গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র সাম্যবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ বিরোধী একজন ভাববাদী চিন্তাবিদ। তিনি এমন এক প্রতিক্রিয়াশীল লেখক যিনি সারা জীবন বিপ্লবের বিরোধীতা করে গেছেন। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর তাঁর পোশাক থেকে শুরু করে সমস্ত কর্মকাণ্ড হয়ে পড়েছিল ধর্মযাজকের মতো। তিনি প্রাচ্য ভারতের মহিমা প্রচার করার চেষ্টা করেছেন, ভাববাদে ডুবে থেকেছেন এবং বিদেশের মাটিতে প্রাপ্য সম্মানকে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের মহিমায় উপজীব্য করতে চেয়েছেন।

পরাভূত দেশের ক্রীতদাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রথম ধরা পড়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চোখে। আফিম যুদ্ধ নিয়ে চীনারা বিরক্ত ছিলো, তরুণ মাও সেতুং-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা সাবধান করে দিলেন অল্প বয়সীদের, সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে নব কীর্তিত প্রাচ্য সভ্যতার কিছুই তারা চান না।

কমিউনিস্ট পার্টির রবীন্দ্র বিরোধীতা এমনই প্রকাশ্য হয়ে দাঁড়ালো যে, কোনো কোনো অসহযোগে খানিকটা থমকে গেলেন রবি। এমনকি বাতিল করে দিতে হলও তাঁর পূর্বঘোষিত কয়েকদিনের সভা। সাংহাই বা পিকিংয়ের বাজে অভিজ্ঞতার পর এই ভাববাদী কবিকে হ্যাংকাও পৌছে শুনতে হলো এই রূঢ় চীৎকার, ‘ফিরে যাও, পরাভূত দেশের ক্রীতদাস, ফিরে যাও’।[১] ব্রিটিশ বিরোধীতা তীব্রভাবে কখনওই করতে সক্ষম হননি রবীন্দ্রনাথ। ফলে চীনা পার্টি তাঁকে সঠিকভাবেই মূল্যায়ন করে ‘পরাভূত দেশের ক্রীতদাস’ হিসেবে।

গণতন্ত্র বিরোধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণতন্ত্র বিরোধী ছিলেন এবং সামন্তবাদের সমর্থক এই কবি, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষক জমির মালিক হন। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন কৃষকের জমির মালিকানার বিরোধী ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর এক প্রবন্ধের উত্তরে লেখা ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন-

“তুমি বলছ, জমি চাষ করে যে জমি তারই হওয়া উচিত। কিন্তু যারা নিজেকে রক্ষা করতে পারে না তারা জমি রক্ষা করবে কিভাবে? জমি যাবে মহাজনের হাতে তৈরি হবে নতুন জমিদার এতে জমিদারের ক্ষতির চেয়ে রায়তের ক্ষতি অধিক হবে।”

রায়তের কথা

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন কৃষককে জমির অধিকার দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং তাঁর কাছে মনে হয়েছিল সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করবে। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল রায়তদের বা কৃষকদের স্বার্থবোধ এবং জমিদারের স্বার্থবোধ একই বিষয়বুদ্ধি থেকে উদ্ভূত।[২] তিনি সারা জীবন প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার পার্থক্য বুঝতে অসমর্থ ছিলেন। তিনি কৃষককে চাষাভুষা হিসেবে সম্বোধন করতেন, তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে তিনি মহান কৃষকদের মনে করতেন মূর্খ বা অশিক্ষিত। এমন ভাবনাও তার ভেতরে ছিল যে তাদের নিজেদেরকে বাঁচাবার শক্তি নেই। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এই শত্রু রীতিমত কৃষকদের জমির মালিকানাকে আত্মহত্যার সাথে তুলনা করেছিলেন। তিনি লিখেছেন,

আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা তাতে বলতে পারি, আমাদের দেশের মূঢ় রায়তদের জমি অবাধে হস্তান্তর করবার অধিকার দেওয়া আত্মহত্যার অধিকার দেওয়া। … … আসল কথা, যে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে জানে না কোনো আইন তাকে বাঁচাতে পারে না।

রায়তের কথা

রবীন্দ্রনাথের এই ভুয়া রাজনৈতিক চিন্তা এখন পড়লে আশ্চর্য হতে হয়। জমির অধিকারকে তার কাছে কাড়াকাড়ি মনে হয়েছিল, এবং এই কাড়াকাড়িকে বনবিড়ালের কাড়াকাড়ি মনে হয়েছিল। এইভাবে তিনি গণতন্ত্র বিরোধীতা থেকে উপস্থিত হন সাম্যবাদ বিরোধিতায়।

কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত শুনুন ও সেখুন

সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদবিরোধী রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাষ্ট্রচিন্তা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। তিনি বিভিন্ন সময় তার চিন্তা প্রকাশ করেছেন বলশেভিকবাদ এবং আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সমাজতন্ত্র নামে যে প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার বই লিখেছেন লেখক অমরেশ দাশ তার প্রথম পৃষ্ঠাতে দুবার এই কথা লিখেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ সমাজতন্ত্রী ছিলেন না বা তিনি সমাজতন্ত্রে আকৃষ্ট হননি।[৩] সামন্তবাদের পক্ষে থাকতে গিয়ে তাকে স্বাভাবিকভাবেই সাম্যবাদের শত্রু হতে হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ রায়তের কথা নামে যে চিঠি লিখেছেন প্রমথ চৌধুরীকে, যা তাঁর কালান্তর গ্রন্থে সংকলিত আছে, সেই প্রবন্ধটি আগাগোড়া সাম্যবাদবিরোধী। যেমন তিনি লিখেছেন,

ইদানীং পশ্চিমে বলশেভিজম, ফ্যাসিজম প্রভৃতি যে-সব উদযোগ দেখা দিয়েছে, আমরা তার কার্যকারণ তার আকারপ্রকার স্পষ্ট বুঝি তা নয়। কেবল মোটের উপর বুঝেছি যে, গুণ্ডাতন্ত্রের আখড়া জমল। অমনি আমাদের নকলনিপুণ মন গুণ্ডামিটাকেই সবচেয়ে বড়ো করে দেখতে বসেছে। …

রাশিয়ার জার-তন্ত্র ও বলশেভিক-তন্ত্র একই দানবের পাশমোড় দেওয়া। পূর্বে যে ফোড়াটা বাঁ হাতে ছিল আজ সেটাকে ডান হাতে চালান করে দিয়ে যদি তাণ্ডবনৃত্য করা যায়, তাহলে সেটাকে বলতেই হবে পাগলামি।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রায়তের কথা, আষাঢ়, ১৩৩৩

রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক বিষয়ে এমনি অদক্ষ এবং মূর্খ যে তিনি রাশিয়ার জারতন্ত্র এবং বলশেভিকবাদের পার্থক্য বোঝার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছিলেন; ঠিক একইভাবে বলশেভিকবাদ এবং ফ্যাসিবাদকে একই জিনিস ভেবেছেন। এরকমই সাম্রাজ্যবাদের প্রচারণাকে গিলেছেন তিনি, মগজকে খাটাননি।

রাশিয়া ঘুরে আসার পরে রাশিয়ার চিঠি লিখেছেন, অনেক প্রশংসা করে ফেলেছিলেন সোভিয়েতের, আবার প্রকাশ্যে তো বলশেভিকবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সমস্যা ছিল, জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু গোপনে মনে মনে সাম্যবাদবিরোধী থেকেছেন সারা জীবন। যেমন ঠাকুর ৩১ শে জুলাই, ১৯৩১ তারিখে দৌহিত্র নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে লিখেছেন

‘নীতু, তোর চিঠি পেয়ে খুসি হলুম। জর্ম্মানিতে ব্যাভেরিয়ার ভাবগতিক ভালো লাগচে না। যেখানে দারিদ্র্যে মানুষ দুর্ব্বল, সেখানেই যেমন মারী মড়ক জোর পায় তেমনি আজকালকার য়ুরোপে দুর্ভিক্ষ যতই ছড়িয়ে পড়চে ততই ফ্যাসিজম এবং বলশেভিজম জোর পেয়ে উঠচে। দুটোই অস্বাস্থ্যের লক্ষণ।

……

বলশেভিজম ভারতে ছড়াবে বলে আশঙ্কা হয়—কেননা অন্নকষ্ট অত্যন্ত বেড়ে উঠেচে—মরণদশা যখন ঘনিয়ে আসে, তখন এরা যমের দূত হয়ে দেখা দেয়। মানুষের পক্ষে মানুষ যে কি ভয়ঙ্কর তা দেখলে শরীর শিউরে ওঠে।

……

আর যাই করিস এইসব মানুষখেগো দলের সঙ্গে খবরদার মিশিসনে। য়ুরোপ আজ সব দিকেই প্রতিবাদ করতে বসেচে। আমাদের দেশের লোক—বিশেষ বাঙালি—আর কিছু না পারুক, নকল করতে পারে—তাদের অনেকে আজ য়ুরোপের ব্যামোর নকল করতে লেগেচে। এই নকল মড়কের ছোঁয়াচ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলিস।

…..

নিশ্চয় তোদের ওখানে এই সমস্ত দানোয়-পাওয়া ভারতবাসী অনেক আছে। তাদের কাছে ভিড়িসনে, আপন মনে কাজ করে যাস।”[৪]

পুরোপুরি যুক্তিতাড়িত না হলেও এই কবি আবেগের প্রাবল্যে ভেসে যাননি। রাজনীতিক না হয়েও রাজনীতি বিষয়ে সারা জীবন লিখেছেন এবং রাজনীতি সংক্রান্ত ভুল চিন্তা জনগণের মাঝে প্রোথিত করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ও জাতিসমূহের স্বাধীনতার শত্রু সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে কিছুদিন কবিতা লিখে শেষে সেই সংগঠন ছেড়ে দেন, কিন্তু বিপ্লবীদের সারা জীবন বিরোধীতা করেছিলেন।

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র

১. শঙ্খ ঘোষ, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, অষ্টম সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ২২
২. অমরেশ দাশ, রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সমাজতন্ত্র, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, শ্রাবণ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৪
৩. অমরেশ দাশ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১।
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ৩১ জুলাই ১৯৩১, রবীন্দ্রসমগ্র খণ্ড ২২, নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা ১৩ নং পত্র, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৬৭-৬৮। 

Leave a Comment

error: Content is protected !!