দর্শনের তিন ধরনের কাজ হচ্ছে অনুধ্যানমূলক, সমালোচনামূলক এবং গঠনমূলক

দর্শনের কাজ বা দর্শন যেসব কাজ করে বা যেসব এলাকা ধরে কাজ করে (ইংরেজি: Working area of Philosophy) সেগুলোকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এই বিষয় তিনটি আলোচনার পূর্বে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। যদি বলা হয় দর্শন কী তাহলে আমরা সাধারণত বলি, দর্শন হলো এমন একটি বিদ্যা যা জগৎ ও জীবনের সকল মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে বিদ্যা জগৎ ও জীবনের সকল মৌলিক দিক নিয়ে আলোচনা করে তার কাজ কি? আমরা এখানে দর্শনেরর কাজ কি ধরনের তা নিয়ে আলোচনা করবো।

দর্শনের কাজ

দর্শনের কাজকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায় ১) অনুধ্যানমূলক (Speculative) ২) সমালোচনামূলক (Critical) ৩) গঠনমূলক (Constructive)।

অনুধ্যানমূলক

বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব বলেই মানুষ চিন্তা করতে পারে। আর এই চিন্তা তার স্বভাবগত প্রবণতা। মানুষ যখন বিশ্বজগতের বৈচিত্র্য ও বিশালতা দেখতে পায় তখন বিস্ময়ে তার মন ভরে ওঠে। এই বিস্ময় থেকে নানা ধরনের প্রশ্ন তার মনে জেগে ওঠে। যেমন, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা কে, এ জগৎ সৃষ্টির পেছনে তার উদ্দেশ্য কী? মানুষের এ জীবনই শেষ, না কি আরেক জীবন আছে? আত্মা কি? মৃত্যু কী? সময় কী? কাল কী? জড় কী? ইত্যাদি নানা ধরনের প্রশ্ন মানুষের মনে জাগে। বুদ্ধির মাধ্যমে সে এগুলোর উত্তর নিজেই দেয়ার চেষ্টা করে। সে চিন্তা করে, সঠিক উত্তর পাওয়ার জন্য সে হয়ে ওঠে আরও চিন্তাশীল। আর এই জীবন ও জগতের যে বুদ্ধিসম্মত ব্যাখ্যা দিতে মানুষ চেষ্টা করে তা-ই দর্শনের মূলমন্ত্র। এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, দর্শনের কাজ হলো অনুধ্যানমূলক (ইংরেজি: Speculative)।

মানুষ শুধু জাগতিক বৈচিত্র্যে কিংবা বিস্ময়ে অভিভূত হয় না, সে এই প্রশ্নসমূহের একটা সুষ্ঠু ও সঙ্গতিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে চায়। আর এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য সে কান্ডজ্ঞানের আশ্রয় নেয়। কিন্তু কান্ডজ্ঞানের পক্ষে তা সম্ভব হয় না, বরং উত্তরগুলো হয়ে ওঠে উদ্ভট, ভ্রান্ত, কিংবা অসঙ্গত। কারণ, কান্ডজ্ঞান নিজেই অসঙ্গতিপূর্ণ। তথাপি মানুষ থেমে থাকে না। কখনও সে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আলোকে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যদিও কান্ডজ্ঞানের চেয়ে অনেক উন্নত, তবু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান খন্ড ও অপূর্ণ। বিজ্ঞান প্রকৃতির এক একটি বিভাগ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা করে, তাই জগতের একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা আমাদের দিতে পারে না। দর্শনের কাজ হলো, অনুধ্যানের মাধ্যমে জগতের একটি সামগ্রিক বা পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেয়া।

সমালোচনামূলক

দর্শনে সব কাজই যে চিন্তা-ভাবনা বা অনুধ্যানের মাধ্যমে করে তা নয়। দর্শনের অনেক কাজই সমালোচনামূলক (ইংরেজি: Critical)। জীবনের মৌলিক প্রশ্ন সম্পর্কে লৌকিক ব্যাখ্যা অনেক সময় মানুষের মনকে তুষ্ট করতে পারে না। আবার বৈজ্ঞানিক আলোচনার ক্ষেত্রেও কিছু ধারণাকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়। দর্শন কোনো কিছুকে নির্বিচারে সত্য বলে ধরে নেয় না। তাই সব কিছুই সমালোচনার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে যা গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত তা-ই মেনে নেয়। যুক্তির কষ্টিপাথরে যা প্রমাণিত সত্য বলে প্রতীয়মান হয়, তাই কেবল দর্শন সত্য বলে মেনে নেয়। আর যা বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সত্য বলে প্রমাণিত হয় না, তা বর্জন করে। এভাবেই দর্শন বিভিন্ন মৌলিক ধারণাবলীর যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করে।

সংগঠনমূলক

খন্ড খন্ড সত্যকে সমন্বিত করে একটি সামগ্রিক সত্য তুলে ধরাও দর্শনের কাজ। দর্শন শুধু অনুধ্যান ও সমালোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। দর্শনের একটি গঠনমূলক দিকও আছে। বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নের উত্তরের একটা সংগঠনমূলক (ইংরেজি: Constructive) ধারণা দেয়ার প্রচেষ্টা চালায় দর্শন। তাই বলা যায়, দর্শনের ভান্ডার হলো জ্ঞানের একটা পূর্ণ ভান্ডার। দর্শন শুধু পরিদৃশ্যমান জগৎ নয়, এর অন্তরালে যে অতীন্দ্রিয় জগৎ আছে, তার সম্পর্কেও আলোচনা করে। দর্শন জীবনের পরম আদর্শ সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল এর যৌক্তিকতা ও স্বরূপ বিচার করে। স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্কের স্বরূপ বিচার করে। এভাবে দর্শন জগৎ ও জীবনের একটি সামগ্রিক রূপ তুলে ধরতে চায়।

রচনাকাল: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!