ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের সমালোচনা (ইংরেজি: Critique of classical German philosophy) হচ্ছে মার্কসবাদের উদ্ভবের সময়ে কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস কর্তৃক ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের বিরুদ্ধতা করে লেখা একগুচ্ছ দার্শনিক আলোচনা। মূলত জার্মান ভাবাদর্শ এবং লুডভিগ ফয়েরবাখ এবং ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের অবসান নামক দুটি গ্রন্থে এই আলোচনা করা হয়েছে।
ধ্রুপদী জার্মান দর্শন (ইংরেজি: Classical German Philosophy) হলো অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের এবং উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকের জার্মান দর্শনের বিকাশের একটি পর্যায় যখন পরস্পর দুটি চিন্তাধার আবির্ভূত হয়েছিল। একটি ধারা হচ্ছে জার্মান ধ্রুপদী ভাববাদ, যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ইমানুয়েল কান্ট, জে. জি. ফিখটে, এফ. ডব্লিউ. শেলিং ও ফ্রিডরিখ হেগেল। অন্য ধারাটি হচ্ছে লুডভিগ ফয়েরবাখ-এর বস্তুবাদ। এই সময়ের প্রধান কৃতিত্ব ছিল বিকাশের যুক্তি হিসেবে দ্বান্দ্বিকতার সৃষ্টি। ‘ধ্রুপদী জার্মান দর্শন’ শব্দটি ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তার রচনা লুডভিগ ফয়েরবাখ এবং ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের অবসান গ্রন্থে ব্যবহার করেছেন। ধ্রুপদী জার্মান দর্শন হচ্ছে মার্কসবাদের অন্যতম উৎস।
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের গ্রন্থ লুডভিগ ফয়েরবাখ এবং ধ্রুপদি জার্মান দর্শনের অবসান ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। বইটির গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক তাৎপর্য রয়েছে। এই গ্রন্থে দেখানো হয়েছে দর্শনের অগ্রদূতদের প্রতি মার্কসবাদের সম্পর্ক। এঙ্গেলস এই বইতে হেগেলীয় দর্শন এবং ফয়েরবাখের শিক্ষার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। তাঁর ও কার্ল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের ব্যাপারে এই দুই দার্শনিকের কীরূপ প্রভাব ছিল তিনি সে কথাটি জোর দিয়ে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে এঙ্গেলস দেখিয়ে দেন, হেগেলের ভাববাদী দর্শনের মূল গলদগুলো এবং ফয়েরবাখের বস্তুবাদের সংকীর্ণতা।
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের এই গ্রন্থে দেখানো হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রকৃত চরিত্র,— এ পরিবর্তন জড়িত ছিল দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে,— এবং দেয়া হয় মার্কসবাদী দর্শনের প্রধান নীতিসমূহের সুসম্বদ্ধ বিবরণ। অন্যান্য রচনার মতো এখানেও এঙ্গেলস দর্শনে পার্টি আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন এবং সমস্ত প্রশ্ন বিবেচনা করেন দুই দার্শনিক শিবির— বস্তুবাদ আর ভাববাদের সংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে।[১]
ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের সমালোচনার প্রেক্ষাপট
হেগেলের ভাববাদী, রক্ষণশীল ব্যবস্থাকে তার বস্তুবাদী, দ্বান্দ্বিকতার বিপ্লবী পদ্ধতি থেকে আলাদা করতে হবে। হেগেলের ভাববাদী ব্যবস্থা এবং “দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন”: চিন্তা ও সত্তার সম্পর্ক বিষয়টির বিরুদ্ধ নিয়মের দিকে ফয়েরবাখ ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু ফয়েরবাখ হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যে কারণে মানুষ ও প্রকৃতি সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বিমূর্ত এবং অঐতিহাসিক থেকে যায়। মার্কস শুধুমাত্র দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি থেকে “যৌক্তিক” বিষয়বস্তুটুকু রেখেছিলেন এবং তাদের ভাববাদী রূপ থেকে মুক্ত করেছিলেন।
তথ্যসূত্র
১. ইয়েভগেনিয়া স্তেপানভা, এঙ্গেলস, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০১২, পৃষ্ঠা ১৭৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।