আনন্দবাদ এমন এক চিন্তাধারা যাতে সকল আনন্দ কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে

আনন্দবাদ (ইংরেজি: Hedonism) হচ্ছে এমন এক চিন্তাধারা যাতে সকল প্রকার আনন্দ কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। দর্শনের ভেতরে আনন্দবাদের কৌশলগত সংজ্ঞাগুলি, যেগুলোকে সাধারণত চিন্তাধারার পাঠ [School] হিসাবে দেখা হয়, সেগুলোতে আনন্দবাদ শব্দটি আলাদা। দৈনন্দিন ভাষায় এই শব্দটি কখনও কখনও “লোক আনন্দবাদ” হিসাবে অভিহিত হয়। দৈনন্দিন অর্থে, এটির নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, পরিণতি বিবেচনা না করে ইন্দ্রিয়জ আনন্দগুলিতে লিপ্ত হয়ে স্বল্পমেয়াদী সন্তুষ্টি অর্জনের অহংকারী সাধনার সাথে যুক্ত। বিস্তৃত অর্থে এটা হচ্ছে নীতিবাদের একটি তত্ত্ব।[১]

মানুষের জীবনে চরম কামনা কি এবং মানুষের সামাজিক আচরণের মূল প্রেরণা কি, এই মৌলিক প্রশ্নের জবাব মানুষ বিভিন্নভাবে দেবার চেষ্টা করেছে। আনন্দবাদ এই সমস্ত জবাবের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এটি একটি প্রাচীন তত্ত্ব। গ্রিসের দার্শনিক এপিকিউরাসের রচনায় এই তত্ত্বের একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

প্রেরণা বাদে মানুষ কোনো কাজই সম্পাদন করতে পারে না। আনন্দবাদের প্রতিপাদ্য হলো, আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে মানুষের সকল কাজের অন্তর্নিহিত প্রেরণা। কিন্তু আনন্দ বলতে কি বুঝবে, এ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। কেউ বলেছেন, আনন্দ হচ্ছে দৈহিক সুখ। আবার কেউ বলেছেন, দেহের আনন্দই একমাত্র সুখ নয়। ন্যায় ও ধর্মের কারণে দৈহিক আনন্দের বিসর্জনও মানুষের জন্য সুখকর এবং কাম্য হতে পারে। ব্যাখ্যার এই পার্থক্যের ভিত্তিতে আনন্দবাদকে মনস্তাত্ত্বিক এবং নীতিগত আনন্দবাদ এই দুটি উপবিভাগে বিভক্ত করা হয়।

মনস্তাত্ত্বিক আনন্দবাদের মতে, মানসিক সুখ হচ্ছে সকল কাজের মূল। মানুষ যখন কোনো বিশেষ আনন্দকে বিসর্জন দেয় তখনও সে অপর কোনো আনন্দলাভের কথা মানসিকভাবে কল্পনা করে। নীতিবাদী আনন্দবাদের মতে সুখের কামনা মানুষের কেবল ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। আনন্দেরর কামনা মানুষের একটি দায়িত্ব বা কর্তব্য। কেননা আনন্দলাভের কামনা ব্যতীত মানুষের জীবন আদৌ ক্রিয়াশীল হতে পারে না।

আনন্দের ক্ষেত্রে আর একটি প্রশ্ন হচ্ছে: সুখ কি ব্যক্তিগত হবে, না সমষ্টিগত হবে। এ প্রশ্নে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত আনন্দবাদ বলে দুটি উপধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত সুখবাদের ব্যক্তির কাছে নিজের আনন্দ হচ্ছে চরম কথা ও একমাত্র কাম্য। সমষ্টির আনন্দ যদি ব্যক্তির আনন্দের পরিপোষক হয় তবেই ব্যক্তি সমষ্টির আনন্দেরও কামনা করতে পারে। ব্যক্তির আনন্দের পরিপন্থী হলে নয়।

অনেকে এপিকিউরাস এবং এরিসটিপাসকে ব্যক্তিগত আনন্দবাদের প্রবক্তা মনে করেন। কিন্তু আনন্দের ব্যাখ্যায় এপিকিউরাস এবং এরিসটিপাসের মধ্যেও পার্থক্য আছে। এরিসটিপাস যেখানে মুহুর্তের আনন্দকেই প্রধান মনে করেছেন, এপিকিউরাস সেখানে মুহুর্তের বাইরে ব্যক্তির সামগ্রিক জীবনের আনন্দকে ব্যক্তির লক্ষ্য বলে নির্দেশ করেছেন। মিল ও বেন্থামের উপযোগবাদে সমষ্টিগত আনন্দবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। উপযোগবাদ বা হিতবাদের একটি বহুল উল্লিখিত বাক্য হচ্ছে: ‘বৃহত্তম সংখ্যার বৃহত্তম পরিমাণ হিত হবে মানুষমাত্রের লক্ষ্য’।[২]

উপযোগবাদের সংগে আনন্দবাদ বিষয়টির সম্পর্ক

আধুনিক ইউরোপের জন স্টূয়ার্ট মিল, জেরেমি বেনথাম প্রমুখ দার্শনিকের উপযোগবাদ বা হিতবাদ নামক নীতিতত্ত্বের উৎস হিসাবে এপিকিউরাসের অভিমতকে উল্লেখ করা হয়। জন স্টূয়ার্ট মিল অবশ্য বৃহত্তম পরিমাণ সুখ বলতে কেবল সুখের পরিমাণই বুঝাতে চান নি। তিনি সুখের ক্ষেত্রে পরিমাণ ও গুণের প্রশ্নটি বিবেচনা করেছেন এবং গুণগতভাবে যে সুখ কাম্য তাকে পরিমাণ নির্বিশেষে কাম্য বলে মনে করতেন।

ফরাসি বিপ্লবের আগের ও পরের ইংল্যাণ্ডের রাষ্ট্রীয় বিধানের অধিকাংশই ছিল অলিখিত। আইনের বিশ্লেষণ করে বেনথাম বলেন, রাষ্ট্রের যে কোনো বিধানেরই একটি খারাপ দিক আছে। এর দ্বারা আহত ব্যক্তির সুখ বিনষ্ট হয়। কিন্তু বিনষ্ট পরিমাণের চেয়ে লব্ধ সুখের পরিমাণ অধিক হওয়া মধ্যেই এ বিধানের ন্যায্যতা নিহিত।

অর্থাৎ বেনথামকে কেন্দ্র করে থাকা দলটি পরিমাণগত পদ্ধতিকে সমর্থন করে। বেনথাম বিশ্বাস করতেন যে কোনো আনন্দের মূল্যকে পরিমাণগতভাবে বোঝা যায়। মূলত, তিনি বিশ্বাস করতেন যে আনন্দের মূল্যের তীব্রতা তার সময়কাল দ্বারা বহুগুণ হয়ে যায় — সুতরাং এটি কেবল আনন্দগুলির সংখ্যা ছিল না, আনন্দের তীব্রতা এবং আনন্দ কত দিন স্থায়ী হয়েছিল তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ২৪ মে ২০১৯, “আনন্দবাদ হচ্ছে নীতিবাদের একটি তত্ত্ব”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/encyclopedia/philosophical-glossary/on-hedonism/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৯০-১৯১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!