হেগেলের জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা হচ্ছে জার্মান রাষ্ট্রের চূড়ান্ত উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠ শক্তি

ফ্রিডরিখ হেগেলের জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা (ইংরেজি: National state of Hegel) হচ্ছে জার্মান রাষ্ট্রের চূড়ান্ত উৎকর্ষ, শ্রেষ্ঠ শক্তি এবং বিশ্ব ইতিহাসে উনিশ শতক ও তার পরবর্তী পর্যায়ে জার্মান জাতির আধিপত্যকারী যুগ। তিনি রাষ্ট্রকে পৃথিবীর চূড়ান্ত শক্তি হিসেবেই গণ্য করেছেন এবং তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রের কাজের বিচার করতে পারে একমাত্র ইতিহাস। এক্ষেত্রে হেগেল জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণায় এসেছেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের রোমান্টিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হেগেল রাষ্ট্রে জাতীয় প্রেরণা (National Spirit) ধারণাটি আরোপ করেছেন। জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা প্রকাশের মধ্য দিয়ে হেগেল তৎকালীন জার্মানীর জাতীয় চিন্তা ও ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন। জার্মান রাষ্ট্রের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতেই হেগেল রাষ্ট্রের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করেছেন। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য, নৈতিক ও মানসিক ঐক্যবোধের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে হেগেল জার্মানীর জনগণ তথা জার্মানীর জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্যকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন।  

ফ্রিডরিখ হেগেল বলেছেন জাতীয় রাষ্ট্র হলো সেই মন যা স্থায়ীভাবে যুক্তির এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবতার প্রকাশ এবং এই বৈশিষ্ট্যই রাষ্ট্রকে পৃথিবীতে চরম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। হেগেল মনে করেন প্রতিটি রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে সার্বভৌম এবং স্বতন্ত্র। এক্ষেত্রে বিশেষ সত্তা হিসেবে এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রগুলির আচরণে আবেগ, ব্যক্তিগত স্বার্থ, সামর্থ্য, গুণাবলি, ভুল-ভ্রান্তি, শক্তি সবকিছুই প্রকাশ পেতে পারে।

স্বতন্ত্রভাবে রাষ্ট্রের এইসব আচরণগত বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রের নিজস্ব সুবিধার্থেই প্রকাশ পায়। জাতীয় মন বা চেতনা রাষ্ট্রের এই সব বিশেষত্বের কারণে চাপা পড়ে যায়। তবে রাষ্ট্রগুলির এইসব আচরণগত বৈশিষ্ট্য দ্বান্দ্বিকভাবে প্রতিফলিত হয় এবং স্বাভাবিক দ্বান্দ্বিক নিয়মেই রাষ্ট্রগুলির ক্রিয়া প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই উঠে আসে এক সার্বিক মন বা চেতনা। হেগেল এই সার্বিক মনকেই বলেছেন “mind of the world”. এই বিশ্বমন কোনো বাধা বা সীমার অধীন নয়। এই বিশ্বমন তার নিজের অধিকার প্রয়োগ করে এবং এই অধিকারই হলো সব নিয়মের শ্রেষ্ঠ। বিশ্ব ইতিহাস হলো এই বিশ্বমনের বিচারসভা। এই বিচারসভার বিচার শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

বিশ্ব মনের অচেতন অংশ বা বিভাগ হিসাবেই আসে জাতীয় রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ ইতিহাসের এক দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। যুদ্ধ সমস্ত জাতীয় রাষ্ট্রের সীমিত রূপকে প্রতিফলিত করে একথা মনে রেখেও হেগেল বলেন যুদ্ধ প্রয়োজন। যুদ্ধ রাষ্ট্রের অহমিকা, পার্থিব সুবিধা ও স্বার্থের প্রকাশ, জাতির বিকৃত বা অসাধু রূপ একথা ঠিক, কিন্তু এর প্রয়োজন আছে, কারণ জাতির জীবনে দীর্ঘ শান্তির মধ্যে যখন বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝা আসে, উত্তাল হয়ে উঠে জাতির জীবন, বিপথে পরিচালিত হয়ে যায় জাতি, তখন যুদ্ধ এসে জাতির জীবনের এই ঝড়-ঝঞ্ঝাকে প্রশমিত করে আবার তাকে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনে।

যুদ্ধ আকস্মিক, কিন্তু এই আকস্মিক প্রয়োজনীয় ব্যাপারটিই নৈতিকতাকে ফিরিয়ে আনতে কার্যকরি। হেগেল মনে করেন যুদ্ধ ও সশস্ত্র শক্তি হলো রাষ্টের সার্বভৌমিকতা বা স্বাধীনতার গ্যারান্টি। যেখানে সম্মতির মধ্য দিয়ে বিবাদ মেটে না সেখানে যুদ্ধ প্রয়োজন। রাষ্ট্রকে স্বাবলম্বী করতে, সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় করতে যুদ্ধ প্রয়োজন। যুদ্ধ ক্ষমতার প্রকাশ অন্যায়, একথা মেনে নিয়েও বলা যায় এর একটা নৈতিক চরিত্র আছে। যুদ্ধ ব্যক্তি-মানুষ বা অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চালানো হয়। তাছাড়া আগের চেয়ে যুদ্ধের প্রকাশ এখন অনেকটাই মানবিক। হেগেল কান্টের রাষ্ট্রসমবায় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় পৃথিবী চিরস্থায়ী শান্তি আনতে পারে একথা বিশ্বাস করেন না। বিশেষ পর্যায়ে বা যুগে একটি রাষ্ট্র বিশ্ব-শক্তি বা প্রেরণার প্রকৃত প্রতিনিধি হতে পারে – হেগেল এই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আন্তর্জাতিক আইনকে হেগেল এক ধরণের বাধ্যবাধকতা বলেই মনে করেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সার্বভৌম ইচ্ছার উপরই এই বাধ্যবাধকতার প্রকৃত অবস্থাটি নির্ভর করবে। আসলে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ইচ্ছার উপর কোনো সর্বোচ্চ আইন বা বিচারক নাই। রাষ্ট্রে চেতনা বা নৈতিকতাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব নির্ধারণ করে। হেগেল আন্তর্জাতিক আইন নয় বিশ্ব প্রেরণাকে আদর্শ করেছেন এবং এই বিশ্ব প্রেরণা পৃথক পৃথক রাষ্ট্রের চেয়ে বড়। বিশ্ব ইতিহাস এই বিশ্ব  প্রেরণাকেই সুরক্ষিত করে।

বিশ্ব ইতিহাস সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের ইতিহাস, তাদের প্রগতির ইতিহাস। বিশ্ব ইতিহাসের চারটি পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন হেগেল, যে চারটি পর্যায়ে চারটি রাজত্ব লক্ষণীয়। এগুলি হলো প্রাচ্য, গ্রিক, রোমক ও জার্মান। প্রাচ্যে থাকে একজনের স্বাধীনতা (স্বৈরতন্ত্র), গ্রিক এবং রোম কতিপয়ের স্বাধীনতা, আর জার্মান জগৎ সকলের স্বাধীনতার নীতিতে আস্থাশীল। হেগেল বিশ্বাস করেন ইতিহাসের বিশেষ স্তরে প্রভুত্বকারী জাতি একবার করে বিশ্ব ইতিহাস রচনায় সুযোগ পায়। বিকাশের পর্যায়ে দ্বান্দ্বিকতার প্রক্রিয়ায় একে একে আসে প্রাচ্য, গ্রিক, রোম ও জার্মান: রিফর্মেশনের পর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগটিকে হেগেল জার্মান জাতির যুগ বলেছেন।

বিশ্ব ইতিহাসে উনিশ শতক ও তার পরবর্তী পর্যায়ে জার্মানীরই আধিপত্য। জার্মান জনগণ, তার কৃষ্টি সভ্যতা, রাজনীতি সুবকিছুই অন্যান্য জাতিকে পথ দেখাবে। হেগেলের চিন্তায় প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্র হাল বিশ্লেষণ (Thesis), গ্রিস ও রোমক গণতন্ত্র হলো প্রতিবিশ্লেষণ (Antithesis) এবং জার্মান সাংবিধানিক রাজতন্ত্র হলো সংশ্লেষণ (Synthesis)। জার্মান রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই হেগেল পেয়েছেন প্রাচ্য, গ্রিক ও রোমক ব্যবস্থার সুবিধা। শুধু উভয়ের গুণের সংশ্লেষণ নয়, এই ব্যবস্থা নিজ গুণে ও মহিমায় সমৃদ্ধ।

হেগেল দ্বান্দ্বিক নিয়ম বা প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের বিকাশের কথা বলেছেন। পরিবার, সুশীল সমাজ ও রাষ্ট্র হেগেলের মতে দ্বান্দ্বিক নিয়মে একটি আর একটির পরে গুরুত্ব অনুসারে হাজির হয়। পরিবার ব্যক্তির অপর্যাপ্ত চাহিদা মেটাতে পারে না। পরিবারের সীমিত গণ্ডির মধ্যে তা সম্ভবও নয়। সুতরাং ব্যক্তি সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এই পৌরসমাজ বা সামাজিক সংস্থা চুক্তি দ্বারা গঠিত এবং স্বার্থবোধ দ্বারা পরিচালিত হয় বলে এরাও মানুষের প্রকৃত ইচ্ছা, স্বার্থ বা স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে পারে না। সুতরাং রাষ্ট্রই হলো সেই প্রয়োজনীয় শক্তি বা প্রেরণা যা ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা ও স্বাধীনতাকে কার্যকর করতে পারে (State is the ethical whole and the actualization of freedom)। হেগেলের মতে তাই জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণাটিই হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রই সংশ্লেষণের ধারণা ও ঐক্যের প্রেরণা।

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র

১. মো. আবদুল ওদুদ (১৪ এপ্রিল ২০১৪)। “জর্জ উইলহেলম ফ্রেডরিক হেগেল”। রাষ্ট্রদর্শন (২ সংস্করণ)। ঢাকা: মনন পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ৩৮১-৩৮২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!