এপ্রিল থিসিস (ইংরেজি: April Theses, রুশ: апрельские тезисы) ছিল বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন প্রদত্ত দিকনির্দেশক প্রতিপাদ্য। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বিজয়ের পর এক বিশেষ পরিস্থিতিতে সুইজারল্যান্ডে দীর্ঘ নির্বাসন জীবনের শেষে এপ্রিলের ৩ তারিখ রাত্রে লেনিন রাশিয়ায় ফিরে আসেন।
পেত্রোগ্রাদে পৌঁছে তিনি তাৎক্ষনিকভাবেই অপেক্ষমাণ শ্রমিক ও সৈনিক জনগণের সামনে এক ছোট্ট কিন্তু বিখ্যাত ভাষণ দেন; উক্ত ভাষণে তিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে বিজয় অর্জনের আহ্বান জানান। সেটিই এপ্রিল থিসিস নামে পরিচিত। পরদিন ৪ঠা এপ্রিল প্রথমে বলশেভিকদের এক বৈঠকে এবং পরে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের এক যৌথ সভায় যুদ্ধ ও বিপ্লব সম্পর্কে তিনি এক রিপোর্ট প্রদান করেন যা তার বক্তৃতাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রদান করে।[১]
এপ্রিল থিসিস-এর মূল বিষয়
এপ্রিল থিসিসে লেনিন পার্টি ও প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সামনে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণের জন্য এক মূর্ত ও তত্ত্বগতভাবে বিস্তৃত সংগ্রামের পরিকল্পনা হাজির করেন। সেই থিসিসে তিনি প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক রূপ হিসেবে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আওয়াজ উপস্থাপন করেন। তিনি তার এপ্রিল থিসিসের বক্তব্যকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন ‘রণকৌশল সম্পর্কে পত্রাবলি’, ‘আমাদের বিপ্লবে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির কর্তব্য’ এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক দলসমূহ ও প্রলেতারিয়েত শ্রেণির কর্তব্য’ শীর্ষক নিবন্ধাবলিতে।[১] এপ্রিল থিসিসেই লেনিন সর্বপ্রথম পার্টির নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন। এ প্রসঙ্গে পাদটীকায় তিনি বলেন,
“যে সমাজ গণতন্ত্রের সরকারি নেতারা দুনিয়ার সর্বত্র সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং বুর্জোয়াদের স্বপক্ষে দলত্যাগ করেছে, … সেই সমাজ গণতন্ত্রের বদলে আমাদের এখন অবশ্যই নিজেদের অভিহিত করতে হবে কমিউনিস্ট পার্টি বলে”।[২]
এপ্রিল থিসিসের মধ্য দিয়েই তিনি মুলত তৎকালীন বলশেভিক পার্টির রাজনৈতিক অবস্হান ও পরবর্তিতে করণীয়গুলো বিশদভাবে তুলে ধরেন। সুতরাং এপ্রিল থিসিস ছিল লেনিন কর্তৃক একটি বিশদ কর্মপরিকল্পনা। আর এ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণার পরপরই লেনিনের প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
এপ্রিল থিসিসের মুল বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করে লেনিন বলেন, ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার বিপ্লবের প্রথম পর্বের সমাপ্তি হয়েছে। এ পর্বে প্রলেতারিয়েতের শ্রেণী চেতনা ও সংগঠন না থাকায় দেশে ক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে পড়েছে এবং এখানেই এ পর্বের শেষ। বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয় পর্বে গরিব কৃষকের সংগে মৈত্রীবদ্ধ প্রলেতারিয়েতের হাতে ক্ষমতা আসলে এই পর্ব শেষ হবে।
সংক্ষিপ্ত রূপে এপ্রিল থিসিস
থিসিসসমূহে লেনিন বলেন,
১. সাময়িক সরকার পুঁজিবাদী চরিত্রের কারণে বুর্জোয়া সরকার এবং সেই সরকারকে সামান্যতম সমর্থন করা চলবে না। সরকারকে সামান্যতম ছাড় দেওয়া চলবে না। বরং সাময়িক সরকারের পরদেশ দখল সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি ডাহা মিথ্যা তা স্পষ্ট করে দিতে হবে। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে পররাজ্যগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে অভিযুক্ত করেন।
২. রাশিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতির বিশেষত্ব হলো এই যে, প্রলেতারিয়েতের শ্রেণীচেতনা ও সংগঠন যথেষ্ঠ শক্তিশালী না থাকার কারণে বিপ্লবের প্রথম পর্বে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে বুর্জোয়াদের হাতে, এই পর্যায় অতিক্রম করে দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্বে, এই পর্বে ক্ষমতা অবশ্যই প্রলেতারিয়েত এবং কৃষকদের সবচেয়ে গরিব অংশগুলোর হাতে হস্তান্তরিত হবে।
৩. এই বাস্তব অবস্থাটা উপলব্ধি করতে হবে যে, শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলির বেশির ভাগের মধ্যে আমাদের পার্টি সংখ্যালঘু, এখন অবধি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু, আর আমাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একটা জোট যেটার মধ্যে আছে সমস্ত পেটি-বুর্জোয়া সুবিধাবাদীরা, জনপ্রিয় সমাজতন্ত্রী এবং সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারি থেকে শুরু করে অরগানাইজিং কমিটি (চখেইজে, সেরেতেলি আরও সব), স্তেকলোভ, আরও অনেকে, যারা বুর্জোয়াদের প্রভাবের কাছে বশ্যতাস্বীকার করেছে এবং এই প্রভাবকে প্রলেতারিয়েতের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে।
জনগণকে এটা উপলব্ধি করাতে হবে যে, বর্তমান মুহুর্তে শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলিই হচ্ছে বিপ্লবী সরকারের একমাত্র সম্ভাব্য রূপ, সুতারাং যতদিন এই সরকার বুর্জোয়াদের প্রভাবের কাছে বশ্যতাস্বীকার করছে ততদিন আমাদের কাজ হলো ধৈর্যসহকারে অবিচলিত চিত্তে এবং অধ্যবসায়ের সাথে তাদের কর্মকৌশলের ভ্রান্তিগুলোর ব্যাখ্যা তুলে ধরা, যে ব্যাখ্যা জণগণের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব প্রয়োজনগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
৪. শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলি থেকে পার্লামেন্টারি প্রজাতন্ত্রে ফিরে যাওয়া হবে একটা পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ-আমরা চাই সারা দেশে তৃণমুল থেকে উপর পর্যন্ত শ্রমিক, ক্ষেতমজুর আর কৃষক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলির প্রজাতন্ত্র।
৫. পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রের বিলোপসাধন। সকল কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়া চাই, তারা সবাই হবেন যেকোন সময় অপসারণযোগ্য, তাদের কারও বেতন একজন দক্ষ শ্রমিকের গড় মজুরি অতিক্রম করতে পারবে না।
৬. ভূমিবিষয়ক কর্মসূচীতে গুরুত্বের ভরকেন্দ্রটা ক্ষেতমজুর প্রতিনিধি সোভিয়েতের হাতে তুলে দিতে হবে। জমিদারদের সকল ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
দেশের সমস্ত ভূমির রাষ্ট্রীয়করণ সম্পন্ন করতে হবে, ভূমির বিলিব্যবস্থা স্থানীয় ক্ষেতমজুর এবং কৃষক সোভিয়েতগুলির হাতে হস্তান্তর করতে হবে। পৃথক পৃথক গরিব কৃষক প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলির নিয়ন্ত্রণাধীনে এবং সরকারী খরচে প্রত্যেকটা বৃহৎ ভূসম্পত্তিতে একটা আদর্শ খামার স্থাপন করতে হবে।
৭. অবিলম্বে দেশের সকল নিয়ন্ত্রণ থাকবে শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতের হাতে।
৮. দেশের সকল ব্যাংকের একত্রীকরণ সন্নিহিত করা এবং সেগুলোর সমন্বয়ে একটি একক জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ থাকবে সোভিয়েত শ্রমিকদের ডেপুটিদের কাছে।
৯. পার্টির করণীয় হিসেবে বলেন, (ক) অবিলম্বে পার্টি কংগ্রেস ডাকা; (খ) পার্টি কর্মসূচীতে রদ বদল আনা, প্রথমত সম্রাজ্যবাদ এবং সম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রশ্নে; দ্বিতীয়ত “কমিউন রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে, তৃতীয়ত সেকেলে সর্বনিম্ন কর্মসূচী সংশোধন প্রশ্নে এবং চতুর্থত, পার্টির নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে।
১০. একটা বিপ্লবী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা করা হবে যা পরে Comintern বা তৃতীয় আন্তর্জাতিক হিসেবে ১৯১৯ সালে গঠিত হয়।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. ভি. আই. লেনিন; সর্বহারা বিপ্লব ও দলদ্রোহী কাউৎস্কী; সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা; ডিসেম্বর, ১৯৯০
২. লেনিন, সম্পূর্ণ রচনাবলী, ২৪ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪
৩. ভি. আই. লেনিন; এপ্রিল থিসিস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ৫-৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।