দর্শনের ব্যবহার (ইংরেজি: The uses of Philosophy) বলতে বোঝানো হয় বিশ্ব ও জগতের মূর্ত বা বিমূর্ত উপলব্ধিসমূহের ব্যবহার। যারা মনে করেন দর্শন উদ্ভট কল্পনা বা স্বপ্নবিলাস তারা ভুল চিন্তা ধারণ করেন। দর্শনের সাথে জীবনের সম্পর্ক নিবিড়ই। দর্শন চর্চা করেন এই দুনিয়ার সবচেয়ে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ। এটা জীবন ও জগতের বহু সমস্যা সমাধানের তত্ত্ব দেয়। দর্শনচর্চা অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রাখে না যদিও, তবে একথা ঠিক জীবন চলার পথে এর ভূমিকা অপরিসীম। নিচে দর্শনের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো।
দর্শন সত্যের সন্ধান ও বস্তুসত্ত্বার মৌলিক জ্ঞান দান করে।
অনেকে ভাবতে পারেন, দর্শন কোনো জ্ঞান দান করে না, প্রকৃত সত্যকে আমরা জানতে পারি বিজ্ঞানের সাহায্যে। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, বিজ্ঞানীরা যেসব মৌলিক ধারণা বা সূত্র নিয়ে কাজ শুরু করেন, সেগুলোর প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণী আলোচনা ও ব্যাখ্যা করে দর্শন। দার্শনিকদের দেয়া সুচিন্তিত অনুমান, অনুমান বিধি, ধারণা ও প্রকল্প থেকে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার উপাত্ত ও উৎসাহ পান। যে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের তাত্ত্বিক ভিত্তিমূলে থাকে দার্শনিকের অবদান। বিগত তিন শতকের বিজ্ঞান যে যান্ত্রিক ধারণার উপর গড়ে উঠেছে, তার স্রষ্টা দার্শনিক রেনে ডেকার্ট।
দর্শনের ব্যবহার স্বাধীন চিন্তার পথকে প্রসারিত করে
দর্শনের মূল কাজ জ্ঞান ও সত্যের অনুসন্ধান। এজন্য দার্শনিককে আপোসহীনভাবে স্বাধীন চিন্তা করতে হয়। কোনো কিছুই এক্ষেত্রে তাকে বাধার সম্মুখীন করতে পারে না। প্রয়োজনে হাসিমুখে জীবন বিসর্জন দিতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না। তাঁদের এ অদম্য যাত্রা সাধারণ মানুষকে যেমন স্বাধীন চিন্তা করার উৎসাহ যোগায় তেমনি চিন্তার পথকেও প্রসারিত করে। অ্যারিস্টটল বলেন, আইনের ভয়ে অন্যেরা যা করে থাকে, স্বেচ্ছায় ও সানন্দে তা করার প্রেরণা ও ক্ষমতা আমি দর্শন থেকে পেয়েছি।
দর্শন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক রীতিনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এ সমস্তই দার্শনিক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়। দার্শনিক চিন্তা জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে। কথা, বক্তৃতা ও রচনাকর্মে বিবৃত মতবাদের মধ্যে দার্শনিক চিন্তার প্রকাশ বা প্রতিফলন থাকে। আজকের দিনে সাধারণ লোকও যে বলে, মানুষকে কোনো কর্ম সিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না, সরকার সাধারণ লোকের ভোট নিয়ে গড়ে উঠবে এরও পেছনে রয়েছে দার্শনিক চিন্তার প্রভাব। রাষ্ট্রীয় নীতির ক্ষেত্রেও দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। আমেরিকার শাসনতন্ত্র অনেকাংশেই দার্শনিক জন লকের রাজনৈতিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে মানব-মুক্তির বাণী নিয়ে যে ফরাসি বিপ্লব হয়েছিল, তার মূলে দার্শনিক রুশোর অবদান অনস্বীকার্য।
দর্শন সভ্যতার কাঠামো নির্মাণ করে
জগৎ ও জীবনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি একটি বিশেষ সভ্যতার কাঠামো তৈরি করে। আর জগৎ ও জীবনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি দর্শনই গড়ে তোলে। দর্শন যত বলিষ্ঠ ও উদার হয়, সভ্যতাও তত বলিষ্ঠ ও উদার হয়। দার্শনিক চিন্তার অগ্রগতির মানই একটি বিশেষ সভ্যতার উৎকর্ষ বা মহত্ত্বের মান সূচনা করে। যে দেশের দার্শনিক চিন্তা যত উন্নত সে দেশের সভ্যতাও তত উন্নত।
দর্শন ধর্মীয় বোধ ও নীতিবোধ জাগ্রত করে
স্রষ্টা সম্বন্ধে ধারণা, নীতিবোধ সবই দার্শনিক চিন্তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। একটি বিশেষ দেশের ধর্ম ও নৈতিকতা সেই দেশের বিশেষ দর্শনের প্রভাব প্রকাশ করে। বস্তুবাদী দর্শনের দেশের লোক স্বাভাবিকভাবে ধর্ম বিষয়ে নাস্তিক আর নীতির ব্যাপারে সুখবাদী হয়। যে দেশের দর্শন আধ্যাত্মবাদী সে দেশের মানুষ সাধারণত ধর্ম বিষয়ে আস্তিক আর নীতির বিষয়ে বৈরাগ্যবাদী হয়।
দর্শনের ব্যবহার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করে
জগৎ ও জীবনের যেসব মৌলিক প্রশ্ন সম্পর্কে দর্শন অনুধ্যান করে কিংবা বিশ্লেষণ করে, সেগুলোর দার্শনিক জবাব বা সমাধান বিজ্ঞানের মত নিশ্চিত নয়। কেননা যখনই দার্শনিক সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান পাওয়া যায় তখনই তা বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। দর্শন যেসব সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপন করে, সেগুলোর চূড়ান্ত উত্তর সর্বদা দিতে না পারলেও আমাদের চিন্তাশক্তির প্রসার ঘটায় এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ-নির্দেশ করে। অনুধ্যানের ফলে সংকীর্ণতা ও ব্যক্তিস্বার্থ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ উদার ও মহৎ মানসিকতার অধিকারী হয়।
দার্শনিক চিন্তা মানুষের বুদ্ধিকে নির্মল ও মার্জিত করে
বিভিন্ন সমস্যার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে দর্শন মানুষকে সজাগ করে তোলে। চট করে কোনো বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয় -এটা দর্শনের শিক্ষা। নির্মোহ মন নিয়ে সমস্ত কিছু বিচার করতে হবে। যুক্তির কষ্টিপাথরে যা সত্য বলে প্রমাণিত হবে তা-ই কেবল গ্রহণ করতে হবে। কোনো উচ্ছ্বাস বা ভাবপ্রবণতা যেন দৃষ্টিকে আচছন্ন করতে না পারে সেদিকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। এরকম দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সমাজের অসাম্য, অসন্তোষ ও অসামঞ্জস্য দূর করে মঙ্গলময় সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
দর্শনের ব্যবহার আছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়
মানুষ যখন যুক্তির আলোকে জীবন পরিচালিত করে তখন অন্যায় লোভ ও ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা তার থাকে না। লোভ ও ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা থেকেই যুদ্ধ বা সংঘাত সৃষ্টি হয়। সার্থক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন আবেগহীন ও পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি। দেশের কল্যাণ-অকল্যাণ সম্বন্ধে সঠিক ধারণা থাকলেই কেবল বোঝা যায়, কোনো দলের মাধ্যমে দেশ-জনতার উপকার সম্ভব। এজন্যই হোয়াইটহেড বলেছেন, সাধারণ শিক্ষায় যতদিন পর্যন্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকবে ততদিন সার্থক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠবে না।
দর্শন মনে আনন্দের সঞ্চার করে
দার্শনিক চিন্তা থেকে আমরা আনন্দ পাই। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব। তাই সে অজ্ঞতার অন্ধকারে থাকতে পছন্দ করে না তাকে জ্ঞান-বুদ্ধির আলোকে পথ চলতে চায়। এই পথ চলায় তার কতটুকু লাভ হবে সেটা বড় কথা নয়, এতে তার মন আনন্দিত হয়, চিত্ত তৃপ্তি লাভ করে, হৃদয়ের ক্ষুধা মেটে। চিত্তের প্রশান্তির জন্যই মানুষ সত্য সন্ধানের চেষ্টা করে। বৈষয়িক লোকদের মতে, এ হলো অকাজের কাজ। কিন্তু এভাবেই আবিষ্কৃত হয়েছে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর বিষয়গুলো। যে দার্শনিক প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান করেন তিনি সন্ধান করেই আনন্দ পান। এই চিন্তা বা অনুসন্ধান নিজস্ব মূল্যে মূল্যবান।
উপসংহার আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, দর্শন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, দর্শন আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
রচনাকাল: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।