দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচিত বাংলা গান হচ্ছে প্রেম, স্বদেশী ও হাসির গান

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচিত বাংলা গান (ইংরেজি: Songs of Dwijendralal Ray) হচ্ছে দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত প্রেমমূলক, স্বদেশী বা দেশপ্রেম ও হাসির গান। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান অনেক জনপ্রিয় গান রচনা পরে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গীতে দেশীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। অল্পবয়সেই দ্বিজেন্দ্রলালের গীতিপ্রতিভা স্ফুরিত হয়। তার পিতা কার্তিকেয় চন্দ্র ছিলেন রাজবংশের দেওয়ান। গায়ক ও গীতিকার রূপেও তার খ্যাতি ছিল।

বাল্যবয়সেই পিতার যত্নে ও সাহচর্যে সংগীতের প্রতি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আগ্রহ জন্মে। ছয়-সাত বছরেই পিতৃকণ্ঠে গান শুনে হার্মোনিয়ামে সে গান তুলে নেন। ন’বছর বয়সে অগ্রজের ফরমায়েসে গান বাঁধেন। পিতার কাছেই সঙ্গীত শিক্ষা এবং অল্পবয়সেই সুকণ্ঠ গায়করূপে খ্যাতি লাভ করেন। কবি প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। পল্লীপ্রকৃতির সান্নিধ্য এবং সঙ্গীতজ্ঞ পিতার সাহচর্যে তাঁর প্রতিভা বিকাশ লাভ করে। পারিবারিক পরিবেশে ছিল সাহিত্য ও সঙ্গীতের আবহাওয়া।

১৮৮৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজি এম. এ. পরীক্ষায় পাশের পরে তিনি স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি নেন। চাকরি করার সময়েই সরকারী বৃত্তি নিয়ে কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য বিলাত যাত্রা করেন। সেখানে থাকাবস্থায় বিলাতি গান শুনে আকৃষ্ট হন এবং দক্ষিণা দিয়ে রীতিমাফিক বিলাতি শেখেন ও কণ্ঠমার্জনা করেন। পরবর্তীকালে তার ওজস্বী কণ্ঠ ও অনায়াস সুরের চলন গায়করূপে তাকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়।

দ্বিজেন্দ্রলালের দেশীয় সঙ্গীতের ভিত যথেষ্টই দৃঢ় ছিল। ফলে বিলেত বাসকালে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতে দক্ষতা লাভ করেন। এখানে তিনি Lyrics India নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের কম্পোজিশনে বিলিতি সুরের সংযোগ একই সঙ্গে জনপ্রিয় ও বিতর্কযোগ্য হয়ে ওঠে। তখন তার পক্ষে লিখিত সমর্থন জানান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও দ্বিজেন্দ্রলালের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। অবশ্য জীবনের শেষ দিকে সাহিত্য বিষয়ের সমালোচনা প্রসঙ্গে দুই বন্ধুর মধ্যে মতানৈক্য ঘটেছিল।[১]

দ্বিজেন্দ্রলাল তার মধ্যে গভীর পত্নীপ্রেম এবং নানারকম গানের মজলিস তাকে জোগাতে গান রচনা ও গাইবার প্রেরণা। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯৩ পর্যন্ত ভাগলপুর ও মুঙ্গেরে কর্মরত থাকার কালে প্রসিদ্ধ গায়ক সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের কাছে তিনি মার্গসংগীতের তালিম নেন। তারই ফলে তিনি নৈপুণ্যের সঙ্গে সৃষ্টি করেন বাংলা টপ খেয়াল। প্রথম গীত-সংকলন বেরোয় উনিশ বছরে।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান সাধনা ও অবদান

দ্বিজেন্দ্রলালের গানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। তার মধ্যে দু’শো গান নাটকের প্রয়োজনে লেখা। ১৯০৩ সালে পত্নীবিয়োগের গভীর বেদনা ভুলতে তিনি সাধারণ রঙ্গমঞ্চের উন্মাদনায় জড়িয়ে পড়েন। এই উপলক্ষেই তিনি লেখেন দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক নাটকগুলি। এই সব নাটকগুলির বিপুল জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ তার গান।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান তিনটি ধারায় বিকশিত হয়েছে যথা, প্রেমের গান, স্বদেশী গান ও হাসির গান। এর মধ্যে তার প্রেমের গান সবচেয়ে আন্তরিক সৃজন, স্বদেশী গান সবচেয়ে জনপ্রিয়, হাসির গান সবচেয়ে মৌলিক ও অভিনব। তবে যথার্থ সচেতনতা ও সুর সংরক্ষণের অভাবে তার বেশির ভাগ গানের সুর এখন হারিয়ে গেছে। দ্বিজেন্দ্রগীতির কোন নির্ভরযোগ্য ও সুসম্পাদিত সংকলন নেই।[২]

দ্বিজেন্দ্রলালের অন্তরে ছিল তীব্র স্বদেশাভিমান ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধ স্বভাব। সেই বেদনা থেকে উৎসারিত রচনা ‘হাসির গান’ বঙ্গসংস্কৃতিতে তার সবচেয়ে বড় দান। উচ্চারণের বৈপরীত্যে ও সুরের দেশি-বিদেশি মিশ্রণে সে গান অনবদ্য। হাস্যরসের সঙ্গীত রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল নিজস্ব একটি রীতি সৃষ্টি করেছিলেন।

দেশাত্মবোধক সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রেও তিনি যশস্বী হয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত গান “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা”, “বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ” ইত্যাদি।

তথ্যসূত্র

১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৯।
২. সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা গান, প্যাপিরাস, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা, ১৭১-১৭২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!