উপযোগবাদ বা উপযোগীতাবাদ (ইংরেজি: Utilitarianism) হচ্ছে আদর্শগত নীতিশাস্ত্রের তত্ত্বের একটি গুচ্ছ যেটা সমস্ত প্রভাবিত ব্যক্তিদের জন্য সর্বাধিক সুখ এবং মঙ্গলকারী কাজের বিধান দেয়। মিলের উপযোগবাদ গড়ে উঠেছে প্রচলিত অ্যাডাম স্মিথ, জেরেমি বেনথাম এবং পিতা জেমস মিলের ভাবধারায়। উপযোগবাদের প্রধান বিষয় হলো – মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ভোগের পিপাসু। মুক্তিবোধ বা কোনো আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তি পরিচালিত হয় জৈবিক প্রেরণায়, মানুষের জৈবিক প্রেরণায় মূল লক্ষ্য হলো সর্বোচ্চ সুখলাভ এবং দু:খের পরিসমাপ্তি ঘটানো।
নীতিশাস্ত্রে জন স্টুয়ার্ট মিলকে উপযোগবাদী বলা হয়। তিনি তাঁর পূর্বগামী জেরেমি বেনথামের উপযোগবাদ বা ইউটিলিটারিয়ানিজম তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তি যে কারোর যে কোনো আচরণের ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি হবে অধিকতর সংখ্যক মানুষের অধিকতম পরিমাণ সুখ উৎপাদনের উপযোগিতা। যে আচরণ মানুষের এরূপ সুখ উৎপাদনে উপযোগী, সে আচরণ ন্যায্য; যে আচরণ এর অনুপযোগী সে আচরণ অন্যায্য।
স্টুয়ার্ট মিলের মতে অবশ্য সুখের নিরিখ কেবল তার পরিমাণ দিয়েই হবে না। পরিমাণের সঙ্গে গুণের প্রশ্নও বিবেচনা করতে হবে। সুখ কেবল পরিমাণগতভাবে পৃথক নয়। সুখ গুণগতভাবেও পৃথক হতে পারে। অর্থাৎ আমরা কেবল অধিক সুখই যে কামনা করব, তা নয়। আমরা উত্তম সুখেরও বাসনা করব। এবং ‘অধিকতর’ এর চেয়ে ‘উত্তমই’ আমাদের কামনা হবে। তা ছাড়া দৈহিক সুখের চেয়ে মানসিক সুখকে উত্তম বলে মনে করব।[১]
উপযোগবাদ গ্রন্থের বিশ্লেষণ
Utilitarianism গ্রন্থে উপযোগবাদের ব্যাখ্যায় বলেন উপযোগবাদ হলো সেই ধারণা যা নৈতিকতা, সর্বোচ্চ সুখ নীতিকে ভিত্তি হিসাবে মেনে নেয় এবং মনে করে সেই ধরনের কাজই নৈতিক যা সুখের বৃদ্ধি ঘটায়। সুখ বলতে বোঝায় আনন্দের উপস্থিতি এবং বেদনার অনুপস্থিতি। মিলের মতে ব্যক্তিগত সমস্ত কার্যকলাপ এবং আচরণের কেন্দ্রবিন্দু হলো সুখ। বেনথাম ও জেমস মিলের সঙ্গে তিনি একমত পোষণ করেন যে, ১) ব্যক্তির জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলো সুখ লাভ, ২) সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির সর্বাধিক সুখ লাভই কাম্য ৩) সমাজ রাষ্ট্র আইন আদালত অর্থনীতি – এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যই হলো কোনো কাজের বৈধতা বিচার।
বেনথামের মতো মিল মানুষকে স্বার্থপর ও ভোগ পিপাসু বলে মনে করেন কিন্তু মিলের মতে মানুষের সামাজিক সত্তা মানুষের প্রকৃতির একটি রূপ যে কারণে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে সমাজ গড়ে তোলে, অপরের সুখে সুখী এবং অপরের দু:খে দু:খী হয়। মিলের মতে শিক্ষা, সামাজিকীকরণ, অভ্যাস প্রভৃতির মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিক সত্ত্বার বিকাশ ঘটে।
Utilitarianism গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মিল বলেন সুখের মধ্যে কিছু কিছু সুখ অধিকতর কাম্য ও মূল্যবান। সে সুখের উচ্চতর ও নিম্নতর প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং উচ্চতর সুখকে বাছাই করতে পারে, মিল এভাবে সুখের পরিমাণগত এবং গুণগত দিকের মধ্যে বাছাই করে গুণগত দিক থেকে সুখকে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করেন। মিলের কাছে তাই সুখী নির্বোধের থেকে অসুখী সক্রেটিসের মূল্য অনেক বেশি। বেনথামের কাছে সুখ অর্জনই ছিল প্রধান, কিন্তু কী উপায়ে সুখ অর্জন করা সম্ভব সে সম্পর্কে বেনথাম ছিলেন অনাগ্রাহী। মিল সুখ অর্জনের উৎসটিকেও গুরুত্ব দিতে চান, মিল প্রতিটি কাজের যথাযথ গুণের উপর সুখ নির্ভরশীল বলে মনে করতেন। এই কারণে কোনো অন্যায় কাজ সুখ লাভের পক্ষে সহায়ক হলে তা পরিত্যাগ করা উচিত বলেও তিনি মনে করতেন।
১৮৫৯ সালে রচিত On Liberty গ্রন্থে উপযোগবাদের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, উপযোগের প্রশ্নে একজন প্রগতিশীল ও আধুনিক জীব হিসাবে মানুষের স্থায়ী স্বার্থকেই গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে উপযোগবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যান্য জীবের মত মানুষ শুধুমাত্র ভোগকে গুরুত্ব না দিয়ে তার মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানোকে অধিকতর গুরুত্ব দেবে। ব্যক্তির এই বিকাশকে তিনি গাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মানুষের প্রকৃতি হলো গাছের মত যা বিকশিত হয় সব দিক থেকে। এই গ্রন্থে মিল তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র এবং স্বাধীকারের কথাও বলেন। তিনি মনে করেন ব্যক্তির একটি নিজস্ব ক্ষেত্র থাকা উচিত যেখানে রাষ্ট্র বা অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। মিল মনে করেন প্রত্যেক ব্যক্তিরই তার সত্ত্বাকে ক্রমশ উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে যদি পরিমাণগত সুখের থেকে গুণগত সুখকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং মানবিক গুণের বিকাশ ঘটায়।[২]
তথ্যসূত্র
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; পঞ্চম সংস্করণ জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৭।
২. গোবিন্দ নস্কর, Political thought, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ২৭-২৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।