বিভিন্ন দার্শনিকের দেয়া দর্শনের বিভিন্ন সংজ্ঞা বিষয়ক আলোচনা

দর্শনের সংজ্ঞা বা দর্শন কী বা কাকে বলে (ইংরেজি: Definitions of Philosophy) সংক্রান্ত আলোচনায় দার্শনিকগণ সম্পূর্ণভাবে একমত হতে পারেননি। তাই বিভিন্ন দার্শনিক দর্শনের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এই সংজ্ঞাগুলো থেকে আমরা দর্শনের একটি সামগ্রিক রূপ লাভ করতে পারি। নিচে দার্শনিকদের বিভিন্ন সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো।

বিভিন্ন দার্শনিকের দেয়া দর্শনের বিভিন্ন সংজ্ঞা

দর্শন অধিবিদ্যার সাথে অভিন্ন

প্লেটো বলেন, শাশ্বত ও বস্তু স্বরূপের জ্ঞানলাভ করাই দর্শনের লক্ষ্য।
অ্যারিস্টটল বলেন, সত্তা স্বরূপত যা এবং এই স্বরূপের অঙ্গীভূত যেসব বৈশিষ্ট্য, তার অনুসন্ধান করে যে বিজ্ঞান তা-ই হলো দর্শন।
ফ্রিডরিখ হেগেল বলেন, শাশ্বতের, ঈশ্বরের স্বরূপের এবং ঈশ্বরের স্বরূপ থেকে নির্গত জিনিসের জ্ঞানই হলো দর্শন।
ব্রাডলি বলেন, দর্শন হলো নিছক অবভাসের পরিবর্তে বাস্তব সত্তা জানার প্রচেষ্টা।

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলো থেকে বোঝা যায়, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হেগেল ও ব্রাডলি দর্শনকে অধিবিদ্যার সাথে অভিন্ন মনে করেছেন। অধিবিদ্যা দর্শনের একটি অপরিহার্য শাখা। কিন্তু দর্শন ও অধিবিদ্যা এক নয়। অধিবিদ্যার মত দর্শনের আরও অনেক শাখা আছে। শুধু একটা শাখাকে সম্পূর্ণ দর্শন বলে অভিহিত করলে দর্শন সম্বন্ধে অত্যন্ত সংকীর্ণ ধারণা হয়। সুতরাং দর্শনের এই সংজ্ঞাগুলোকে সঠিক বলে মেনে নেয়া যায় না।

দর্শন বিভিন্ন বিজ্ঞানের একীভূত রূপ

অগাস্ট কোঁতে বলেন, দর্শন হলো সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান।
পলসন বলেন, দর্শন হলো সমস্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমষ্টি।
ভুন্ট বলেন, ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞানকে একটি সুসামঞ্জস্য সমগ্রতায় একীকরণই দর্শন।
হার্বাট স্পেন্সার বলেন, দর্শন হলো পরিপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ জ্ঞান -দর্শনের সামান্যীকরণগুলো বিজ্ঞানের ব্যাপকতম সামান্যীকরণগুলোকে উপলব্ধি করে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ করে।

কোঁতে, পলসন, ভুন্ট ও স্পেন্সার দর্শনকে বিভিন্ন বিজ্ঞানের একীভূত রূপের সাথে অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বিভিন্ন বিজ্ঞানের জ্ঞানকে একত্রীকরণের জন্য সমস্ত বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা আবশ্যক, যা একজন দার্শনিকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে বদলে যেতে পারে, কিন্তু দার্শনিক সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে বদলে যায় না। সুতরাং বিভিন্ন বিজ্ঞানের একীভূত রূপ দর্শন, একথা বলা যায় না।

দর্শন জ্ঞানবিদ্যার সাথে অভিন্ন

ভাববাদী দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলেন, দর্শন হলো জ্ঞান সম্পর্কীয় বিজ্ঞান ও তার সমালোচনা।
ফিকটে বলেন, দর্শন হলো জ্ঞানের বিজ্ঞান।

কান্ট ও ফিকটে দর্শনকে জ্ঞানবিদ্যার সাথে অভিন্ন মনে করেন, অর্থাৎ এই সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দর্শনকে বিজ্ঞানের সাথে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। জ্ঞানবিদ্যা দর্শনের একটি শাখা মাত্র। তাঁদের এই সংজ্ঞা দর্শনকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করে তুলেছে। তবে এরূপ সংজ্ঞায় সপষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় নয়, এটা দর্শনেরই আলোচ্য বিষয়।

দর্শনের সত্যতা সম্পর্কিত সংজ্ঞা 

মারভিন বলেন, দর্শন হলো সত্যের প্রতি অনুরাগ – জ্ঞানের এমন পূর্ণ ভান্ডার সব সত্য যার অন্তর্ভুক্ত এবং যাতে সব সত্য এক মহান অখন্ডতা বা তন্ত্রের মধ্যে সুবিন্যস্ত।

মারভিনের এই সংজ্ঞায় দর্শনের ক্ষেত্রে সত্য লাভের গুরুত্ব যথার্থভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু সত্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে দর্শন যে সুন্দর ও শুভ নিয়েও আলোচনা করে, তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এখানে সকল সত্যের এক মহান অখন্ডতার কথা বলা হয়েছে যা সম্ভব নয়।

দর্শনের প্রকৃতি সম্পর্কিত সংজ্ঞা  

ওয়েবার বলেন, দর্শন হলো প্রকৃতি সম্পর্কে সামগ্রিক মত অন্বেষণ এবং বস্তুর সার্বিক ব্যাখ্যা দানের প্রচেষ্টা।

ওয়েবারের এই সংজ্ঞায়, জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা যে দর্শনের কাজ, একথা স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু মূল্যাবধারণও যে দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ একথা স্বীকৃত হয়নি। তার সংজ্ঞাটি অতি সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। সুতরাং এই সংজ্ঞাও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের মতে দর্শনের সংজ্ঞা

যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা বলেন, দর্শন হলো ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণ বা সমালোচনা। যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের মতে, দর্শনে এতদিন যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেগুলো সত্যিকারের কোনো সমস্যা নয়, ছদ্ম-সমস্যা মাত্র (pseudo-problem)। যেমন, দ্রব্য কি, স্রষ্টা কি, আত্মা কি, বস্তুবাদ ও ভাববাদের মধ্যে কোনটা ঠিক? প্রভৃতি প্রশ্ন বা সমস্যা ছদ্ম-সমস্যা মাত্র।

যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা প্রত্যক্ষবাদী বলে যা সাধারণ প্রত্যক্ষে পাওয়া যায় না তার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। বিধাতা, আত্মা প্রভৃতি সাধারণ প্রত্যক্ষের অতীত, সেজন্য তাদের মতে এগুলো অস্তিত্বহীন। সুতরাং এসব নিয়ে আলোচনা অর্থহীন।

যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের মতে, অধিবিদ্যায় যে সমস্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয় তা প্রত্যক্ষের ভিত্তিতে আলোচ্য নয় বলে অলীক, প্রকৃত সমস্যা নয়। পূর্ববর্তী দার্শনিকরা এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেননি, তার কারণ ভাষাগত জটিলতা। আমরা এমনভাবে ভাষা তৈরি করেছি যে, গুণ (রূপ, রস, গন্ধ) নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দ্রব্যবাচক কোনো শব্দ আমরা ব্যবহার করি। যেমন, রূপ বলতে গেলেই আমরা কোনো না কোনো দ্রব্যের  যেমন ফুল, টেবিল ইত্যাদির রূপ বোঝাই। আসলে দ্রব্য বলে কিছু নেই। এটা আমাদের ভাষার সৃষ্টি। তাঁদের মতে, অধিবিদ্যার সমস্যাগুলোর মূলই হলো এই ভাষাজনিত বিভ্রান্তি। দর্শনের কাজ এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের চেষ্টা নয়, বরং ভাষার বিশ্লেষণ ও সমালোচনা যাতে বোঝা যাবে এগুলো কোনো সমস্যাই নয়। এককথায়, ভাষার বিশ্লেষণ ও সমালোচনাই দর্শনের কাজ।

ভিটগেনস্টাইন বলেন, দর্শনের কাজ চিকিৎসামূলক (therapeutic) – ভাষার সমালোচনা দ্বারা আমাদের বিভ্রান্তি দূর করা এবং তথাকথিত দার্শনিক সমস্যাগুলোর মূল উৎপাটন করা।

দর্শন সমগ্র সত্তার প্রকাশ, স্বরূপ ও আদর্শ উপলব্ধির চেষ্টাকারী বিজ্ঞান। পরিশেষে বলা যায়, জীবন ও জগতের স্বরূপ অবহিত হয়ে তারই আলোকে মানুষের জীবন সংঘাতের কারণস্বরূপ নানারূপ অনুদার মতবাদ ও অন্ধ কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞান বা সত্যের অনুসন্ধানে ভাবাবেগের পরিবর্তে উদার দৃষ্টিভঙ্গি, অনুধ্যান, বিচার বিবেচনা, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের মাধ্যমে সত্তা, জগৎ ও জীবনের সাথে জড়িত বিভিন্ন সমস্যার সুষ্ঠু, যুক্তিসম্মত গুঢ় আলোচনা করার নামই দর্শন।[১]

উপসংহার

দর্শনের সংজ্ঞা বিষয়ক এই আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, দর্শনের সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। প্রত্যেক দার্শনিক তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে এর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তবে এসব সংজ্ঞা সর্বজনগ্রাহ্য না হলেও একেবারে সঠিক নয় বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা এগুলো দর্শনের কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে।

তথ্যসূত্র

১. মো. আবদুল ওদুদ, রাষ্ট্রদর্শন, ঢাকা: মনন পাবলিকেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৪ পৃষ্ঠা ২০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!