উন্মাদনামা কবিতাগ্রন্থের পর্যালোচনা

উন্মাদনামা বা আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প বইয়ে কবিতার সংখ্যা খুব কম, মাত্র সতেরটি। এই অল্প সংখক কবিতার মধ্যে কবি চেয়েছেন বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু দিতে। এক নতুন চিন্তার প্রবাহ আনতে। কবিতাগুলো কিছুটা গদ্যের মতো করে লেখা কিন্তু গদ্য নয়। কবিতার ছন্দের বাঁধা ধরা শিকলকে ছিঁড়ে এক নতুন রূপ তুলে ধরেছেন কবি। কবিতা লেখার প্রচলিত ঢংকে বাদ দিয়ে এই বইয়ের লেখাগুলোতে কবি যে নতুনত্ব এনেছেন তা বর্তমান সময়ের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপুর্ণ।   

উন্মাদনামা কবিতাগ্রন্থের কবিতাগুলোতে অনুপ সাদি মূলত ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরে পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র ফুটে তুলেছেন। এছাড়া সেইসব মুখের চিত্র এঁকেছেন যারা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের শ্রম শোষণ করে নায়ক সেজে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে কবিতার বিভিন্ন পংক্তিতে। মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে শ্রমিকশ্রেণির ভেতর দেশভাগের যে বীজ ছিটিয়ে দিয়েছিল ক্ষমতাসীনরা তাদের রূপ তুলে ধরতে কবি কার্পণ্য করেন নি। এই দেশভাগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ জনগন। কিন্তু গদিতে বসে সিদ্ধান্ত হয়ে যায় দেশ ভাগের; ঠিক যেনও পৈতৃক সম্পত্তির মতো। কোনো যুদ্ধ ছাড়াই একটি দেশ দুই ভাগ হয়ে গেলো আর রেখে গিয়েছে বিশাল ক্ষয়-ক্ষতি, মৃত্যু, রক্তপাতের চিহ্ন। দেশভাগে যেহেতু যুদ্ধ ছিলো না তাই কোনো জয়-পরাজয়ের বিষয়ই ছিলও না। “উন্মাদনামা”র বা ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’ কবিতাগুলোতে আছে সেই দেশবিভাগের রক্তাক্ত দাঙ্গার ইতিহাস ক্ষত-বিক্ষত চিত্র।  

এরপরে হলো সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ; এতে করে কি সেই খেটে খাওয়া মানুষের শান্তি হয়েছে? একটি নতুন দেশ হওয়া মানে ধনী দেশগুলোর পণ্যের জন্য বাজার তৈরি। নতুন দেশটিতে বাজার দখল করে নেওয়ার এক সুবর্ন সুযোগ ঘটে।  ধনী দেশগুলো থেকে আসে নানাধরনের বিদেশি আয়েশি পণ্য। আরও আসে দেশ পরিচালনার জন্য অভিনব আইনে; আইন প্রয়োগের জন্য অত্যাধুনিক পদ্ধতি; নতুন আইন প্রয়োগে সৃষ্ট সন্ত্রাস; আর সন্ত্রাস ঠেকানোর নামে রপ্তানি করা হয় অস্ত্র। সেই সাথে এই সমাজে বসবাসরত মানুষের দেহ হয়ে যায় একটি জ্যান্ত সম্পদ।

প্রথম কবিতায় এক উন্মাদের বলছে জীবনের গল্প। আসলে এমন উন্মাদরা ইতিহাস বহন করে আনে। সাধারণ মানুষের সামনে তাঁরা কাগজহীন চলমান এক ইতিহাসের বই। তাদের কথায় উঠে আসে দেশের ইতিহাস; এক সময়কার জমানো জ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সম্পদ কীভাবে সময়ের সাথে বিলীন হয়ে যায়।

বাইরের পুঁজি এসে দেশের বাজারকে ধ্বংস করে, আমাদের দেশীয় পণ্যকে মলিন করে তোলে। কুঁড়ে ঘরে বাস করা মানুষগুলো ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন বুনন করে। মিথ্যা আশ্বাসে মোহিত হয়ে তারা সস্থা শ্রমিকে পরিণত হয়। সমাজ থেকে ছিটকে পড়া এই সব শ্রমিকের ঘামের দাম নেই বর্তমান শাসন ব্যবস্থায়। কিন্তু অভিনব পদ্ধতিতে তাদেরকে আশার মূলা দেখিয়ে নিয়ে যায় সর্বস্ব। চোখ ধাঁধানো ঝিলিক বাতির আলোতে শোষণ, অন্যায়, অবিচারকে ঝকঝকে পালিশ করা জুতার মতো লাগে। “উন্মাদনামা বা মানুষের ধারাবাহিক গল্প” এই কবিতাটি একটি গীতি কবিতার মতো করে লেখা যার মাধ্যমে ইতিহাস আমাদের সামনে উঠে এসেছে।

সভ্যতা নির্মাণে শ্রমিকে অবদান সবার উপরে। সেই অবদানকে অস্বীকার করে শ্রমিকের বুকে পুঁজির অট্টালিকা গড়ে তোলে ধনকুবেররা। এই কবিতাগ্রন্থে কবি শ্রমিকের জীবনের বাস্তব ছবি তুলে ধরেছেন। শ্রমিকের উপর সবসময় কবির আস্থা ছিলও। শ্রমিক যেমন একটি দেশকে গড়তে পারে, তাঁরাই ইতিহাস রচনা করে। শোষকের যাঁতাকলে পিষ্ট হলেও কখন আশা ছাড়ে না, তাঁদেরই ঐক্য গড়ে তুলতে পারে বিপ্লব।

সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ জানেনা লড়ায়টার শেষ কোথায় হবে। একসময় তাঁরা ভাবত লড়তে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। কিন্তু বর্তমানে দাঁড়িয়ে যে লড়ায় হচ্ছে তা যখন অতীত হয়ে যায়, তখন নিজেদের লড়ায়ের ফলাফল দেখে উল্টো। যেটার প্রত্যাশা ছিলো তা ঘটে না। কিন্তু এই ইতিহাসকে ইনিয়ে বিনিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে মিথ্যা সাফল্যের কথা লিখে পাতা পরে পাত বোঝায় করা হওয়। লড়ায়ের ইতিহাস একমাত্র লিখতে জানে শ্রমিকেরা তা অনেকেই ভুলে যায়।

বাংলা ভাগের ফলে শ্রমিকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় নি উল্টো ঘটেছে পুঁজির রমরমা বাজার। সেই বাজারে শ্রমিক আবার দাসে পরিণত হয়েছে আর চিন্তা, সৃজনশীলতা, সংগ্রাম, বীরত্বের চেয়ে মূল্যবান হয়েছে ব্যক্তির দেহ। দুই বাংলা থেকে স্বাধীন বাংলার জন্য যারা লড়ায় করেছিলো তাঁদের সংগ্রামের ফসল চলে যায় দালাল, স্বৈরশাসকের দখলে; পোকা খাওয়া বেগুনের মতো গণতন্ত্রের পেটে। সেই সাথে শ্রমিক আবার নতুন করে লড়ায় শুরু করে জীবনের নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে।

শ্রমিকের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা নেওয়ার জন্য কবির জয়গান আছে কবিতাগুলোতে। তেমনই একটি কবিতা ‘কিছু রক্তই সবকিছু’ যেখানে শ্রমিকেরা যেনও নানা রং নিয়ে জেগে উঠে রংধনু হয়ে সেই কথা আছে। সভ্যতা নির্মানের প্রধান কারিগর শ্রমিক; নিজেদের জীবনকে টিকিয়ে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করে তাদের নিয়ে এক কবিতা ‘শ্রমিকের বেদনা গীত’। এই কবিতায় কবি দেখিয়েছেন শ্রমিকের চোখেই বিপ্লবের আগুন জ্বলবে।        

একটি কথাই শোনা যায়
আমরা আসছি, সমস্ত রাষ্ট্রীয় মরচে ছুটিয়ে
আমরা রক্ষা করবো আমার শ্রমিক আমার কৃষক,
বাঁচাবো আমার সোঁদা মাটি গন্ধ,
তুমিই আমাদের প্রথম ঝলকিত প্রেমের গন্তব্য,
আমরা পৌঁছাবোই তোমার মুক্তির বন্দরে।

লেনিন ‘নারী-শ্রমিকদের নিকট’ ছোট একটি প্রবন্ধে বলেছেন “নারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা না করে প্রলেতারিয়েত কখনো নিজেদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না”। সেই দর্শণের আলোকেই কবি একটি কবিতা লিখেছে ‘নেতা বনাম ভাতার’। তবে এখানে ব্যঙ্গ করা হয়েছে বর্তমান পুঁজিবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবাহের ফল একটি দেশে কি পরিবর্তন আনে তার রূপ ফুটে উঠেছে কবিতায়। শাসক গোষ্ঠীর অন্যায় ব্যবস্থায় মানুষকে সুস্থ চিন্তা করতে বাঁধা দেয়। তার ফল দেখা যায় পুঁজিবাদী সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে। একদিকে অভিজাত শ্রেণির বিলাসিতা অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বিরাজ করে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মনমালিন্য। নারী জীবনের মূল্যকে নিয়ে যায় লড়ায়ের পথ থেকে স্বামী বা পুরুষের যৌন তৃপ্তির সঙ্গী রূপে। যদিও খালি চোখে দেখা যায় নারীরা স্বাধীন কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে বুঝা যাবে এই স্বাধীনতা দিয়েছে পুঁজিবাদ তার নিজের প্রয়োজনে। নিজের স্বাধীন পেশা নির্বাচন করতে, নিজের মতো জীবনধারন করতে, চলাফেরা করতে কিন্তু চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে পুরুষের ঘরে।

এই পুঁজিবাদ যেমন একদিকে তৈরি করেছে কর্মী তেমনি অন্যদিকে তৈরি করছে মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্তের জীবনকে নানাভাবে ব্যঙ্গ করে তুলে ধরেছেন কবি। মধ্যবিত্তরা শিক্ষিত হয়ে চাকরি করে নিজের জীবনকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। বিজ্ঞাপনের মতো দেহ ও জীবনকে আবেদনময়ী করে তুলে। ‘দখল, ঘরে বাইরে বা যৌনতাই মুক্তি’ এই কবিতায় এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে যা স্বাভাবিক ও খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের কোনো অংশের সাথে মিলে না কিন্তু সেই সব বিকৃত চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে।

দেশের বাজারে বিদেশি পণ্যে অবাধে বেচাকেনা চলছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে আসে অস্ত্র। অন্যদিকে দেশের খনিজ সম্পদ লুঠ করার জন্য বিদেশি সাহায্য, নানা সংস্থার হাজির ঘটে। ব্যাঙ্গ করে হলেও এই দেশের গণশত্রুদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘আমরা গণশত্রু খুজচ্ছি’ কবিতায়।

শ্রমিক ভাত খেতে পায় কি না সেটা দেখার বিষয় না শুধু চাই ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচন। ভেল্কি লাগানো কথা বলে পরাজিত জীবন থেকে নতুন পরাজিত জীবনে প্রবেশের একটি টিকেট কেনে সাধারণ মানুষ এই নির্বাচনে। দেশের রাজনীতির এক পরিবর্তনের চিত্র দেখা যায় ‘দল ও পরাধীনতার ধারাবাহিকতা’ কবিতায়। এখানে দেখা যায় দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশ, দেশের জনগণের জন্য যারা চিন্তা করে তাদের। একপক্ষ সাদা কালো, কোন্দল নিয়ে লড়ে যাচ্ছে আর অন্যপক্ষ হয়ে পড়ছে ধান্ধাল, সুবিধাবাদী। এই সুযোগে ঘটছে দেশের বাজারে বিদেশি পণ্যে অবাধে বেচাকেনা। তবে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাচ্ছে কিন্তু সেটা মরীচিকার মতো এক প্রতারণা। রাজনীতি নামে আসলে দলগুলো ব্যবসার জন্য একেকটা হ্যাচারি খুলে বসে।

খবর শুনছেন- আধুনিক রাজনীতি প্যাকেজ প্রোগাম;_ 
আমরা চাই বা নাচাই
কিছু একটা ঘটে গেলো গোটা মহাদেশেলাল ঠেকানোর সতর্কতা……………….  

আরো পড়ুন

‘মাওবাদ ও জনগনের আমরা’ এই কবিতায় এক মহান বীরের কথা বলা হয়েছে যিনি সাম্যের ফুল ফোটানোর জন্য ৬০ কোটি মানুষকে এক করেছিলেন। কিন্তু সেই ফুলকে অনেকে বিকৃত করে নানা প্রচার চালিয়েছে। কিন্তু যে যাই বলুক না কেনও সেই মহা বীর মাও সেতুং যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন তা সারা বিশ্বে এক মুক্তির সংবাদ ছিলও।

মাও সেতুংয়ের একটি প্রবন্ধে  প্রাচীন চীনের এক গল্পের কথা আছে যেখানে এক বুড়ো পাহাড় কাটছিল। প্রতিবেশীরা প্রথমে হাসাহাসি করছিলো তখন বুড়ো বলেছিল এই পাহাড় আমি কেটে শেষ করতে না পারলে আমার ছেলে করবে তারা না পারলে তার ছেলেরা করবে। তার পরেরদিন দেখা গেলও পাহাড়টি আর নেই। গল্পে যদিও দেখানো হয়েছিলো পাহাড়টি অলৌকিকভাবে সরে গিয়েছি কিন্তু বাস্তবটা ছিলও গ্রামবাসীর এক্ত্রে প্রচেষ্ঠার ফলে সেটা ঘটেছে। তেমনি এই কবিতাগুলোর মাধ্যমে কবি প্রকাশ করেছেন সাম্যের রাষ্ট্রের কথা। যেটার জন্য এক ঐক্য প্রচেষ্টা দরকার।              

মানুষ তার দর্শনকে লুকাতে পারেন না; ব্যক্তির কর্মের মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটবেই। উন্মাদনামা কবিতাগ্রন্থে কবির দার্শনিক চিন্তা ফুটে উঠেছে। এক সাম্যের পৃথিবী গড়ার ডাক দিয়েছেন কবি তার কবিতার মধ্যে দিয়ে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!