ভাদু গান (ইংরেজি: Bhadu Song) মূলত কৃষি উৎসব বা ফসল তোলার উৎসবের (ইংরেজি: Harvest festival) গান। ভাদুকে কেন্দ্র করে যেমন আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, তেমনি আছে গান। ভাদু উৎসবের এই গানগুলি মৌখিক লোকসাহিত্যের আলোচ্য বিষয়।
ভাদু পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তবর্তী বাংলার বিশিষ্ট লোকসঙ্গীতের ধারা। পশ্চিম বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিণ বীরভূম, দক্ষিণ-পূর্ব পুরুলিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ভাদু-উৎসব প্রচলিত। ভাদু পুজো ও গান সমগ্র ভাদ্র মাস জুড়ে চলে। ভাদ্র সংক্রান্তির দিনে ভাদুকে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালিত হয়। কুমারী মেয়েরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। এই অনুষ্ঠনে ভাদুতে ভাদুতে বিয়ে দেওয়া হয়। এই সময় কখনো কখনো সারা রাত ধরে এই গানের লড়াই চলে। গানের মধ্যে তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা অভাব-অনটন, ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট, আশা আকাঙক্ষার কথা প্রকাশিত হয়।
ভাদুকে কেন্দ্র করে নানা কিংবদন্তি রচিত হয়েছে। একটি কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে, পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত কাশীপুরের মহারাজা শ্রীনীলমণি সিংদেও-এর একটি পরমা সুন্দরী কন্যা ছিল। তার নাম ভদ্রেশ্বরী। বিবাহের পূর্বরাত্রিতে তার মৃত্যু হয় অর্থাৎ অবিবাহিতা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। দারুণ মানসিক আঘাত পেয়ে, কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি ভাদ্র মাসে এই উৎসব প্রচলন করেন। এই উৎসবের গানে ভাদুকে প্রথমে মানবীরূপ দেখা হয়েছে
‘আমার ভাদু মুড়ি ভাজে
চুড়ি ঝলমল করে গো…’
মানবী ভাদু, ক্রমশ দেবী ভাদুতে রূপান্তর ঘটেছে। গানে তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়—
ভাদু আজ এলো ঘরে গো
এলো গো শুভদিন।
মোরা সাজি ভর্তি ফুল তুলেছি গো।
যত সব সঙ্গীগণে।
মোরা সারা রাতি করবো পূজা গো
ফুল দিব গো চরণে।
নানা গার্হস্থ্য বিষয়কে অবলম্বন করেও এই ধরনের গান করা হয়। ভাদ্র মাসের প্রথমে পল্লী বাংলার ঘরে ঘরে যে অভাব সে অভাবের সুর শুনতে পাওয়া যায় এই ধরনের গানে। সুর করে মেয়েরা গান ধরে
ও ভাই সকাল থেকে সন্ধ্যা খাটি
খেটে গতর করলাম মাটি ভাইরে
ও ভাই, ঘরে ফিরে শুনিরে ভাই
হাঁড়িতে ভাত নাইরে।
কেমন করে এই ভাদরে বল তবে প্রাণ বাঁচে।
আবার ভাদুকে ঘরে আনার সময় গান গাওয়া হয়।
ভাদু, চল ঘরে
আমরা তোমায় রাখব যতন করে
গান গাহিয়া পূজা তোমায় দিব গো সারাটা রাত্রি ধরে
তোমার ঘুম পায় যদি, ঘুম পাড়াব আমরা গো পাখা করে
সারা বছর তোমার লাগি গো, ছিলাম যে পরাণ ধরে।
আমরা বলব তোমায় মনের কথা, জাগিয়ে রাত্রি ভোরে।
পশ্চিমবঙ্গের এই গানের লড়াইয়ে ক্রমশ তাদের দৈনন্দিন জীবনের অভাব-অভিযোগের কথা উঠে এসেছে
ভাদু মা, গম বিলি করে,
কেন মোরা পাই না রিলিফ,
ভাল লোকের পেট ভরে,
ওগো মা জননী তেলা মাথায় তেল পড়ে।
রিলিফ কেলেঙ্কারি প্রাত্যহিক জীবনের অন্যতম সমস্যা। গানটিতে সেই সমস্যার কথা ব্যক্ত হয়েছে। এভাবেই তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাম্প্রদায়িক সমস্যা, পণপ্রথা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, প্রভৃতি বিষয় ভাদু গানে উঠে এসেছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।