মানুষ ও তার পরিবেশ এবং মানুষের স্বরূপ সম্পর্কে আবুল কাসেম ফজলুল হক

মানুষ ও তার পরিবেশ এবং মানুষের স্বরূপ (ইংরেজি: Human nature) অনুসন্ধান করেছেন দার্শনিক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। তার চিন্তার একটি বিশাল অংশজুড়ে আছে মানুষ, মানুষের বিকাশ ও মানুষের পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনা। তিনি ইতিহাসের কানাগলি ঘুরে তুলে এনেছেন সংহতি, সাম্য, স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষী মানুষের লড়াইয়ের ধরনগুলোকে। তার কাছে মানুষ হচ্ছে সামাজিক সংগ্রামী জীবনবাদী মানুষ।

আবুল কাসেম ফজলুল হকের কাছে মানুষ হচ্ছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দীর্ঘ সংগ্রাম ও শ্রমের দ্বারা উদ্ভূত এক বিকাশশীল জীব। মানুষকে তিনি পুঁজিবাদী বুদ্ধিজীবীদের মতো এক নিষ্ঠুর আদিম নৃশংস বন্য প্রাণী হিসেবে কখনোই দেখেননি। পুঁজিবাদের উদ্ভবের পর থেকে বিশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অভাবনীয় অগ্রগতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তির বিপ্লব তাক লাগিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বিপুল অধিকাংশ মানুষকে।

বিজ্ঞানের অগ্রগতির উল্টোদিকে বেড়েছে বৈষম্য, সামাজিক অবিচার, হতাশা, সন্ত্রাস, মানুষের দ্বারা মানুষের মানসিক নির্যাতন। রাষ্ট্র ও রাজনীতি, সমাজ ও সমাজনীতি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা কমেছে, শাসকগোষ্ঠী মানবজাতিকে পুনরায় নির্বোধ শিশুতে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছে। সভ্যতার গতি এখন বর্বরতার দিকে। শাসকগোষ্ঠী রেডিও-টেলিভিশন-ইন্টারনেট-পত্রপত্রিকা ও বইপুস্তককে ব্যবহার করছে মগজ ধোলাই করার মেশিনরূপে; এগুলোকে ব্যবহার করছে মানুষকে চিন্তাহীন, চেতনাহীন, বিচারশক্তিহীন, অলস, অন্যের দ্বারা পরিচালিত ও অন্যের উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্রে পরিণত করতে। অথচ প্রচারমাধ্যম ব্যবহৃত হতে পারত জনগণের কল্যাণে।[১] তাই মানুষের এই আধুনিক বর্বরতার মর্ম উপলব্ধি করার চেষ্টা তার মাঝে ছিল কয়েক দশক ধরে।

‘মানুষের স্বরূপ’ উপলব্ধি করে যে প্রবন্ধ তিনি ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে রচনা করেন সেই মানুষকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে, তাদের জন্য লিখতে লিখতে কাটিয়ে দিয়েছেন ছয়টি দশক। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি শুধু ঘটনার দর্শক ছিলেন এমন নয়, ঘটনার গভীরে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছেন মানুষের বাইরের চেহারা ও তার অভ্যন্তরীণ রূপ, Essence ও Appearance—এর সম্বন্ধ কোথায়। মানুষের স্বরূপ প্রতিভাত হয়েছে তার কাছে মানুষের দর্শনরূপে। মানুষের সৃষ্টি, তার সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংগ্রাম ইত্যাদি সম্পর্কে চিন্তা করতে করতে তিনি দেখেছেন মানুষেরই নীচতা, হীনতা, ক্ষুদ্রতা, সংস্কার, গড্ডালিকা প্রবাহে অবাধে গা ভাসানো।

২৫ এপ্রিল, ২০০১ সালে তিনি আমাকে বলেছিলেন ‘আমি উন্নত, রুচিসম্মত, সুন্দর, জ্ঞান-বিবেক-যুক্তি ও আবেগের দ্বারা পরিচালিত মানুষ চাই’। তিনি জানেন, তিনি কী চান; তিনি জানেন, তিনি কার কাছে চান; তিনি জানেন, তিনি কেন তা চান। তিনি চাওয়ার জন্য চাওয়া, করার জন্য করা, লেখার জন্য লেখা, পড়ার জন্য পড়েননি। তিনি ‘মানুষ ও তার পরিবেশ’ উন্নত করার লক্ষ্যে লিখতে শুরু করেছিলেন।

একজন চিন্তাশীল যুক্তিসিদ্ধ লেখক হিসেবে আবুল কাসেম ফজলুল হক যে জীবন একদা শুরু করেছিলেন তা আজ পুষ্ট ও পরিপূর্ণরূপে আমাদের সামনে প্রতিভাত। শৈশব কৈশোরে তিনি যা কিছু দেখতেন তাই তার কাছে সুন্দর মনে হতো; যা কিছু শুনতেন তাই মধুর মনে হতো; জীবনের পরিণত বয়সে তার সেই বোধ আর সকলের মতোই তারও থাকেনি। তিনি এক জীবনে দেখেছেন মানুষ কতো ভালো হতে পারে, আবার তারই উল্টোপিঠে দেখেছেন মানুষ  কতো খারাপ হতে পারে। সেই ভালো-মন্দ মিলিয়ে যে মানুষ তাদের জন্য তিনি সৃষ্টি করতে চান এমন এক সমাজ-রাষ্ট্র যেখানে কল্যাণবোধ প্রখর, শুভবোধ অদম্য, বিবেক ক্রিয়াশীল, সামাজিক চেতনা শক্তিশালী, ন্যায়ের পথ সহজ, সংঘশক্তি বলিষ্ঠ, সংগ্রাম বৈষম্যবিরোধি। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৩৮_১৯০৩) কবিতার একটি লাইন তিনি সর্বদাই স্মরণ রাখেন এবং মাঝে মধ্যে আমাদেরকেও শোনান ‘নাচের পুতুল হয় কী মানুষ, তুললে উঁচু করে’[২]। তিনি জানেন প্রাণহীন পুতুল মানুষ নয়, তেমনি নিষ্প্রাণ মানুষও পুতুল নয়; তিনি সেই নিষ্প্রাণ মানুষকে প্রাণ দিতে উদ্যোগি হন, ঘুমন্ত মানুষকে তার ভিত্তি থেকে, তার ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলতে চান।

কথা বলছেন আবুল কাসেম ফজলুল হক

রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও মনে রাখেন ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’। চে গ্যেভারা (১৯২৮-৬৭) যেরকম একদা বলেছিলেন ‘মানুষের উপরই আমরা ন্যাস্ত করেছিলাম আমাদের সকল আস্থা’[৩] সেরকম তিনিও জানেন এই মানুষই একদা সমস্ত সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। আজকের পৃথিবীতে মানুষকে যতই দুর্বল, নিষ্ক্রিয়, শক্তিহীন মনে হোক না কেন, মানুষের এই রূপই চিরন্তন নয়। তিনি কখনো কখনো আমাদের সামনে এবং হয়তো মাঝে মাঝে নিজের সংগে আবৃত্তি করেন শরৎচন্দ্রের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি ‘ত্রুটি, বিচ্যুতি, অপরাধ, অধর্মই মানুষের সবটুকু নয়। …….মানুষকে তন্ন তন্ন করিয়া দেখিবার চেষ্টা করিলে তাহার ভিতর হইতে অনেক জিনিস বাহির হয়, তখন তাহার দোষ-ত্রুটিকেও সহানুভূতি না করিয়া থাকা যায় না’[৪]। তার আশ-পাশের সমস্ত মানুষ সম্পর্কেই তিনি এরকম ধারণা পোষণ করেছেন সবসময়; তাই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সুস্থির ও নিরাবেগ থাকতে পারেন।

কাছের মানুষগুলোই হয়তো তাকে যন্ত্রণা দেয়; অথচ আবুল কাসেম ফজলুল হক ক্রোধান্বিত হন না কখনোই; বুঝতে চেষ্টা করেন মানুষ কোন গুণ হারিয়ে ফেললে অন্যকে শোষণ, পীড়ন, নির্যাতন করতে পারে; তারপর তিনি মানবের সেই মহৎ গুণের চাষ করার জন্যই কলম ধরেন। তিনি শুধু কলম ধরেই ক্ষান্ত হন না, ঐতিহাসিক বস্তুবাদি দৃষ্টিভঙ্গিতে বুঝতে চেষ্টা করেন মানুষ কবে থেকে স্বার্থপর, হিংসুটে, প্রতারক, পরপীড়ক হলো। তিনি টমাস হবসের (১৫৮৮-১৬৭৯) সেই উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করেন বারবার, যেটাতে মানুষকে লোভী নেকড়েরূপে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘… Life of man solitary, poor, nasty, brute and short’[৫] এবং তারপরেই উল্লেখ করেন ‘কিন্তু এটাই মানুষের একমাত্র রূপ নয়। সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের ভালো কাজের দৃষ্টান্ত কম নেই’। তিনি আরও বলেন ‘মানুষ প্রেমময় এবং প্রেমের ভিখারি। মানুষ ভালোবেসে আত্মত্যাগ করে, ভালোবাসা পাওয়ার জন্য দুঃখ-কষ্ট বরণ করে— এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। সমাজে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ কাজ করে এবং কখনো কখনো ঐক্যবদ্ধ হয়’[৫]।

আবুল কাসেম ফজলুল হক তিনি জানেন পুঁজিবাদ যতই  হবসের জবানিতে মানুষকে লোভি জন্তু হিসেবে দাঁড় করাক না কেন মানুষের এই রূপ সাময়িক। অতি প্রাচিনকাল থেকেই মানুষ সমষ্টিগত সামাজিক জীব; পুঁজিবাদ যতই তাকে স্বার্থপর ও লোভি করুক না কেন মানুষ আবার তার প্রকৃত রূপ ফিরে পাবেই।

তথ্যসূত্র ও টিকা

১. অনুপ সাদি, “নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সভ্যতা ও সংস্কৃতি” দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, ১৯ আগস্ট ২০০২, ঢাকা।
২. আবুল কাসেম ফজলুল হক; প্রাচুর্যে রিক্ততা; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১০; পৃষ্ঠা ৭৬।
৩. দেখুন, সুজিত সেন সম্পা.; লাতিন আমেরিকা ও কিউবা, বিপ্লবী সংগ্রামের ধারা; পুস্তক বিপণী, কোলকাতা; জানুয়ারি, ২০০৫; পৃষ্ঠা ২৮৭।
৪. দেখুন, আবুল কাসেম ফজলুল হক ও মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম সম্পা.; মানুষের স্বরূপ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০০৭; পৃষ্ঠা ৭৩।
৫. আবুল কাসেম ফজলুল হক; রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০০৮; পৃষ্ঠা ১৭৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!