দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দ্বন্দ্ববাদ ও বস্তুবাদ থেকে সংশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভূত মতবাদ

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (ইংরেজি: Dialectical Materialism) হচ্ছে মার্কসবাদের একটি প্রধান তত্ত্ব  যা এসেছে ফ্রিডরিখ হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদ থেকে সংশ্লেষণের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব বা মতবাদ প্রাকৃতিক জগৎ, মানুষের সমাজ এবং চিন্তার ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল বিধানসমূহের পরিচয় জ্ঞাপক তত্ত্ব।

ইংরেজি ‘ডায়ালেটিকস’ শব্দ গ্রিক শব্দ ‘ডায়ালোগ’ থেকে উদ্ভুত। গ্রিক দর্শনে ডায়ালোগ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সমাধান সন্ধানের পদ্ধতিকে গ্রিক দার্শনিকরা ডায়ালোগ বলতেন। প্রশ্ন, উত্তর বা পাল্টা প্রশ্নের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের অবস্থা বিরাজমান। এই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সমাধানের পৌঁছার প্রক্রিয়ায় একটা গতির আভাসও বিদ্যমান। বস্তুত দ্বন্দ্ব, পরিবর্তন, গতি, এ কথাগুলি পরস্পরের ইঙ্গিতসূচক।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্বটির উদ্ভবের ইতিহাস

হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদের সমালোচনার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদের অন্যতম একটি উপাদানের উদ্ভব হয়েছে। কার্ল মার্কস হেগেলের ভাববাদ বর্জন করে তাঁর দ্বন্দ্ববাদকে এবং ফয়েরবাখের যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করে তাঁর বস্তুবাদকে গ্রহণ করে যে দর্শন গড়ে তোলেন তাকেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বলা হয়।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হচ্ছে বাস্তবতা বুঝবার পথ, এই বাস্তবতা হতে পারে চিন্তাসমূহ, আবেগসমূহ, বা বস্তুগত দুনিয়া। সহজভাবে বলতে গেলে এই প্রণালীবিদ্যা হচ্ছে দ্বন্দ্ববাদ এবং বস্তুবাদের সংশ্লেষণ। মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে এই বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্ব আর সাম্যবাদ হচ্ছে মার্কসবাদের অনুশীলন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের একটি প্রায়োগিক উদাহরণ হচ্ছে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারনা বা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ শব্দটি কার্ল কাউতস্কি কর্তৃক প্রথম ব্যবহৃত এবং মার্কস এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মাধ্যমে জনপ্রিয় করা হয়।[১]

যেখানে দ্বন্দ্ব আছে, সেখানে পরিবর্তন ও গতি আছে। প্রাচীন গ্রিসের একাধিক বস্তুবাদী দার্শনিক জগৎ সম্পর্কে তাঁদের ব্যাখ্যায় এই দ্বন্দ্ব গতি ও পরিবর্তনের কথা স্বীকার করেছেন। প্লেটো ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দার্শনিক হলেও তাঁর সংলাপসমূহ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির উত্তম দৃষ্টান্ত। দ্বন্দ্ব কেবল প্রশ্নোত্তরের ক্ষেত্রে নয়। তার সংলাপে এরূপ আভাসও পাওয়া যায় যে, ‘ভাব’ বা চরম যে সত্তা তাকেও নির্দ্বান্দ্বিকভাবে সম্যকরূপে উপলব্ধি করা যায় না। চরম সত্তা একদিক দিয়ে যেমন অস্তিত্ব, তেমনি অপর দিক দিয়ে সে অনস্তিত্ব, একদিকে সে যেমন নিজে যা তাই, তেমনি সে নিজে যা নয় তা-ও বটে। সে অপরিবর্তনীয়, আবার পরিবর্তনীয়।

যে-কোনো অস্তিত্বের আভ্যন্তরিক দ্বন্দ্বকে অস্তিত্বের মূল বলে স্বীকৃতিদান এবং জগৎ, সমাজ ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ব্যাপকতম প্রয়োগ ঘটেছে আধুনিককালে মার্কসীয় দার্শনিকদের দ্বারা। এ দর্শনের প্রবক্তা হিসাবে কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস বিখ্যাত। মার্কস এবং এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিকতার পূর্ণতম ব্যাখ্যা হেগেল-এর দর্শনে ঘটেছে বলে মনে করেন। তাঁদের মতে প্রাচীন দর্শনের পর হেগেলই সুস্পষ্টভাবে দ্বান্দ্বিকতার নীতি প্রকাশ করেছেন। হেগেলের মতে আমাদের চিন্তাই যে কেবল অস্তি, নাস্তি এবং নাস্তির নাস্তিত্বের মাধ্যমে নতুনতর অস্তির উদ্ভবের প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয় তাই নয়, চরম সত্তাও অনুরূপ অস্তি ও নাস্তির দ্বন্দ্বের মাধ্যমে নিজের সত্তাকে সৃষ্টি করে চলে।

মার্কস এবং এঙ্গেলস হেগেলের দ্বান্দ্বিক গতিকে স্বীকার করেছেন, অপর দিকে তেমনি চরম সত্তাকে ভাব বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কাছে বস্তু চরম ভাবের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়ার প্রকাশবিশেষ, বস্তু চরম সত্তা নয়। মার্কস এঙ্গেলস হেগেলের ক্রিয়াশীল তেমনি চরম সত্তা হচ্ছে বস্তু, ভাব নয়। ভাব হচ্ছে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে ক্রিয়াশীল বস্তুরই বিকাশবিশেষ। এদিক দিয়ে মার্কসবাদ হেগেলের দর্শনের পরিপূর্ণ প্রতিপক্ষ। কাজেই হেগেলীয় ডায়ালেকটিকস বা দ্বান্দ্বিকতা বস্তুর ক্রিয়াশীলতা এবং জ্ঞানের ক্রিয়াশীলতাকে একই সূত্রে আবদ্ধ করেছে। বস্তু এবং বস্তুর জ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করা যায়: বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ম বিদ্যমান। দ্বন্দ্ব থেকে গতির সঞ্চার। দ্বন্দ্বহীন এবং গতিহীন কোনো সত্তার অস্তিত্ব নেই।

দ্বন্দ্বমূলক গতিকে একটা বিশেষ অবস্থা থেকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, একটা বিশেষ অবস্থাকে যদি ‘অস্তি’ বলে বিবেচনা করা যায়, তা হলে দ্বন্দ্ব এবং গতির কারণে কালক্রমে ‘অস্তি’ নাস্তির সৃষ্টি করে, অস্তি ও নস্তির সংগ্রামে আবার কালক্রমে নতুনবাবে অস্তিত্বের সৃষ্টি হয় যার মধ্যে অস্তি ও নাস্তির অভিনব এবং উন্নততর সম্মেলন সংঘটিত হয়। ইংরেজীতে এই তিনটি অবস্থা ‘থিসিস’, ‘এ্যান্টিথিসিস’ এবং ‘সিনথেসিস’ বলে পরিচিত।

দ্বান্দ্বিক গতির আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, দ্বন্দ্বের মাধ্যমে পরিবর্তনের ক্রম সব সময় এক রকম থাকে না। পরিবর্তনের ক্রম বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে অবস্থার ক্ষেত্রে একটা গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বস্তুর ক্ষেত্রে এই দ্বান্দ্বিকতার নীতি প্রয়োগ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং সমাজ ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দ্বারা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজের উত্তরণকে মার্কসবাদীগণ ইতিহাসের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন। এই নীতিতে কালক্রমে পুঁজিবাদী সমাজ নতুনতন সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরিত হবে বলেও মার্কস ও এঙ্গেলস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়া এবং অন্য অনেক দেশে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন এবং অপরদিকে পুঁজিবাদের পক্ষ থেকে তার তীব্র বিরোধিতা চলছে, একেও দ্বন্দ্বমূলক দর্শনের বাস্তব দৃষ্টান্ত বলে গণ্য করা হয়।

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, মার্কসবাদ, ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৬-২৭।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৩৪-১৩৫।

2 thoughts on “দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দ্বন্দ্ববাদ ও বস্তুবাদ থেকে সংশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভূত মতবাদ”

  1. সমাজ দর্শন ও রাষ্ট্র দর্শনের পরিধি সম্পর্কে একটি লেখা দিয়েন।

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!