চীনা সমাজের শ্রেণি বিশ্লেষণ

মার্চ ১৯২৬


কমরেড মাও সেতুং এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে। সে সময়ে পার্টির ভেতরে যে দু’ধরনের বিচ্যুতি ছিলো, তার বিরোধিতা করার জন্যই তিনি এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। তৎকালে পার্টির ভেতরকার প্রথম বিচ্যুতির প্রবক্তা ছিল ছেন তুসিউ। এরা কেবলমাত্র কুওমিনতাঙের সঙ্গে সহযোগিতা করতেই মনোযোগ দিয়েছিল এবং কৃষকদেরকে ভুলে গিয়েছিল—এটা ছিল দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ। দ্বিতীয় বিচ্যুতির প্রবক্তা ছিল চাং কুও-থাও। এরা কেবলমাত্র শ্রমিক-আন্দোলনের উপরই মনোযোগ দিয়েছিল এবং তারাও ভুলে গিয়েছিল কৃষকদেরকে—এটা ছিল ‘বামপন্থী’ সুবিধাবাদ। বিপ্লবের শক্তির অপর্যাপ্ততা সম্বন্ধে উভয় সুবিধাবাদী বিচ্যুতির সমর্থকরাই সচেতন ছিলো। কিন্তু উভয়ের কেউই জানত না যে, কোথায় শক্তির সন্ধান করা যায় এবং কোথায় ব্যাপক মিত্রবাহিনী পাওয়া যায়। কমরেড মাও সেতুং দেখিয়েছিলেন যে, কৃষকরাই হচ্ছে চীনের সর্বহারা শ্রেণির ব্যাপকতম ও সবচেয়ে দৃঢ় মিত্রবাহিনী। এইভাবে তিনি চীন বিপ্লবের সবচেয়ে প্রধান মিত্রবাহিনীর সমস্যার মীমাংসা করেছেন। অধিকন্তু, তিনি আগে থেকে লক্ষ্য করেছিলেন যে, তৎকালীন জাতীয় বুর্জোয়া দ্বিধাগ্রস্ত শ্রেণি এবং বিপ্লবের উত্তাল জোয়ারে তা বিভক্ত হয়ে পড়বে, এর দক্ষিণপন্থী অংশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে যাবে। ১৯২৭ সালের ঘটনাবলী থেকেই এটা প্রমাণিত হয়েছে। ‘মাও সেতুঙের রচনাবলীর নির্বাচিত পাঠ’, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, প্রথম সংস্করণ: ১৯৭৯ থেকে এটি নেয়া হয়েছে।


কারা আমাদের শত্রু? কারাই বা আমাদের বন্ধু ? এটাই হলো বিপ্লবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। চীনের অতীতের সমস্ত বিপ্লবের সংগ্রামগুলো কেন এত অল্প সাফল্য অর্জন করেছে, তার মূল কারণ হচ্ছে, প্রকৃত শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রকৃত বন্ধুদের ঐক্যবদ্ধ করতে না পারা। বিপ্লবী পার্টি হচ্ছে জনসাধারণের পথপ্রদর্শক; বিপ্লবী পার্টি যখন তাদের ভ্রান্ত পথে চালিত করে, তখন কোনো বিপ্লবই সার্থক হতে পারে না। আমাদের বিপ্লবকে আমরা ভ্রান্ত পথে চালিত করব না এবং অবশ্যই সফল হব, এ বিষয়কে সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রকৃত শত্রুদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্য প্রকৃত বন্ধুদের ঐক্যবদ্ধ করতে মনোযোগী হতে হবে। প্রকৃত শত্রুদের ও প্রকৃত বন্ধুদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য চীনা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বিপ্লবের প্রতি তাদের মনোভাবের সাধারণ বিশ্লেষণ অবশ্যই আমাদের করতে হবে।

চীনা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থা কি রকম?

জমিদার শ্রেণি ও মুৎসুদ্দি শ্রেণি:

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ আধা-ঔপনিবেশিক চীনে জমিদার শ্রেণি ও মুৎসুদ্দি শ্রেণি পুরোপুরিভাবেই আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াদের লেজুড় এবং নিজেদের অস্বস্তি ও বিকাশের জন্য সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল। এই শ্রেণিগুলো চীনের র্সবাপেক্ষা পশ্চাৎপদ এবং র্সবাপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে এবং চীনের উৎপাদন শক্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। চীনা বিপ্লবের উদ্দেশ্যের সঙ্গে তাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ সঙ্গতিবিহীন। বিশেষ করে, বড় জমিদার শ্রেণি ও বড় মুৎসুদ্দি শ্রেণি তো সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ অবলম্বন করে থাকে এবং তারা হচ্ছে একটি চরম প্রতিবিপ্লবী চক্র। রাষ্ট্রসমাজবাদী[১] এবং কুওমিনতাঙের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি।

মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণি:

এই শ্রেণি চীনের শহর ও গ্রামাঞ্চলে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে। মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণি বলতে প্রধানত জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণিকেই বুঝায়। চীনা বিপ্লবের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তনশীল, যখন তারা বিদেশী পুঁজির আঘাতে ও সমরনায়কদের অত্যাচারে নিদারুণ উৎপীড়ন ভোগ করে, তখন তারা বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সমরনায়কদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করে; কিন্তু যখনই তারা অনুভব করে যে, বিপ্লবে স্বদেশে সর্বহারা শ্রেণির নির্ভীক অংশগ্রহণ এবং বিদেশে আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণির সক্রিয় সমর্থন তাদের বড় বুর্জোয়া শ্রেণির স্তরে উন্নীত হবার আশা আকাঙ্ক্ষাকে বিপদাপন্ন করছে, তখনই তারা বিপ্লবের প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠে। একটি মাত্র শ্রেণি অর্থাৎ জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির শাসনাধীনে একট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই তাদের রাজনৈতিক আদর্শ। তাই চী-থাওয়ের[২] ‘খাঁটি শিষ্য’ বলে খ্যাত জনৈক ব্যক্তি পিকিংয়ের ‘ছেন পাও’[৩] পত্রিকাতে লিখেছিলো যে, ‘সাম্রাজ্যবাদকে নিপাত করার জন্য তোমার বাম হাত তোলো এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে নিপাত করার জন্য তোমার ডান হাত তোলো।’ এই কথাগুলি এই শ্রেণির উভয়সংকট ও উদ্বেগের একটি পরিষ্কার চিত্র উপস্থিত করে। এই শ্রেণি, শ্রেণিসংগ্রামের মতবাদ অনুসারে কুওমিনতাঙের জনগণের জীবিকার নীতির ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে এবং রাশিয়ার সঙ্গে কুওমিনতাঙের মৈত্রী এবং কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের কুওমিনতাঙে অন্তর্ভুক্তির[৪] বিরোধিতা করে। কিন্তু জাতীয় বুর্জোয়াদের শাসনাধীনে রাষ্ট্র গঠনের জন্য এই শ্রেণির প্রচেষ্টা একেবারেই অকার্যকর, কারণ বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে দুটি প্রধান শক্তি অর্থাৎ বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবী শক্তি চূড়ান্ত সংগ্রামে লিপ্ত। এই দুটি প্রধান শক্তি দুটি বিরাট পতাকা উত্তোলন করে রয়েছে — একটি হলো বিপ্লবের লাল পতাকা, যে পতাকা তৃতীয় আন্তর্জাতিক ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছে বিশ্বের সমস্ত অত্যাচারিত শ্রেণির মিলনস্থল হিসাবে; অপরটি হলো প্রতিবিপ্লবের শ্বেত পতাকা, যে পতাকা জাতিপুঞ্জ (লীগ অব ন্যাশন্স) ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছে বিশ্বের সমস্ত প্রতিবিপ্লবীদের মিলনস্থল হিসাবে। মধ্যবর্তী শ্রেণিগুলো দ্রুত বিভক্ত হতে বাধ্য; তাদের কিছু বামে যাবে বিপ্লবে যোগ দেওয়ার জন্য, অন্যরা ডানে গিয়ে প্রতিবিপ্লবে যোগ দেবে; তাদের পক্ষে ‘স্বতন্ত্র’ থাকবার কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং চীনের মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণি যে ‘স্বতন্ত্র’ বিপ্লবের ধারণা পোষণ করে যাতে তারা প্রধান ভূমিকা পালন করবে তা নিছক বিভ্রান্তি মাত্র।

পাতি বুর্জোয়া শ্রেণি:

স্বত্বাধিকারী কৃষক[৫], মালিক হস্তশিল্পী, নিম্নস্তরের বুদ্ধিজীবী- ছাত্র, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক, ছোটখাটো সরকারি চাকুরে, অফিসের কেরানি, ছোট উকিল, এবং ছোট ব্যবসায়ী ইত্যাদি সবাই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আকারের ও শ্রেণি চরিত্রের দিক দিয়ে এই শ্রেণিটি বিশেষভাবে মনোযোগ আর্কষণ করার দাবি রাখে। স্বত্বাধিকারী কৃষক ও মালিক হস্তশিল্পী উভয়েই ক্ষুদ্র উৎপাদনে নিযুক্ত। এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত সবগুলি স্তরেরই অর্থনৈতিক অবস্থা একই ধরনের পাতি বুর্জোয়া হলেও তারা তিনটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে পড়ে তারা, যাদের কিছু উদ্বৃত্ত অর্থ এবং শস্য আছে অর্থাৎ যারা দৈহিক অথবা মানসিক শ্রম দ্বারা প্রতি বছর নিজেদের ভরণ-পোষণের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয় বা উপার্জন করে। এই ধরনের ব্যক্তিরা ধনী হবার জন্য একান্ত উদ্গ্রীব এবং তারা ‘মার্শাল চাওয়ের’[৬] একান্ত অনুগত পূজারী; খুব বিরাট অর্থ জমানোর ব্যাপারে মোহ না থাকলেও তারা মাঝারি র্বুজোয়া স্তরে উন্নীত হতে সর্বদাই ইচ্ছুক। অল্প টাকাওয়ালারাও যে সম্মান পায়, তা দেখে তাদের মুখ দিয়ে প্রচুর জল ঝরে। এই ধরনের লোক ভীরু, সরকারি অফিসারদের ভয়ে সন্ত্রস্ত এবং বিপ্লবের ভয়েও কিছু পরিমাণে ভীত। অর্থনৈতিক অবস্থার দিক দিয়ে তারা মাঝারি বুর্জোয়াদের খুব কাছাকাছি বলে তারা মাঝারি বুর্জোয়াদের প্রচারে যথেষ্ট বিশ্বাসী এবং বিপ্লবের বিষয়ে তারা সন্দিহান। এই অংশটি পাতি বুর্জোয়াদের মধ্যে সংখ্যালঘু এবং পাতি বুর্জোয়াদের দক্ষিণপন্থী। দ্বিতীয় অংশটি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মোটের উপরে আত্মনির্ভরশীল। এই অংশের লোক প্রথম অংশের লোকদের থেকে অনেক ভিন্ন। তারাও ধনী হতে ইচ্ছুক, কিন্তু ‘মার্শাল চাও’ কোনো মতেই তাদের ধনী হতে দেয় না। তদুপরি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ, সমরনায়ক, সামন্ত জমিদার ও মুৎসুদ্দি বড় বুর্জোয়াদের দ্বারা অত্যাচারিত ও শোষিত হয়ে তারা জেনেছে যে, এখন পৃথিবী আর আগের মতো নেই। তারা অনুভব করে যে, পূর্বের মতো সমান পরিশ্রম করলেও আজ আর তারা বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট উপার্জন করতে পারবে না। ডাইনে এনে বাঁয়ে কুলাতে গেলে তাদেরকে আরও বেশি সময় কাজ করতে হবে, আরো সকালে উঠতে হবে, আরো দেরীতে কর্মস্থান ত্যাগ করতে হবে এবং কাজে দ্বিগুণ সতর্ক হতে হবে। তারা গালাগালি করতে আরম্ভ করে, বিদেশীদের ‘বিদেশী শয়তান’, সমরনায়কদের ‘দস্যু সর্দার’, এবং স্থানীয় উৎপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাশদের[৭] ‘হৃদয়হীন ধনী’ বলে নিন্দা করে। সাম্রাজ্যবাদ ও সমরনায়কদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সম্পর্কে তারা শুধু সন্দেহ করে যে, এটা সফল হবে কিনা (কারণ বিদেশী ও সমরনায়কদের অতি শক্তিশালী বলে মনে হয়), তারা এই আন্দোলনে যোগ দিতে ইতস্তত করে এবং নিরপেক্ষ থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু তারা কখনো বিপ্লবের বিরোধিতা করে না। এই অংশে অন্তর্ভুক্তদের সংখ্যা খুব বেশি — তারা পাতি বুর্জোয়াদের প্রায় অর্ধেক। যারা তৃতীয় অংশে অন্তর্ভুক্ত, তাদের জীবিকার মান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। তাদের অনেকেই পূর্বে হয়তো কোনো অবস্থাপন্ন পরিবারভুক্ত ছিলো, কিন্তু তাদের অবস্থা কোনো মতে জীবন ধারণ করা থেকে ক্রমাগত বেশি খারাপ অবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করায় পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতি বছরের শেষে তারা যখন হিসাব নিকাশ করতে আসে, তখন আঁতকে উঠে বলে, ‘হায়! আবার ঘাটতি!’ কারণ এ ধরনের লোকেরা অতীতে সুদিনের মধ্যে জীবন যাপন করেছে, কিন্তু এখন প্রতি বছরই তাদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে, তাদের ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জীবনও শোচনীয় থেকে শোচনীয়তর হচ্ছে, তাই তারা ‘ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ভয়ে আঁতকে ওঠে’। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এমন একটা বৈপরীত্য রয়েছে বলে তাদের বিরাট মনোকষ্ট। এই ধরনের লোকেরা বিপ্লবী আন্দোলনের পক্ষে বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তারা সংখ্যার দিক দিয়ে উল্লখেযোগ্য এবং তারাই পাতি বুর্জোয়াদের বামপন্থী অংশ। স্বাভাবিক সময়ে বিপ্লবের প্রতি এই তিনটি অংশের মনোভাব বিভিন্ন। কিন্তু যুদ্ধের সময়ে অর্থাৎ বিপ্লবে যখন জোয়ার আসে আর বিজয়ের প্রত্যুষ যখন উদয়োম্মুখ, তখন পাতি বুর্জোয়াদের বামপন্থী অংশই শুধু নয়, উপরন্তু মধ্যপন্থীরাও বিপ্লবে যোগদান করতে পারে; এবং সর্বহারাশ্রেণি ও পাতি বুর্জোয়া বামপন্থীদের বিরাট বৈপ্লবিক জোয়ারে ভেসে গিয়ে এমনকি দক্ষিণপন্থীরাও বিপ্লবের সঙ্গে যেতে বাধ্য হয়। ১৯২৫ সালের ৩০ শে মে’র আন্দোলন[৮] এবং বিভিন্ন স্থানের কৃষক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই যে এই সিদ্ধান্ত নির্ভুল।

আধা সর্বহারা:

এই শ্রেণীটি পাঁচটি উপশ্রেণীতে বিভক্ত। (১) আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের বিপুল সংখ্যাধিক অংশ; (২) গরীব কৃষক; (৩) ছোট হস্তশিল্পী; (৪) দোকান কর্মচারী[১০] (৫) ফেরিওয়ালা। আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের বিপুল সংখ্যাধিক অংশ ও গরীব কৃষক হচ্ছে পল্লী জনসাধারণের এক বিরাট অংশ। কৃষক সমস্যা প্রধানত তাদেরই সমস্যা। আধা স্বত্বাধিকারী কৃষক, গরীব কৃষক ও ছোট হস্তশল্পিীরা স্বত্বাধিকারী কৃষক ও মালিক-হস্তশিল্পীদের চেয়ে আরো ক্ষুদ্রাকারের উৎপাদনে নিযুক্ত। আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের বিপুল সংখ্যাধিক অংশ ও গরীব কৃষক উভয়ই যদিও আধা সর্বহারা শ্রেণির অংশভুক্ত, তবুও অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে তাদেরকে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন এ তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের অবস্থা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের অপেক্ষা খারাপ, কারণ প্রতি বছরই তাদের খাদ্যশস্যের প্রায় অর্ধেক ঘাটতি পড়ে এবং এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য তারা অন্যের থেকে জমি বর্গা নিতে বাধ্য হয়, নিজেদের শ্রমশক্তি আংশিকভাবে বিক্রি করতে বাধ্য হয় অথবা ছোটখাটো ব্যবসায় নিযুক্ত হতে বাধ্য হয়। বসন্তের শেষে এবং গ্রীষ্মের প্রথমে শস্য যখন কাঁচা থাকে এবং পুরানো মজুদ শস্যও নিঃশেষ হয়ে আসে, তখন তারা উচ্চ সুদে টাকা ধার করে এবং চড়া দামে শস্য কেনে। তাদের অবস্থা স্বভাবতই স্বত্বাধিকারী কৃষক — যাদের অপরের সাহায্য নেবার প্রয়োজন নেই — তাদের থেকে খারাপ, কিন্তু গরীব কৃষকদের থেকে ভাল। কারণ গরীব কৃষকদের নিজস্ব কোনো জমি নেই, সারা বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তারা শুধু অর্ধেক অথবা অর্ধেকেরও কম ফসল পায়; কিন্তু আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকেরা অন্যের নিকট হতে বর্গা নেওয়া জমির ফসলের অর্ধেক বা অর্ধেকেরও কম পেলেও নিজেদের জমির সমস্ত ফসলেরই মালিক। সুতরাং আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকেরা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের থেকে বেশি বিপ্লবী, কিন্তু গরীব কৃষকদের থেকে কম বিপ্লবী। গরীব কৃষক হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের প্রজাচাষী এবং জমিদারদের দ্বারা শোষিত। অর্থনৈতিক অবস্থার দিক দিয়ে এই উপশ্রেণিকেও আবার দুইটি অংশে বিভক্ত করা যায়। এক অংশের তুলনামূলকভাবে পর্যাপ্ত কৃষি যন্ত্রপাতি এবং কিছু অর্থ আছে। এই ধরনের কৃষকেরা তাদের বাৎসরিক শ্রমের ফলের অর্ধেকটা রাখতে পারে। অভাব পূরণের জন্য তারা পার্শ্ব শস্য উৎপাদন করে, মাছ বা চিংড়ি ধরে, মুরগী বা শূকর পোষে অথবা নিজেদের শ্রমশক্তি আংশিকভাবে বিক্রি করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করে এবং এভাবেই তারা দুঃখকষ্ট ও অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে বছরটা কাটিয়ে দেবার আশা পোষণ করে। অতএব, তাদের অবস্থা আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের থেকে খারাপ, কিন্তু গরীব কৃষকের অন্য অংশের থেকে সচ্ছল। তারা আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের থেকে বেশি বিপ্লবী, কিন্তু গরীব কৃষকদের অন্য অংশের থেকে কম বিপ্লবী। গরীব কৃষকদের অন্য অংশের কথা বলতে গেলে, তাদের না আছে পর্যাপ্ত কৃষি যন্ত্রপাতি, না আছে অর্থ; আর না আছে যথেষ্ট সার; তাদের উৎপাদিত ফসল খুবই কম এবং খাজনা দেবার পর তাদের কাছে প্রায় কিছুই থাকে না, সুতরাং তাদের আংশিকভাবে শ্রমশক্তি বিক্রি করার প্রয়োজন আরো বেশি। দুঃসময়ে তারা আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের নিকট করুণভাবে সাহায্য প্রার্থনা করে, কয়েক মণ বা কয়েক সের শস্য ধার করে কোনক্রমে দুই চার দিন চলে, এইভাবে ষাঁড়ের পিঠের বোঝার ন্যায় তাদের ঋণও স্তূপীকৃত হতে থাকে। কৃষকদের মধ্যে তারাই হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার এবং তারা বিপ্লবী প্রচারকে অতি সহজেই গ্রহণ করে। ছোট হস্তশিল্পীদেরকে আধা সর্বহারাদের দলভুক্ত করা যায়, কারণ যদিও উৎপাদনের কিছু সরল উপকরণ তাদের আছে এবং তারা আত্মনিযুক্ত, তবুও তারা প্রায়ই আংশিকভাবে শ্রমশক্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়, এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাদের অবস্থা অনেকটা গ্রামাঞ্চলের গরীব কৃষকদের মতোই। তাদের পরিবার পালনের ভারি বোঝা, উপার্জন ও জীবিকা নির্বাহের ব্যয়ের ব্যবধান এবং প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের জ্বালা ভোগ ও বেকারত্বের আশঙ্কার মধ্যে থাকার দরুণ গরীব কৃষকদের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। দোকান কর্মচারী হচ্ছে দোকানিদের বেতনভূক কর্মী, নিজেদের সামান্য বেতন দ্বারা পরিবার পরিজনদের খরচ চালাতে হয় তাদের। প্রতি বৎসর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও, তাদের বেতন হয়তো বহু বৎসরে একবার মাত্র বাড়ে। সুযোগ মতো তাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথাবার্তা বললেই, তারা হৃদয় উজাড় করে তাদের অন্তহীন দুঃখ দুর্দশার কাহিনী বলে যায়। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটিভাবে গরীব কৃষক ও ছোট হস্তশিল্পীদের একই পর্যায়ভুক্ত; বিপ্লবী প্রচারকে তারা অতি সহজেই গ্রহণ করে। পণ্যদ্রব্য লাঠিতে ঝুলিয়ে বয়েই ফেরি করুক কিংবা রাস্তার পার্শ্বে ক্ষুদ্র দোকান খুলেই বিক্রয় করুক, ফেরিওয়ালাদের মূলধন কিন্তু অল্প এবং উর্পাজনও খুবই কম। এতে তাদের খাওয়া-পরার খরচ কুলায় না। তাদের অবস্থা মোটামুটিভাবে গরীব কৃষকদের একই পর্যায়ভুক্ত; তাই বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য গরীব কৃষকদের মতো তাদেরও বিপ্লবের প্রয়োজন।

সর্বহারা শ্রেণি:

আধুনিক শিল্পকারখানায় কর্মরত সর্বহারার সংখ্যা প্রায় বিশ লক্ষ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীন পশ্চাৎপদ দেশ বলে সর্বহারার সংখ্যা বেশি নয়। এই বিশ লক্ষ শিল্প শ্রমিক প্রধানত পাঁচটি শিল্পে নিযুক্ত — রেলওয়ে, খনি, নৌপরিবহন, বয়নশিল্প এবং জাহাজ নির্মাণ। এদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক লোক বিদেশী পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ। সংখ্যায় বেশি না হলেও, এরাই চীনের নতুন উৎপাদন শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে, আধুনিক চীনে সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল শ্রেণি এবং বৈপ্লবিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় শক্তি। বিগত চার বছরে নাবিক ধর্মঘট[১১], রেলওয়ে ধর্মঘট[১২], খাইলুয়ান ও চিয়াওজুও কয়লা খনির ধর্মঘট[১৩], শামিয়ান ধর্মঘট[১৪] এবং ৩০শে মে’র আন্দোলনের পর সাংহাই ও হংকংয়ের সাধারণ ধর্মঘট[১৫] প্রভৃতি ধর্মঘটে তারা যে শক্তির পরিচয় দিয়েছে, তার থেকেই আমরা চীন বিপ্লবে শিল্পকারখানায় কর্মরত সর্বহারা শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকে দেখতে পারি। তাদের এই অবস্থানের প্রথম কারণ হচ্ছে এই যে তারা কেন্দ্রীভূত। জনসাধারণের অন্য যে কোনো অংশের লোকই তাদের মতো এতো কেন্দ্রীভূত নয়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে তাদের নিম্নমানের অর্থনৈতিক অবস্থা। উৎপাদনের সব উপকরণ হতে তারা বঞ্চিত, নিজেদের হাত ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই, ধনী হবার কোনো আশা তাদের নেই এবং সাম্রাজ্যবাদ, সমরনায়ক ও বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের সঙ্গে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করে। সেই কারণে তারা ভালো লড়াকু। শক্তি হিসেবে শহরের কুলিরাও গভীর মনোযোগ পাবার অধিকারী। তাদের বেশির ভাগই বন্দরের মুটে মজুর এবং রিকসাওয়ালা; মেথর, ময়লাগাড়ীর চালক ও রাস্তা সাফকারী ঝাড়ুদারও তাদের অন্তর্ভুক্ত। নিজেদের হাত ছাড়া তাদের অন্য কোনো সম্বল না থাকায় তাদেরও অর্থনৈতিক অবস্থা শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মতোই; কিন্তু শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের থেকে তারা কম কেন্দ্রীভূত এবং উৎপাদনে কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চীনে আধুনিক পুঁজিবাদী কৃষিকার্য এখনো খুবই কম। গ্রামাঞ্চলের সর্বহারা শ্রেণি বলতে বার্ষিক, মাসিক অথবা দৈনিক মেয়াদে নিযুক্ত ক্ষেত মজুরদেরই বুঝি। এই ক্ষেত মজুরদের কাছে জমি, কৃষি যন্ত্রপাতি, এমনকি কোনো অর্থও না থাকায় তারা শুধু নিজেদের শ্রম শক্তি বিক্রি করেই বেঁচে থাকতে পারে। অন্য সব শ্রমিকের তুলনায় তাদের কাজের সময় দীর্ঘতম, বেতন সব থেকে কম, শ্রমের অবস্থা সব থেকে শোচনীয় এবং চাকুরির নিরাপত্তা সবচেয়ে কম। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের লোকেরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করছে এবং কৃষক আন্দোলনে তাদের অবস্থান গরীব কৃষকদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক পশ্চাৎপদ সর্বহারা অর্থাৎ ভূমিহারা কৃষক এবং কাজ পায় না এমন হস্তশিল্প কারিগর। তাদের অস্তিত্বই হচ্ছে সব চাইতে অনিশ্চিত। দেশের সব স্থানেই তারা গুপ্ত সংগঠন গঠন করেছে। আগে এগুলি ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের জন্য পারস্পরিক সাহায্য সংগঠন, যেমন ফুচিয়ান ও কুয়াংতোংয়ে ‘ত্রয়ী সমিতি’ (সানহোহুই); হুনান, হুপেই, কুইচৌ ও সিছুয়ানে ‘সহোদর সমিতি’ (কোলাওহুই); আনহুই, হোনান ও শানতোংয়ে ‘বড় তরবারি সমিতি’ (তাতাওহুই); চিলি[১৬] ও তিনটি উত্তরপূর্ব প্রদেশে ‘যৌক্তিক জীবন সমিতি’ (চ্যাইলিহুই) এবং শাংহাই ও অন্যান্য স্থানে ‘সবুজ গোষ্ঠী’ (ছিংপাং)[১৭]। এই সমস্ত লোককে কি করে পরিচালিত করা যায় সেটাই হচ্ছে চীনের অন্যতম কঠিন সমস্যা। নির্ভীক যোদ্ধা কিন্তু ধ্বংসাত্মক ঝোঁকসম্পন্ন এই লোকেরা যথার্থ নেতৃত্ব পেলে একটি বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হতে পারে।

সংক্ষেপে, এটা সুস্পষ্ট যে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যোগসাজশে লিপ্ত সমস্ত সমরনায়ক, আমলা, মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি শ্রেণি, বড় জমিদার শ্রেণি এবং তাদের সঙ্গে সংযুক্ত বুদ্ধিজীবীদের প্রতক্রিয়াশীল অংশ হলো আমাদের শত্রু। শিল্পকারখানায় কর্মরত সর্বহারা শ্রেণিই হলো আমাদের বিপ্লবের নেতৃস্থানীয় শক্তি। সমস্ত আধা সর্বহারা এবং পাতি বুর্জোয়া আমাদের নিকটতম বন্ধু। দোদুল্যমান মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণির দক্ষিণপন্থীরা আমাদের শত্রু হতে পারে এবং বামপন্থীরা আমাদের মিত্র হতে পারে — কিন্তু আমাদের সর্বদাই সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদেরকে আমাদের ফ্রণ্টের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে দেওয়া চলবে না।

টীকা

১. রাষ্ট্রসমাজবাদী হচ্ছে একদল মুষ্টিমেয় র্নিলজ্জ ফ্যাসিবাদী রাজনীতিবিদ, যারা সে সময়ে ‘চীনের রাষ্ট্রসমাজবাদী যুব লীগ’ গঠন করে, পরে এই সংগঠনের নাম ‘চীনের যুব পার্টি’ রাখা হয়। ক্ষমতাসীন বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তারা কমিউনিস্ট পার্টির এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করাটাকে নিজেদের প্রতিবিপ্লবী পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলো।

২. তাই চী-থাও যুব অবস্থাতেই কুওমিনতাঙে যোগ দিয়েছিল এবং চিয়াং কাইশেকের অংশীদার হয়ে স্টক এক্সচেঞ্জে ফাটকাবাজি করত। ১৯২৫ সালে সান ইয়াৎ সেনের মৃত্যুর পর, সে কমিউনিস্টবিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হয় এবং ১৯২৭ সালে চিয়াং কাইশেকের প্রতি বিপ্লবী ক্যুদেতার মতাদর্শগত ভিত্তি প্রস্তুত করেছিল। দীর্ঘকাল পর্যন্ত প্রতিবিপ্লবী কাজে সে ছিলো চিয়াং কাইশেকের পদলেহী কুকুর। ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চিয়াং কাইশেকের শাসনের ধ্বংসের অপরিহার্যতা দেখে নিজের ভবিষ্যৎ সর্ম্পকে নিরুপায় হয়ে সে আত্মহত্যা করে।

৩. পিকিং ‘ছেন পাও’ সেই সময়ে উত্তরাঞ্চলের সমরনায়কদের শাসনের সমর্থনকারী অন্যতম রাজনৈতিক চক্র ‘নিয়মতান্ত্রিক সরকার সম্পর্কে গবেষণা সমিতি’র মুখপত্র ছিলো।

৪. ১৯২৩ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাহায্যে ড. সান ইয়াৎসেন কুওমিনতাঙের পুনর্গঠন করার, কুওমিনতাঙ ও কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করার এবং কমিউনিস্টদেরকে কুওমিনতাঙে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি কুয়াংচৌয়ে কুওমিনতাঙের প্রথম জাতীয় কংগ্রেস আহবান করেন এবং রাশিয়ার সাথে মৈত্রী, কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সহযোগিতা এবং কৃষক ও শ্রমিকের প্রতি সহায়তা করা — এই তিনটি মহান কর্মনীতি নির্ধারণ করেন। সেই সময়ে কমরেড মাও সেতুঙ এবং লি তা চাও, লিন পোছ্যু, ছ্যু ছিউ পাই ও অন্যান্য কমরেডরা ওই কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন এবং কুওমিনতাঙকে বিপ্লবের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ সেই সময়ে কুওমিনতাঙের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য বা বিকল্প সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

৫. স্বত্বাধিকারী কৃষক বলতে কমরেড মাও সেতুঙ এখানে মাঝারি কৃষকদের বুঝিয়েছেন।

৬. মার্শাল চাও হচ্ছে চীনের লোককাহিনীতে বর্ণিত অর্থের দেবতা, তার পুরো নাম চাও কোং মিং।

৭. স্থানীয় উৎপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাশরা ছিল জমিদার শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যক্তি। ধনী কৃষকদের মধ্যেও ছোটখাটো ধরনের স্থানীয় উৎপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাশ ছিল। —অনুবাদক

৮. ১৯২৫ সালের ৩০ মে সাংহাইয়ে বৃটিশ পুলিশ কর্তৃক চীনা জনগণের হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য সারা দেশের জনগণ যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন চালিয়েছিল, এখানে তারই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯২৫ সালের মে মাসে ছিংতাও ও সাংহাইয়ের জাপানি সূতাকলগুলোতে পর পর ধর্মঘট হয়, এই ধর্মঘট ব্যাপক আকারের ধর্মঘটে পরিণত হয়েছিলো; জাপানী সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের পদলেহী কুকুর, উত্তরাঞ্চলের সমরনায়করা এটা দমন করতে আসে। ১৫ মে শাংহাইয়ের জাপানী সূতাকলের মালিকরা কু চেং-হোং নামক একজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে এবং দশ জনেরও বেশি শ্রমিককে আহত করে। ২৮ তারিখে ছিংতাওয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সরকার আট জন শ্রমিককে হত্যা করে। ৩০ মে শাংহাইয়ে দু’হাজারেরও অধিক ছাত্র বিদেশী কনসেশনগুলিতে শ্রমিকদের সমর্থনে প্রচার চালায় এবং এই সব কনসেশন পুনরুদ্ধারের জন্য আহবান জানায়। এর পরেই বৃটিশ কনসেশন এলাকার পুলিশ সদর দফতরের সম্মুখে দশ হাজারেরও অধিক লোক জমায়েত হয় এবং উচ্চস্বরে ‘সাম্রাজ্যবাদ মুর্দাবাদ!’ ও ‘সমগ্র চীনা জনগণ, এক হও!’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী পুলিশ জনতার উপর গুলি চালায়, ফলে বহু ছাত্র হতাহত হয়। এই ঘটনাই ’৩০ মে’র হত্যাকান্ড’ বলে পরিচিত। এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে সমগ্র দেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়, দেশের সর্বত্রই বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয় এবং শ্রমিক, ছাত্র ও দোকান কর্মচারীদের ধর্মঘট ও হরতাল শুরু হয়। এই ধর্মঘট ও হরতাল বিরাটাকারের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয়।

৯. ‘আধা স্বত্বাধিকারী কৃষকদের বিপুল সংখ্যাধিক অংশ’ বলতে এখানে কমরেড মাও সেতুং সেই দরিদ্র কৃষকদের কথা বুঝিয়েছেন, যারা অংশত নিজেদের জমিতে চাষ করে এবং অংশত অন্যদের কাছ থেকে বর্গা নেওয়া জমিতে কাজ করে।

১০. পুরানো চীনে দোকান কর্মচারীরা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত ছিলো। এখানে কমরেড মাও সেতুং এদের সংখ্যাগুরু স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া আর একটি অংশ — নিম্নস্তরের দোকান কর্মচারীরা — সর্বহারার জীবন যাপন করতো।

১১. ১৯২২ সালের প্রারম্ভে হংকংয়ের ও ইয়াংসির স্টিমারের নাবিকগণ ধর্মঘট করে। হংকংয়ের নাবিকরা দৃঢ়তার সঙ্গে আট সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট চালায়; তীব্র ও রক্তাক্ত সংগ্রামের পরে শেষ পর্যন্ত হংকংয়ের বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়নের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, বন্দী শ্রমিকদের মুক্তি এবং শহীদদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি দাবি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পরে ইয়াংসির স্টিমারের নাবিক ও শ্রমিকরাও ধর্মঘট শুরু করে দেয় এবং দু’সপ্তাহ পর্যন্ত ধর্মঘট চালানোর পর তারাও বিজয় লাভ করে।

১২. ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠনের কাজ চালাতে শুরু করে। ১৯২২-২৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সমস্ত প্রধান প্রধান রেলপথে ধর্মঘট হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল পিকিং-হানখৌ রেলওয়ের সাধারণ ধর্মঘট, যা ১৯২৩ সালে ৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে শ্রমিকরা সাধারণ ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার স্বাধীনতার জন্য চালিয়েছিল। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক সমর্থিত উত্তরাঞ্চলের সমরনায়ক উ পেউ ফু ও সিয়াও ইয়াও নান ৭ই ফেব্রুয়ারী এই ধর্মঘটি শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এটাই ইতিহাসে ‘৭ফেব্রুয়ারী হত্যাকাণ্ড’ নামে বিখ্যাত।

১৩. খাইলুয়ান কয়লা খনি হচ্ছে হোপেই প্রদেশে অবস্থিত পরস্পরের সংলগ্ন বিশাল খাইপিং ও লুয়ানচৌ কয়লা খনি দুটির সাধারণ নাম। সেই সময়ে সেখানে ৫০ হাজারেরও অধিক শ্রমিক কাজ করতো। ১৯০০ সালে ‘ইহোথুয়ান’ আন্দোলনের সময়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা খাইপিং কয়লা খনি কেড়ে নিয়েছিল। পরে চীনারা লুয়ানচৌ কয়লা খনি কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করে, কিছুকাল পর এই কোম্পানী খাইলুয়ান কয়লা খনি প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এইভাবে উভয় খনিই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পূর্ণ দখলে এসে যায়। খাইলুয়ান ধর্মঘট ১৯২২ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সংঘটিত হয়। চিয়াওজু ও কয়লা খনি উত্তর হোনান প্রদেশে অবস্থিত এবং সেসময়ে এই খনিও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। চিয়াওজু ও ধর্মঘট ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে ঘটেছিল। ৩০ মে আন্দোলনের সমর্থনে এই ধর্মঘটের আয়োজন করা হয়েছিল এবং সাত মাসের অধিক সময় ধরে তা স্থায়ী ছিলো।

১৪. সে সময়ে শামিয়ান ছিল কুয়াংচৌ শহরে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক দখল করা একটি কনসেশন এলাকা। শামিয়ান শাসনকারী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ১৯২৪ সালের জুলাই মাসে এক নতুন পুলিশ আইন জারী করে যার অধীনে ঐ কনসেশন এলাকা থেকে আসা যাওয়ার সময় সমস্ত চীনাদের নিজের ফটোযুক্ত পাশ দেখাতে হতো, কিন্তু বিদেশীরা সেখানে স্বাধীনভাবে আসা-যাওয়া করতে পারতো। এই অযৌক্তিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৫ জুলাই তারিখে শামিয়ানের শ্রমিকরা ধর্মঘট ঘোষণা করে। ফলে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ওই আইন বাতিল করতে বাধ্য হয়।

১৫. সাংহাইয়ের ১৯২৫ সালের ৩০ মে’র ঘটনার পর, ১ জুন তারিখে সাংহাইয়ে এবং ১৯ জুন হংকংয়ে সাধারণ ধর্মঘট শুরু হয়। সাংহাইয়ে দুই লক্ষের অধিক শ্রমিক এবং হংকংয়ে আড়াই লক্ষ শ্রমিক ধর্মঘটে যোগদান করে। সমগ্র দেশের জনগণের সমর্থন পেয়ে হংকংয়ের বিরাট ধর্মঘট ১৬ মাস ধরে চলে। বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এটাই দীর্ঘতম ধর্মঘট ছিল।

১৬. চিলি হচ্ছে হোপেই প্রদেশের পুরানো নাম।

১৭. ‘ত্রয়ী সমিতি’ (সানহোহুই), ‘সহোদর সমিতি’ (কোলাওহুই), ‘বড় তরবারি সমিতি’ (তাতাওহুই), ‘যৌক্তিক জীবন সমিতি’ (চ্যাইলিহুই) এবং ‘সবুজ গোষ্ঠী’ (ছিংপাং) ছিল জনসাধারণের মধ্যে আদিম ধরনের গুপ্ত সংগঠন। এই সংগঠনে প্রধানত ছিল দেউলিয়া কৃষক, বেকার হস্তশিল্পী ও পশ্চাৎপদ সর্বহারাগণ। সামন্ততান্ত্রিক চীনে প্রায়শই ধর্ম ও কুসংস্কারের সূত্রে এই সব লোক একত্রিত হতো এবং পিতৃপ্রধান ধরণের বিভিন্ন নামের সংগঠন গড়ে তুলতো, তাদের কারো কারো বা অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। এই সব সংগঠনের মাধ্যমে তারা সামাজিক জীবনে ও অর্থনৈতিকভাবে পরস্পরকে সাহায্য করতে চাইতো এবং আমলা ও জমিদার- যারা তাদের অত্যাচার করতো- তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে কখনো কখনো এগুলিকে ব্যবহার করতো। অবশ্য এই ধরনের পশ্চাৎপদ সংগঠন কৃষক ও হস্তশিল্পীদের কোন পথ দেখাতে পারতো না।

অধিকন্তু, এই ধরণের পশ্চাৎপদ সংগঠন অতি সহজেই জমিদার ও স্থানীয় উৎপীড়কদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবহৃত হতো, আর এছাড়া তাদের অন্ধ ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির কারণে কোনো কোনোটা বা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে পরিণত হতো। ১৯২৭ সালে চিয়াং কাইশেকের প্রতিবিপ্লবী ক্যুদেতার সময়ে সে মেহনতি জনগণের ঐক্যকে বিনষ্ট করার ও বিপ্লবকে ধ্বংস করার হাতিয়ার হিসেবে এই ধরনের পশ্চাৎপদ সংগঠনকে ব্যবহার করেছিল। শিল্পকারখানায় কর্মরত আধুনিক সর্বহারা শ্রেণির শক্তি বিপুলভাবে বর্ধিত হয়ে উঠার পর শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে কৃষকেরা ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তাই এসব আদিম ও পশ্চাৎপদ সংগঠনের অস্তিত্বের আর কোনো প্রয়োজন থাকেনি।

Leave a Comment

error: Content is protected !!