দর্শনের ইতিহাস হচ্ছে দর্শনশাস্ত্রের বিকাশের ইতিহাস ও ধারাবাহিকতার বিবরণ

দর্শনের ইতিহাস (ইংরেজি: History of Philosophy) হচ্ছে ইতিহাসের সেইসব পাঠ্যগুলির পরিসর, বিভিন্নতা এবং গুণাগুণের  প্রসারণ যাতে দর্শনশাস্ত্রের বিকাশের ইতিহাস ও ধারাবাহিকতা পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের দর্শনের ইতিহাস আরবের সামন্ত যুগের আরব দার্শনিক ও ঐতিহাসিকের ধারা অনুসরণ করে এসেছে। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দর্শনের বিকাশ বিচারের বদলে তারা বিভিন্ন দার্শনিক ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গের বিবরণ দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন। এক কথায় দর্শনের ইতিহাস না বলে এ সমস্ত বিবরণকে দার্শনিকের ইতিহাস বলা চলে। প্রসঙ্গতঃ বলা উচিত যে, আরব লেখকের রচনায় তাদের নামকরণ থেকেই একথা বোঝা যায়।[১]

দর্শনের ইতিহাস আবির্ভূত হয়েছে উনবিংশ শতকের গোড়ায়। তখন যে ধারার প্রবর্তন, আজ পর্যন্ত তাই প্রচলিত আছে। ছাত্রদের জন্য পাঠ্যপুস্তক অথবা সাধারণ পাঠকের জন্য সাধারণ বিবরণ যে ধরণের দর্শনের ইতিহাসই রচিত হোক না কেন,—আজকালকার লেখক এখানে ওখানে সামান্য অদলবদল করলেও উনবিংশ শতকের সেই ধারার বাইরে যেতে পারেন নাই।

গত দুশো বছরে দর্শনের ইতিহাস ও আলোচনা অনেক এগিয়ে গেছে। নানা দেশের নানা জাতির পণ্ডিত বহু তথ্য ও তত্ত্বপূর্ণ পুস্তক লিখেছেন, কিন্তু সে সমস্ত বই যখন পড়ি, একটা কথাই বার বার মনে আসে। দর্শনের উদ্ভব ও দর্শনের বিভিন্ন বিভাগের যে বিবরণ এ সমস্ত পুস্তকে মেলে, আমার মতে সে বিবরণ পূর্ণাঙ্গ নয়। দর্শনের ইতিহাসের পূর্ণতর বিবরণের প্রয়োজন তাই আমি বার বার বোধ করেছি।

দর্শন যেমন মানুষের আদি জ্ঞানভাণ্ডার, তেমনি তার ইতিহাস জ্ঞানের যে-কোনো শাখার চেয়ে প্রাচীন। প্রাচীন গ্রিস, ভারত ও চীনে দর্শনের বিস্ময়কর বিকাশের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু দর্শনের বিবর্তনকে দেশ বা জনগোষ্ঠী হিসাবে বিভক্ত করার কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই। জীবন ও জগতের সমস্যা নিয়ে চিন্তাই হচ্ছে দর্শন। মানুষের চিন্তা তার সামাজিক, আর্থনীতিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। এই কারণে মানুষের সমাজ আর্থনীতিক বিকাশের যে প্রধান পর্যায়গুলি অতিক্রম করে এসেছে দর্শনের বিবর্তনেও সেই পর্যায়গুলির প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। এজন্য দর্শনের ইতিহাসকে গ্রিক, ভারতীয়, চৈনিক, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য বা ইউরোপীয়, কিংবা হিন্দু, ইসলামি, বৌদ্ধ প্রভৃতি হিসাবে বিভক্ত না করে দাস সমাজের দর্শন, সামন্তবাদী সমাজের দর্শন, পুঁজিবাদী সমাজের এবং সমাজতন্ত্রী সমাজের দর্শন হিসাবে বিশ্লেষণ করা শ্রেয়।[২]

জীবন ও জগতের যে-কোনো সমস্যাই গোড়াতে দর্শনের আওতাভুক্ত থাকলেও দর্শনের মূল প্রশ্ন হিসাবে বিশ্বসত্তার প্রকৃতি, মানুষের জ্ঞানের ক্ষমতা অক্ষমতার প্রশ্ন, বস্তু ও ভাবের পারস্পরিক সম্পর্ক, মানুষের চিন্তা প্রকাশের প্রকৃষ্ট উপায় বা যুক্তি এবং মানুষের ন্যায়-অন্যায় বোধের ভিত্তি ও তার বিকাশের প্রশ্নগুলি প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত দর্শনের নিজস্ব আলোচনার বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে। দর্শনের এই মূল বিষয়কে ‘মেটাফিজিক, অধিবিদ্যা বা পদার্থ অতিরিক্ত বিদ্যা বলে অনেক সময় অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকালের বিশ্বকোষিক এ্যারিস্টটলের আলোচনারাজিকে ফিজিক্স, মেটাফিজিক্সি, লজিক, এথিকস, পলিটিকস, পোয়েটিকস, রেটোরিকস প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করা হয়।

তথ্যসূত্র

১. আবুল কালাম আজাদ, “সূচনা” প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড প্রথম ভাগ, সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণণ সম্পাদিত, এমসি সরকার এন্ড সন্স প্রা লি, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ আশ্বিন ১৩৬৬, পৃষ্ঠা ক-খ।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩০৯-৩১০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!