ট্রাজেডি হচ্ছে প্রধান চরিত্রের চরম বিপর্যয়ে পতিত হবার নাটক

ট্রাজেডি বা বিয়োগান্তক নাটক বা বিষাদাত্মক নাটক (ইংরেজি: Tragedy) হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ যখন তার পরিণতিতে প্রধান চরিত্রের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনে তখন সেই নাটককে ট্রাজেডি বলা হয়।[১] প্রাচীন কালের নিয়মে লিখিত ট্র্যাজেডি অন্য সকল প্রকার কাব্যের মধ্যে সবচেয়ে গভীরতাব্যঞ্জক, নীতিমূলক এবং সবচেয়ে সুফলদায়ক বলে গণ্য হয়ে এসেছে। সেহেতু এরিস্টটলের মতে, অনুকম্পা ও ভীতি বা ত্রাসের উদ্রেক করে মনকে ওই সব ও সমজাতীয় আবেগ থেকে মুক্ত করার ক্ষমতা রাখে। অর্থাৎ পাঠ করে বা সুন্দর অভিনয় দেখার ফলে ঐ আবেগগুলি উথলে উঠলে, সেগুলি প্রশমিত করে ও তাকে একটি সুষম মাত্রায় নামিয়ে এনে এক ধরনের আনন্দ দিতে পারে।

শারীরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে; তাই দেখা যায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিষাদ-বায়ু জাতীয় পদার্থ দিয়ে বিষন্নতা রোগ, তিক্ত বস্তু দিয়ে তিক্ততা, এবং লবণ দ্বারা লবণাক্ততা দূর করা হয়। সে জন্য দার্শনিকেরা, ও সিসেরো, প্লুতার্ক ও অন্যান্য গভীর স্বভাবী লেখকেরা প্রায়শঃই ট্র্যাজিক কবিদের রচনার উদ্ধৃতি দিয়ে রচনার সৌকর্যবৃদ্ধি ও বক্তব্যের ব্যাখ্যান, দুই-ই করেছেন। শিষ্যবর পল নিজেও ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে ১ করিনথিয়ান, ১৫.৩৩—এ ইউরিপিডিসের কয়েকটি পংক্তির ব্যবহার অসঙ্গত মনে করেন নি; এবং পারাউস (Parocus) তাঁর রিভিলেশনের টীকায়, পুরো বইটি, ট্র্যাজেডীর কায়দায় বিভিন্ন অংকে ভাগ করেছেন এবং প্রতি অংকের শুরুতে স্বর্গীয় বাদ্যগীতের সন্নিবেশ করে তার অবস্থান দেখিয়েছেন।

এ যাবৎ অনেক সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত ব্যক্তি ট্রাজেডি রচনায় তাদের পারঙ্গমতা প্রমাণ করতে চেষ্টার কসুর করেন নি। এই সম্মানের যোগ্য হওয়ার জন্য ডায়োনিসিয়াস দি এণ্ডার-এর আগ্রহ, ইতিপূর্বে একনায়কত্ব অর্জনের জন্য তার আগ্রহের চেয়ে একটুও কম ছিল না। অ্যাগটাস সীজারও “এজাক্স” লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ঐ শুরু অংশটা তার পছন্দমাফিক না হওয়ায় রচনা অসমাপ্ত রেখে দেন। সেনেকার নামযুক্ত হয়ে যে ট্র্যাজেডীগুলি চালু আছে সেগুলি (নিদেনপক্ষে যেগুলি শ্রেষ্ঠ) অনেকের মতে ঐ নামের দার্শনিকেরই রচনা।

চার্চের একজন যাজক, গ্রেগরী নাজিয়ানজেন (Gregory Nazianzen) “যীশুর যন্ত্রণা” নামে একটি ট্র্যাজেডী রচনা তাঁর নিজের ধার্মিকতার পরিপন্থী বলে মনে করেন নি। এ সবের উল্লেখ করা হলো ট্র্যাজেডীকে যাতে হেয় মনে করা না হয়, বরং তাকে অপবাদের হাত থেকে বাঁচাতে; অন্যান্য বাজার-চলতি যাত্রা তামাশার মতো অনেকেই এখন একে নিন্দনীয় ভাবছেন, কারণ কবিদের ভূলে, ট্র্যাজেডীসম্মত গম্ভীরতা ও গভীরতার সাথে হাসি পরিহাসের মিশ্রণ ঘটেছে, এবং তুচ্ছ ও স্থুলস্বভাবের চরিত্রের আমদানি হয়েছে: বিজ্ঞজনেরা এটা হাস্যকর বলেই জানতেন, এবং এসব করা হয়েছে নিম্নরুচি জনতাকে রুচিহীনভাবে ও কুমতলবে খুশি করার জন্য। এবং যদিও সাবেকী ট্র্যাজেডীতে “প্রস্তাবনা” (প্রলোগ) নেই, কিন্তু কখনো কখনো, আত্মপক্ষ সমর্থনে বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন, যাকে মার্শাল (Martial) এপি বলেছেন, তার ব্যবহার দেখা যায়।

জন মিলটনের লেখা স্যামসন অ্যাগনিসটিজ সাবেকী ধারায় লিখিত, ও হাল আমলের দৃষ্টিতে যা উত্তম, তা থেকে বহুলাংশেই আলাদা জাতের। সেই ট্র্যাজেডীর পক্ষে পূর্বাহ্নেই এটুকু বলা চলে: এখানে কোরাসের অবতারণা হয়েছে গ্রিক নিয়মে। শুধু প্রাচীনকালের গ্রিসে নয়, এ-যুগের গ্রিসে এবং এখনও ইতালীয় সমাজে এই নিয়মই প্রচলিত। এই কাব্যের গঠনে, সঙ্গত কারণেই, পূর্বসূরীদের ও ইতালীয়দের অনুসরণ করেছি, কারণ প্রামাণ্যতা ও প্রসিদ্ধির বিচারে তাদের জায়গা অনেক উঁচুতে। কোরাসে ব্যবহৃত পংক্তির ছন্দমাত্রা নানা রকমের, গ্রিকেরা যাকে বলেছেন মনোস্ট্রাফিক Monostrophic বরং অ্যাপেলেলাইমেনন (Apalelymenon/freed) স্ট্রোফি ও অ্যান্টিস্ট্রোফি বা ইপোড মানা হয় নি, কেবল গান হিসেবে গাওয়ার জন্য যেগুলি ছিল এক ধরনের স্তবক, সেকালে কোরাস যা গাইত; কাব্যের জন্য এটা অপরিহার্য নয়, সুতরাং তেমন দরকারি কিছু নয়; কিংবা স্তবক ও যতিতে বিভক্ত হয়ে তারা “অ্যালাঅ্যাসট্রোফা” (allaestropha) বহুস্তবক নামও নিতে পারে। অংক ও দৃশ্য বিভাগ, যা মঞ্চের প্রয়োজনে করা হয় (এবং যে উদ্দেশ্যে এটা আদৌ রচিত হয় নি), এক্ষেত্রে বর্জিত হয়েছে। যদি পাঁচ অংক অতিক্রম না করে, তাহলেই মনে মিল্টন মনে করেন যে যথেষ্ট হয়েছে।

শব্দরীতি ও চরিত্র-সঙ্গতি বিষয়ে, ও সচরাচর যাকে প্লট (কাহিনী) বলা হয়ে থাকে—জটিল বা সরল যাই হোক—প্রকৃত প্রস্তাবে যা গল্পের বিন্যাসের ব্যাপার, বাস্তবতা ও সুরুচির সঙ্গে যা সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ—এ-সব বিষয়ে তাঁরাই ভালো বুঝবেন যারা এস্কিলাস, সফোক্লিস ও ইউরিপিডিসের রচনার সঙ্গে পরিচিত। এই তিনজনের সমকক্ষ আজ পর্যন্ত কেউ হয় নি, আর যারা ট্রাজেডি লিখবেন, এঁরাই তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ বিধিবিধান। সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত নাটকের সময়সীমা, প্রাচীন রীতির অনুসরণে ও শ্রেষ্ঠ নমুনা মতে, অনধিক চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রাখা হয়েছে।[২]

তথ্যসূত্র

১. কবীর চৌধুরী, সাহিত্যকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১২৫।
২. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, স্যামসন অ্যাগনিসটিজ, বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, মার্চ ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ২৬-২৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!