা জনগণের কার্যগত প্রয়োজনগুলির পক্ষে বিশেষভাবে উপযোগী।’

অথচ কোন একটা মার্কার বিরোধীরা আমার অভিমতটাকে হাজির করছে ‘বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের মাঝে গৃহযুদ্ধে’র আহ্বান হিসেবে!!

সংবিধান-সভা ডাকার আশু তারিখ কিংবা আদৌ কোন তারিখ সাময়িক সরকার ধার্য করে নি এবং শুধু প্রতিশ্রুতিতেই গন্ডিবদ্ধ থেকেছেন বলে আমি সেটাকে আক্রমণ করেছি। আমি এই যুক্তি তুলেছি যে, শ্রমিক এবং সৈনিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলি ব্যতিরেকে সংবিধান-সভা অর্থাৎ জার্মানিতে কাউটস্কি অ্যান্ড কোং, ফ্রান্সে ল’গে অ্যান্ড কোং, রাশিয়ায় চ্খেইজে অ্যান্ড কোং, ইতালিতে তুরাতি অ্যান্ড কোং, বৃটেনে ম্যাকডোনাল্ড অ্যান্ড কোং, ইত্যাদি।

ডাকা নিশ্চিত নয়, সেটার সাফল্য অসম্ভব।

অথচ আমাকে এই অভিমত আরোপ করা হয়েছে যে, আমি চটপটে সংবিধান-সভা ডাকার বিরোধী !!!

দশকের পর দশকের রাজনৈতিক সংগ্রাম আমাকে যদি প্রতিরক্ষীয়দের মাঝে সততাকে বিরল ব্যতিক্রম বলে বিবেচনা করতে না শেখাত তাহলে ওটাকে আমি বলতাম ‘বাতুলের প্রলাপ’।

মি. প্লেখানভ তাঁর কাগজে আমার বক্তৃতাটাকে বলেছেন ‘বাতুলের প্রলাপ’। বহুত আচ্ছা, মি. প্লেখানভ! কিন্তু দেখুন, নিজ তর্কযুদ্ধে আপনি কতখানি বেঢপ, জবুথুবু এবং জড়বুদ্ধি। আমি যদি দু’ঘন্টা ধরে বাতুলের প্রলাপের বক্তৃতা করে থাকি তাহলে শত শত মানুষের শ্রোতৃমন্ডলী সেই ‘বাতুলের প্রলাপ’ বরদাস্ত করল, এটা কী ব্যাপার? এবং তারপর। আপনার কাগজ এই ‘বাতুলের প্রলাপ’ নিয়ে গোটা কলম কেন? স্বয়ংবিরুদ্ধ খুবই স্বয়ংবিরুদ্ধ!

প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে এবং যে রকমের রাষ্ট্র প্রলেতারিয়েতের চাই সে-সম্বন্ধে মার্কস এবং এঙ্গেলস কী বলেছিলেন ১৮৭১, ১৮৭২ এবং ১৮৭৫ সালে সেটা বিবৃত করা, ব্যাখ্যা করা, অনুসরণ করার চেষ্টার চেয়ে চিৎকার করা, গালি দেওয়া এবং আর্তনাদ করা অনেকে সহজই বটে।

প্রাক্তন মার্কসবাদী মি. প্লেখানভের স্পষ্টতই মার্কসবাদ অনুসরণ করার গরজ নেই।

রোজা লুক্সেমবুর্গ ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট১০ জার্মান সোশ্যাল-ডেমোক্রাসিকে বলেছিলেন ‘দুর্গন্ধী লাশ’, তাঁর কথা আমি উদ্ধৃত করেছিলাম। তাতে প্লেখানভগণ, গোলেদনবের্গগণ অ্যান্ড কোং ‘অসন্তুষ্ট হয়েছেন’। কাদের তরফে? জার্মান শোভিনিস্টদের তরফে, কেননা তাদের শোভিনিস্ট বলা হয়েছে!

তালগোল পাকান অবস্থায় পড়ে গেছে তারা, এই বেচারা রুশী সোশ্যাল-শোভিনিস্টরা কথায় সমাজতন্ত্রী, আর কাজে শোভিনিস্ট।

১৯১৭ সালে ৪ আর ৫ (১৭ আর ১৮) এপ্রিল লেখা; প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালের ৭ এপ্রিল ২৬ নং ‘প্রাভদা’য়; ৩১ খন্ড, পৃষ্ঠা ১১৩-১১৮।

নোটসমূহ:

১. ন. লেনিন স্বাক্ষরিত এবং ১৯১৭-এর ৭ এপ্রিল ‘প্রাভদা’র ২৬ নং সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বর্তমান বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতের কাজ’ প্রবন্ধে এই বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ প্রকাশিত হয়। এটি পেত্রগ্রাদ পথে লেনিন সম্ভবত ট্রেনে লেখেন।

১৯১৭-এর ৪(১৭) এপ্রিল তাউরিদা প্রাসাদে অনুষ্ঠিত দুটি সভায় তিনি (বলশেভিকদের একটি সভায় এবং শ্রমিক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলির সর্ব-রাশিয়া সম্মেলনের বলশেভিক ও মেনশেভিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলির সর্ব-রাশিয়া সম্মেলনের বলশেভিক ও মেনশেভিক প্রতিনিধিদের একটি যুক্ত অধিবেশনে) থিসিসগুলি পড়েন।

প্রবন্ধগুলি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল এই সব বলশেভিক সংবাদপত্রে: ‘সৎসিয়াল-দেমোক্রাত’ (মস্কো), ‘প্রলেতারি’ (খারকভ), ‘ক্রাস্নয়ারস্কি রাবোচি’ (ক্রাস্নয়ার্স্ক), ‘ভ্পেরিওদ’ (উফা), ‘বাকিন্স্কি রাবোচি’ (বাকু), ‘কাভকাজস্কি রাবোচি’ (তিফলিস, আজকাল ত্বিলিসি) প্রভৃতি।

২. মেনশেভিকরা ছিলো রুশ সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক আন্দোলনের একটি পেটি-বুর্জোয়া, সুবিধাবাদী ধারার অনুসারী।

(৩) জন-সমাজতন্ত্রীরা হচ্ছে ১৯০৬ সালে সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারি পার্টির দক্ষিণপন্থীদের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া পেটি-বুর্জোয়া শ্রম-সমাজতন্ত্রী পার্টির সদস্যবর্গ। এরা সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের আওতায় মধ্যম ধরনের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়া জানাত। তারা সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারিদের কর্মসূচী মোতাবেক জমি সামাজিকীকরণের দাবি ত্যাগ করেছিল, কিন্তু খেসারত সহ বাধ্যতামূলক জমিদারি হস্তান্তর সমর্থন করেছিল। এই পার্টি নেতৃবৃন্দের মধ্যে আ. ভ. পেশেখোনভ, ভ. আ. মিয়াকোতিন ও ন. ফ. আনেন্স্কি, প্রমুখ উল্লেখ্য।

ফেব্রুয়ারি বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর জন-সমাজতন্ত্রীদের পার্টি সক্রিয়ভাবে অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকারকে সমর্থনসহ প্রতিবিপ্লবী শিবিরে যোগদান করে।

সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারিরা ১৯০১ সালের শেষে ও ১৯০২ সালের গোড়ার দিকে গঠিত একটি পেটি-বুর্জোয়া পার্টি। তারা জমিদারি উচ্ছেদ সহ ‘শ্রমনীতির ভিত্তিতে ভূমিস্বত্বে সমতাবাদ’ দাবি করত। সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারিরা প্রলেতারিয়েত ও কৃষকদের মধ্যে শ্রেণীগত পার্থক্য স্বীকার করত না। তারা কৃষকসমাজের মধ্যেকার শ্রেণীগত অন্তর্দ্বন্দ্বের অর্থ কম করত এবং বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতের অগ্রগামী ভূমিকায় অবিশ্বাসী ছিল। সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারিরা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের আশ্রয় নিত। ১৯০৫-১৯০৭ সালের বিপ্লবের ব্যর্থতার পর এর অধিকাংশ সদস্যই বুর্জোয়া উদারনৈতিক হয়ে ওঠে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারি নেতারা অস্থায়ী সরকারে যোগ দেয়। তারা কৃষক আন্দোলন দমন এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উদ্যোগী শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বুর্জোয়া ও জমিদারদের মদদ যোগায়। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের পর সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারিরা সোভিয়েতরাজের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া ও জমিদারদের সংগঠিত প্রতিবিপ্লবী সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে।

সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয় ১৯১২ সালে মেনশেভিক লুপ্তিপন্থীদের এবং পার্টি বিরোধী অন্যান্য দল ও ধারার আগস্ট সম্মেলনে। ১৯১৭ সালে মেনশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হওয়ার আগ অবধি এটি মেনশেভিক কেন্দ্র হিসাবে কাজ করেছিল।

৪. ১ দেসিয়াতিনা ১.০৯ হেক্টর সমান। -সম্পাঃ

৫. অর্থাৎ এমন রাষ্ট্র যেটার আদিরূপ হল প্যারিস কমিউন

৬. ‘সোশ্যাল ডেমোক্রাসি’র সরকারি নেতারা পৃথিবীর সর্বত্র সমাজতন্ত্রের প্রতি বেইমানি করেছে এবং পালিয়ে চলে গেছে বুর্জোয়াদের পক্ষে (‘প্রতিরক্ষাপন্থীরা’ এবং দোদুল্যম্যান ‘কাউৎস্কিপন্থীরা’)। সেটার বদলে আমাদের নাম বলতে হবে কমিউনিস্ট পার্টি।

৭. আন্তর্জাতিক সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক আন্দোলনে ‘মধ্যস্থল’ হল শোভিনিস্টদের (=‘প্রতিরক্ষাপন্থীদের’) এবং আন্তর্জাতিকবাদীদের মধ্যে দোদুল্যমান মতধারা বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে সাধু বিরোধীদের ‘ব্যাপার’টার উপর আমাকে বিশেষ জোর দিতে হল কেন পাঠক যাতে বুঝতে পারেন সেজন্য আমি উল্লিখিত থিসিসগুলির সঙ্গে মিঃ গোলেদনবর্গের নিম্নলিখিত আপত্তিটাকে তুলনা করতে পাঠককে অনুরোধ করছি:

তিনি বলেছেন, লেনিন ‘বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের মাঝে পুঁতে দিয়েছেন গৃহযুদ্ধের ঝান্ডা’ (মিঃ প্লেখানভের ‘ইয়েদিনস্ত্ভো’১১-র ৫ নং সংখ্যায় উদ্ধৃত)।

৮. ‘রুস্স্কায়া ভোলিয়া’ (‘রুশী স্বাধীনতা’)_ জারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আ. দ. প্রতপোপভ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও বড় বড় ব্যাঙ্কমালিকদের অর্থে চালিত বুর্জোয়া দৈনিক সংবাদপত্র : এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে, পেত্রগ্রাদে। ফেব্রুয়ারি ১৯১৭ সালের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর কাগজটি বলশেভিকদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে থাকে। ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর বিপ্লবী সামরিক পরিষদ এটি বন্ধ করে দেয়।

৯. দ্রষ্টব্য, মার্কস ও এঙ্গেলস, ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’, ১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা’; কার্ল মার্কস, ‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ।

আন্তর্জাতিক মেহনতি, মানুষের সম্মেলনের সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণ’, ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা; ১৮৭৫ সালের ১৮-২৮ মার্চ বেবেল’কে লিখিত এঙ্গেলসের পত্র। ১৮৭১ সালের ১২ ও ১৭ এপ্রিল কুগেলমানকে লেখা মার্কসের পত্র। (ক. মার্কস, ফ. এঙ্গেলস_ ৩ খন্ডে প্রকাশিত ‘নির্বাচিত রচনাবলী’, ১ম খন্ড, মস্কো, ১৯৬৯, পৃ. ৯৮-৯৯; ২য় খন্ড, পৃ. ২১৭-২৩৪; ৩য় খন্ড, মস্কো, ১৯৭০, পৃ. ১৩-৩৭; ২য় খন্ড, পৃ. ৪২০-৪২২; ‘নির্বাচিত পত্রাবলী,’ মস্কো, ১৯৬৫, পৃঃ ২৯০-২৯৬)।

১০. ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট জার্মানির রাইখস্টাগের সোশ্যাল-ডেমোক্রাটরা দ্বিতীয় ভিলহেল্ম সরকারকে যুদ্ধঋণ দানের সপক্ষে ভোট দেয়।

১১. ‘ইয়েদিনস্ত্ভো’ (‘ঐক্য’) ছিল প্লেখানভের নেতৃত্বাধীন মেনশেভিক প্রতিরক্ষাবাদীদের চরম দক্ষিণপন্থী অংশের মুখপত্র, পেত্রগ্রাদ থেকে প্রকাশিত। ১৯১৪ সালের মে-জুন মাসের মধ্যে কাগজের চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১৭ সালের মার্চ-নভেম্বরে কাগজটি দৈনিক হিসাবে প্রকাশিত হয়। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কাগজটি ‘নাশে ইয়েদিনস্ত্ভো’ (‘আমাদের ঐক্য’) নামে প্রকাশিত হতে থাকে। এটি অস্থায়ী সরকারকে সমর্থন করত, বুর্জোয়াদের সঙ্গে ঐক্যের কথা, ‘অটল শক্তির’ কথা বলত। বলশেভিকদের আক্রমণের ক্ষেত্রে কাগজটি প্রায়ই সাংবাদিকতার নিয়ম-কানুন মানত না। অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে চরম শত্রুতামূলক ভূমিকা পালন করেছিল।

Leave a Comment

error: Content is protected !!