সুখবাদ মানুষের সর্বোচ্চ মঙ্গলার্থক শব্দ হিসাবে নীতিশাস্ত্রের একটি মতবাদ

সুখবাদ (ইংরেজি: Eudemonism বা Eudaimonia বা eudaemonia বা eudemonia,) একটি গ্রীক শব্দের অনুবাদ যা সাধারণত ‘সুখ’ বা ‘কল্যাণ’ হিসাবে ভাষান্তরিত হয়; তবে আরও সঠিক অনুবাদগুলিতে এটাকে ‘মানব-বিকাশ, সমৃদ্ধি’ এবং ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটা মূলত নীতিশাস্ত্রের পাশ্চাত্যের একটি মতবাদ।

এরিস্টটলের কাজে, সুখবাদ মানুষের সর্বোচ্চ মঙ্গলার্থক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল, এবং তাই এটি নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক দর্শনসহ ব্যবহারিক দর্শনের লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত। ফলে এটি এরিস্টটলীয় নীতিবিদ্যায় আসলে কী এবং এটি কীভাবে অর্জন করা যায় তা নিয়ে আলোচিত হয়েছে। তখন থেকেই এটি এরিস্টটলীয় নীতিশাস্ত্র এবং পরবর্তী হেলেনীয়বাদী দর্শনে কেন্দ্রীয় ধারণা হিসাবে রয়েছে।[১]

ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সুখবাদ

প্রাচীন গ্রিসের ডিমোক্রিটাস, এপিকিউরাস, সক্রেটিস এবং এরিস্টটলের রচনায় এবং ভারতের চার্বাকপন্থীদের আলোচনায় এই নীতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, মানুষের কর্মের নিয়ামক হচ্ছে সুখ। সুখ ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক হতে পারে।

সুখবাদ একটি ইতিবাচক এবং ঐশ্বরিক সত্ত্বার ইঙ্গিত দেয় যে, মানবতা সুখবাদের চেষ্টা করে এবং সম্ভবত পৌঁছাতে সক্ষম হয়। সুখবাদের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে কল্যাণময় দেবতার অনুরূপ একটি অবস্থা অর্জন করা, অথবা পরোপকারী দেবতার দ্বারা সুরক্ষিত হওয়া ও যত্নআত্তি পাওয়া। যেহেতু এটি সর্বাধিক ইতিবাচক অবস্থা হিসাবে বিবেচিত হবে, শব্দটির ঐশ্বরিক প্রকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ এই শব্দটিকে প্রায়শই ‘সুখ’ [happiness] হিসাবে অনুবাদ করা হয় তবে ভাগ্যবান বা ধন্য হওয়ার ধারণাগুলি অন্তর্ভুক্ত করার অর্থে এই শব্দটির বিস্তৃত অর্থ ঘটে। এই ব্যুৎপত্তিটি সত্ত্বেও, প্রাচীন গ্রীক নীতিশাস্ত্রে সুখবাদ সম্পর্কিত আলোচনা প্রায়শই কোনও অতি-প্রাকৃতিক তাত্পর্য থেকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়।

আধুনিক কালে সুখবাদ

ইতিহাসের আধুনিক যুগে ইউরোপে ফরাসি দেশের হেলভেটিয়াস, দিদেরো এবং ইংল্যাণ্ডের জেরেমি বেনথাম ও জন স্টুয়ার্ট মিলকে এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা হিসাবে দেখা যায়। প্রাচীন সুখবাদ কিংবা আধুনিক আনন্দবাদের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, এ তত্ত্বের প্রবর্তকগণ কোনো অতিজাগতিক নীতি বা আদর্শকে মানুষের কর্মের নির্ধারক বলেন নি। স্বর্গলোকে নয়, এই পৃথিবীতে মানুষ কীভাবে সুখময় জীবন যাপন করতে পারে সে কথা এঁরা আলোচনা করেছেন। এ দিক থেকে সুখবাদ বস্তুবাদী তত্ত্ব। কিন্তু বাস্তব সামাজিক-আর্থিক অবস্থা নিরপেক্ষভাবে সুখকে কাম্য বললেই ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে সুখ প্রতিষ্ঠিত হয় না।

মহৎ সুখকে আদর্শ বলে যদি ব্যক্তি কল্পনা করে, তা হলেও সুখ তার লাভ না হতে পারে। সুখের প্রতিষ্ঠা সম্ভব সামাজিক অসঙ্গতি দূরীকরণের মাধ্যমে। কাজেই মহৎ সুখ কি এবং কি করে তা লাভ করা যায়, তার আলোচনা কোনো বিশেষ যুগের সমাজ ব্যবস্থার আলোচনা এবং তার অসঙ্গতি দূরীকরণের উপায় নির্দেশ ব্যতীত অবাস্তব এবং অসার্থত হতে বাধ্য। এ কারণে এপিকিউরাস, সক্রেটিস কিংবা আধুনিক হিতবাদীদের নীতি-তত্ত্বের কোনো বাস্তব ব্যবহারিক তাৎপর্য দেখা যায় না।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুখবাদী তত্ত্ব নির্বিচার দৈহিক সুখলাভের বিকারে পর্যবসিত হয়েছে। সামাজিক সমস্যার বিশ্লেষণ ও তা নিরসনের উপায়ের ইঙ্গিত না থাকাতে প্রতিপক্ষীয়গণ এপিক্যুরাসের মতকে যদৃচ্ছা সুখ ভোগ এবং চার্বাকবাদীদের মতকে ‘ঋণং কৃত্য ঘৃতং পিবেৎ’-এর তত্ত্ব বলে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছে।[২]

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ২১ মে ২০১৯, “সুখবাদ হচ্ছে ইউরোপীয় নীতিশাস্ত্রের জনপ্রিয় একটি মতবাদ”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/encyclopedia/philosophical-glossary/eudaimonia/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৬১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!