দর্শনের উৎপত্তি বা দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি জ্ঞানের উৎপত্তির সাথে জড়িত

দর্শনের উৎপত্তি বা দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি (ইংরেজি: Origin of Philosophy) জ্ঞানের উৎপত্তির সাথে জড়িত। এই অর্থে, দর্শন বা দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি নিবিড়ভাবে জড়িত ধর্ম, গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং রাজনীতির সাথে। যদিও পরবর্তীকালে নিউটনের “প্রাকৃতিক দর্শনের গাণিতিক নীতিসমূহ” (১৬৮৭) বইটিকে পদার্থবিদ্যার বই হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে, যদিও বইটি জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং পদার্থবিজ্ঞানের বিষয় আলোচনা করেছিল, যেগুলো পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত হয়েছিল। যদিও সে সময় বইটিতে প্রাকৃতিক দর্শন শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল, যেহেতু তখন শব্দটি দ্বারা তখন জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে বোঝানো হতো।

মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব। তাই সে চিন্তা করতে পারে। মানুষের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো কৌতূহল প্রবণতা। আর এই কৌতূহলের কারণে সে সব কিছু জানতে চায়। জীবনের ছোটোখাট সাধারণ বিষয় থেকে শুরু করে জগতের জটিল বিষয়গুলো নিয়েও মানুষ চিন্তা করে এবং জানতে চায় এর মূল রহস্য। আর জানতে চাওয়ার জন্য তাকে যে সুশৃঙ্খলভাবে চিন্তা করতে হয় তাই হয়ে ওঠে দার্শনিক চিন্তা। অর্থাৎ মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা থেকেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি। তবে এই চিন্তা সব সময় সবার ক্ষেত্রে একরকম হয় না। এই চিন্তা ব্যক্তিভেদে, জাতিভেদে ও স্থানভেদে বিভিন্ন রকমের হয়। তাই দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা এর উৎপত্তির বিভিন্ন কারণ দেখতে পাই। নিচে আমরা এর প্রধান প্রধান কারণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

বিস্ময় থেকে দর্শনের উৎপত্তি

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭-৩৪৭) মতে, বিস্ময় থেকে দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব হয়েছে। মানুষ যখন নতুন কিছু দেখে, তখন সেই বিষয়টি নিয়ে তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এই বিচিত্র জগতের বিচিত্র সুন্দর ও অদ্ভুত জিনিস দেখে মানুষ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে জানতে চায়, এদের উদ্ভব কোথা থেকে? কে এর স্রষ্টা? কোথায় এর শেষ? ইত্যাদি। এক্ষেত্রে নিজেই সে তার চারপাশের জিনিস থেকে এর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। প্রাচীন গ্রিক দেশে এভাবেই সর্বপ্রথম দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব হয়েছিল। সেখানকার আয়োনিয়া নামক দ্বীপে বাস করতেন প্রাচীনতম দার্শনিক থেলিস (খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৬২৪-৫৪৬ অব্দ)। তিনি দেখলেন, চারদিকেই পানি, স্থল খুব সামান্য। চারদিকে এত পানি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, পানি থেকেই জগতের উৎপত্তি। পানিই জগতের মূল উপাদান। এভাবেই জন্ম নেয় দার্শনিক চিন্তা। এই থেলিস হলেন প্রাচীন গ্রিক দর্শনের জনক।

কৌতূহল থেকে দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি 

মানুষ কৌতূহলী জীব। দেখা-অদেখা সকল বিষয়েই মানুষের রয়েছে অদম্য কৌতূহল। যা সে দেখতে পায় তা কেন ও কিভাবে হলো তা জানতে চায়। যা দেখতে পায় না সে বিষয়েও তার জানার আগ্রহ অসীম। তাই মানুষ পাড়ি জমায় অতল সাগরে, সৌরমন্ডলে এবং এর শেষ কোথায় তা জানতে চায়। মানুষের এই কৌতূহলের শেষ নেই। আর এই কৌতূহল থেকেই উদ্ভব হয় দার্শনিক চিন্তার।

সংশয় থেকে দর্শনের উৎপত্তি

দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, বেকন থেকে আধুনিক দর্শন পর্যন্ত অনেক দার্শনিকের চিন্তাধারাই শুরু হয়েছে সংশয় থেকে। বেকনের মতে, দার্শনিকদের চিন্তাধারা ছিল বাইবেলকেন্দ্রিক। তিনি এর প্রতিবাদ জানান এবং বলেন, অভিজ্ঞতার আলোকে যা সত্য বলে প্রমাণিত হবে তা-ই হবে যথার্থ সত্য।

ডেকার্টের দার্শনিক চিন্তাধারাও শুরু হয় সংশয় থেকে। সংশয় করতে করতে তিনি দেখলেন, সব কিছুকে সংশয় করা গেলেও যিনি সংশয় করেন তাকে সংশয় করা যায় না। কারণ, সংশয়কারী সত্তাকে সংশয় করা হলে সংশয় করার আর কেউ থাকে না। সুতরাং সংশয়কারী সত্তাকে সন্দেহাতীত সত্তা বলে স্বীকার করতে হবে। ডেকার্টের সমস্ত দার্শনিক চিন্তা এই সন্দেহাতীত সত্তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

কান্ট তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মতবাদকে সংশয় করে নিজস্ব মতবাদ প্রদান করেছেন। কান্টের মতে, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির সমন্বয়ে প্রকৃত জ্ঞানলাভ করা যায়। এই ধারণা তিনি পান অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদকে সংশয় করেই।

প্রয়োজনবোধ থেকেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি 

জীবন চলার পথে মানুষের নানা জিনিসের প্রয়োজন হয়। আর এই প্রয়োজন মিটানোর জন্য তাকে চিন্তা করতে হয়। তাই জেমস, শিলার, ডিউই প্রমুখ দার্শনিকের মতে, যে চিন্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন মিটায় সে চিন্তাই করা উচিত। দার্শনিক চিন্তা মানুষকে জীবন-পথে চলতে সাহায্য করে; বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাকে সঠিক পথ-নির্দেশ করে এবং সত্যের সন্ধানে উৎসাহিত করে। তাই বলা যায়, প্রয়োজনবোধ থেকেই দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব।

জ্ঞানপ্রীতি থেকে দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি

‘দর্শন’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Philosophy. Philosophy কথাটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ ‘Philos’ এবং ‘Sophia’ থেকে। Philos শব্দের অর্থ হলো অনুরাগ (loving) এবং Sophia শব্দের অর্থ হলো জ্ঞান (knowledge)। তাই Philosophy কথাটির উৎপত্তিগত অর্থ হলো ‘জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ’। যাদের জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা ভালবাসা আছে তারাই দার্শনিক। এজন্যই দার্শনিক সক্রেটিস নিজেকে ‘জ্ঞান-প্রেমিক’ বলে পরিচয় দিতেন।

মানুষ তার চারপাশে যা দেখে তা-ই জানতে চায়। এক্ষেত্রে সে বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজের মত উত্তর খুঁজে বের করে, এতে সে ক্লান্ত হয় না বরং আনন্দ পায়। তাই বলা যায়, দার্শনিক চিন্তা মানুষের অন্তরের আনন্দের ব্যাপার। আর আনন্দ পায় বলেই, এটা তার স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবে পরিণত হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা বা প্রীতি থেকেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে।

জাগতিক দুঃখে মুক্তিলাভের চিন্তা থেকে দর্শনের উৎপত্তি

ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, ভারতীয় দর্শনের উদ্ভব হয়েছে জাগতিক দুঃখ থেকে কি করে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এই চিন্তা থেকে। চার্বাক দর্শন ব্যতীত সকল ভারতীয় দর্শনের মতে এই পৃথিবী দুঃখময়। আর এই দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হলো, সঠিক জ্ঞান অর্জন করা। প্রকৃত জ্ঞানের অভাবেই জীবন দুঃখময় হয়ে ওঠে। ভারতীয় দার্শনিকরা তাই প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য আজীবন সাধনা করেছেন। মুক্তি লাভের এই জ্ঞানসাধনা থেকেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে।

মরমী চিন্তা থেকেই দর্শনের উৎপত্তি

মানুষ তার ধী-শক্তি দিয়ে শুধু চারপাশের জিনিস নিয়েই যে চিন্তা করে তা নয়। বিচিত্র জগৎ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই; আবার এই জগতের অন্তরালে আরেক জগৎ নিয়েও তার চিন্তা। এ জগতের স্রষ্টা কে? মৃত্যুর পরে মানুষ কোথায় যায়? সেখানে কি ঘটে? ইত্যাদি অসংখ্য প্রশ্ন তার মাথায় আসে এবং সে তার উত্তর খুঁজে বের করে। কখনো সে সন্তুষ্ট হয়, কখনো বা সন্তুষ্ট হতে না পেরে আবার নতুন করে চিন্তা করে। এই অতীন্দ্রিয় সত্তাকে নিয়ে তার যে চিন্তা তা থেকেও দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে।

উপসংহার

দর্শনের বা দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি বিস্ময়, সংশয়, কৌতূহল, প্রয়োজন ইত্যাদি যে কোনো কারণে যেখানেই হোক না কেন, এটি মানুষের জীবনের একটি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত দিক। তাই আমরা দেখতে পাই, প্রতিটি চিন্তাশীল ব্যক্তিরই মৌলিক প্রশ্নাবলির জন্য কিছু নিজস্ব উত্তর আছে, যা নিয়ে তার দর্শন গঠিত। প্রখ্যাত দার্শনিক আর. বি. পেরী বলেছেন, মানুষ কেবল প্রচ্ছন্ন দার্শনিক নয়, বরং একজন আংশিক দার্শনিকও বটে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, দার্শনিক চিন্তা কোনো আকস্মিক বা অলৌকিক ব্যাপার নয়, এটি মানুষের জীবনের অপরিহার্য ও স্বাভাবিক দিক।

রচনাকাল: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!