“স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” কাব্যগ্রন্থের আলোচনা

ইব্রাহিম খলিল সরকার

কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

কবি দোলন প্রভা রচিত ‘স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে ‘ চৌষট্টি পৃষ্ঠার একটি কবিতার বই। ভ্যান গগের চিত্র অবলম্বনে প্রচ্ছদ এঁকেছেন মো. আবদুল ওদুদ। ছাপ্পান্নটি কবিতা আছে  বইটিতে।

বইটিকে আঁধারে পথচলা বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের একটা স্বপ্নময় আলোর দীপালি বললে ভুল হবেনা। জানি, একমাত্র কবিই পারেন তাঁর সৃজিত কবিতার রহস্য ভেদ করতে। পাঠক হিসেবে সে কাজ ধৃষ্টতার শামিল। বিশ্লেষণে পাঠকের চিন্তা ও বোধের ছাপ পড়াটা বিচিত্র নয়। তবুও নিজেকে সংযত রেখে বস্তুনিষ্ঠভাবে কাব্যে বিধৃত কবিতার ভাব উদ্ধারের চেষ্টা করেছি।

রাজনৈতিক অস্থিরতায় পৃথিবী আজ নিকষ আঁধারে নিমজ্জিত। এই আঁধারের মাঝেও আশাবিন্দু খুঁজে মরেন কবি। ‘নাগমতির সুরে’ কবিতায় কবির সে আশার প্রকাশ দেখি এভাবে- অন্ধকার গ্রহে ধীরে ধীরে আশার বিন্দু হয়ে জেগে ওঠে/ তৃণ জড়ানো আধো বালুময় নতুন চর নাগমতি নদীর বুকে।

কবি স্বাধীনতার পূজারি। স্বাধীন পথচলাতেই তাঁর আনন্দ। শৃঙ্খলকে দু’পায়ে দলে তাই তিনি ‘আগমনীর পত্র’ কবিতায় বলে ওঠেন- সারাদিন নেচে নেচে যে ফড়িং ফিরে যায় নীড়ে;/ আমার মন নাচে তারই হাতে হাত ধরে ধরে।

গ্রামকে শহর বানাবার অপচেষ্টায় তৎপর আজকের সভ্যতা। এ ধারায় ভেসে গেছে কবির সহজ সরল গরীব জন্মভূমি। শেষরক্ষা হবে কি? নাহ! কবির বুকে এখন শুধুই স্মৃতি। ‘স্মৃতিচারণ’ কবিতায় তাই তিনি প্রকাশ করেন- জগতের যে চমৎকার গাছটি ছিলো তোমার বুকে,/ সে এখনও হাতছানি দিয়ে ইশারায় ডাকে।

‘ভোরের ডাক’ কবিতায় কবি নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেন। কবিতার গভীরে উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠে তিনি বলেন- জন্ম দিতে হবে তাই, রেশমে মোড়া লাল টকটকে দিন।

কবি পুরনোর সাথে নিজেকে বেঁধে রাখতে চান না মোটেই। নতুনের পূবাল হাওয়ায় তিনি শিহরিত। পুরোনো ভুলে তাই তিনি দুলে ওঠেন নতুন স্রোতে। তবুও ‘অপরাজিতা’ কবিতায় কবির প্রকাশ দেখি ভিন্নরূপে- আমার পুরনো মন হারিয়ে যায় চাঁদের সুরে সুরে পাহাড়ের নীলে।

আঁধারের পথ পাড়ি দিয়ে যারা ভোরের সূর্য আনে, মহাকালের ঠিক গহীনে তারা হয়ে ওঠে ইতিহাস। কবির ‘চারণ ভূমি’ কবিতায় সে কথাই মূর্ত হয়ে উঠেছে- মহাকাল তাদের ইতিহাস রচনা করবে সেই আলোতেই।

যুগে যুগে শ্রমিকের হাতেই নির্মাণ ঘটে সভ্যতার। অথচ কালেকালে জীবনের মাপকাঠিতে শ্রমিকের জীবন বড়ই তুচ্ছ। সে কথা কত সহজেই সাধারণ উপমায় কবি ফুটে তুলেছেন তাঁর ‘সভ্যতা’ কবিতায়- সভ্যতার এ পর্বে জীবনকে মাপা হয়/ বাজারের সবজি আর পরিত্যক্ত কৌটার মতো।

কবি রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। প্রেম আর হৃদয়ের কোমলতা তাঁকে আচ্ছন্ন করতেই পারে। কিন্তু কালের ব্যবধানে চিন্তার ফারাকে পুরাতনকে ভুলে কবি সৃজন ঘটান দিন বদলের গান। ‘তবু এগিয়ে চলা’ কবিতায় সে গানের সুর অনুরণিত হয় এভাবে- তাই আমার চেতনায় জেগে উঠছে অনন্য ফুলেরা।

‘নিরালা দুপুর’ কবিতায় কবির আশাবাদী মন স্বপ্ন দেখে পূর্ণতা আর সজীবতার। একদিন এদেশের মাটিতে সাড়া জাগবে অবহেলিত অপূর্ণদের কোলাহলে। কবি বলেন- আমাদের স্বপ্নগুলো খাঁচাহীন পাখি হয়ে উড়বে আকাশে।

পিছুটান সামনের পথচলায় আনে স্তব্ধতা। সে টানের শিকল ছিঁড়ে যারা ছুটে চলে দূর বহুদূর, তাদের জন্যই কবির কবিতা ‘ভিন্ন কিছু’। এখানে কবি ঝামেলার জঞ্জাল পুড়িয়ে ছুটতে চান সমতালে। যেমন- আমিও তোমার সাথে হাঁটতে চাই দীর্ঘপথ ধরে,/ ঝামেলাগুলোকে পোড়াতে চাই আগুন হয়ে।

কবি চান সমাজ সভ্যতার আমূল পরিবর্তন। পরিবর্তনের এ উপমায় দৈনন্দিন বৈষয়িক কর্ম ক্লান্তির অবসান ঘটিয়ে মানবীয় ভাবাবেগে অনাবিল স্নিগ্ধতার মধ্য দিয়ে কবি গড়তে চান এক প্রাণবন্ত সভ্যতা। ‘দিগন্ত’ কবিতায় তিনি বলেন- গড়তে চায় এক প্রাণবন্ত সভ্যতা/ তাই আজ সান দিচ্ছি নিজেদের কাস্তেতে।

হতাশা ভুলে জেগে উঠুক বাংলাদেশ। এ প্রত্যাশা কবির। বৈশাখী ঝড়ো হাওয়ার উদ্দামতা নিয়ে জেগে ওঠা নেতৃত্ব আজ খুব দরকার। ‘শ্রমপাড়া জেগে ওঠো’ কবিতায় তাই তিনি বলে ওঠেন- ম্লান দৃষ্টিতে তাকাবার সময় নেই আর,/বৈশাখী ঝড়ের মত উদ্দামতা নিয়ে;/ জেগে ওঠো।

মাত্র অল্প ক’টি শব্দের বুননে রচিত ‘সম্পর্ক’ কবিতাটি কবির এক ভিন্নরকম সৃষ্টি। এখানে মানবীয় সম্পর্কের এক চিরন্তন রূপ উন্মোচিত হয়েছে। মানবীয় এ সম্পর্কে বিদ্যমান অদৃশ্য শক্তির ইতিবাচক ক্রিয়া যেমন মানুষকে সৃষ্টির উল্লাসে জাগায়, তেমনি নেতিবাচক ক্রিয়া তলিয়ে দিতে পারে ধ্বংসের অথৈ গহ্বরে। কবির কথায়- সম্পর্ক নিয়ে যেতে পারে আকাশ ছোঁয়া হিমালয়ে/ বা ছোটাতে পারে মরুভূমির বুকে মরীচিকায়।

স্মৃতির শক্তিতে বলিয়ান হতে চান কবি। তাইতো ‘তোমার স্মৃতিতে জেগে ওঠে শক্তি’ কবিতায় কবি স্বপ্নদ্রষ্টাদের নিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করেছেন- দুই হাতে লাল পতাকা, বুকে ঝড়ের স্বপ্ন।

‘অনুভূতি’ কবিতায় কবির মতে, সমাজ ভাঙার ঢেউ অনুভূতির বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে আকুতি জানায়- কতকিছু বদলে যায় নতুন পণ্য পেলে,/ তোমরা একটু বদলাও ঠেকে ঠেকে।

একটা দেশ বা সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য মূলতঃ শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা জীবন্ত ক্যানভাস। শিল্পীর তুলি আজ নিস্তেজ নিষ্প্রাণ। তাকে জাগিয়ে তুলতেই ‘হারানো শিল্পী’ কবিতায় তিনি লেখেন- হারিয়ে যাওয়া সব নাইবা আসুক,/ শুধু যেন আসে সেই রং তুলি/ যার স্পর্শে নিভন্ত প্রদীপ জ্বলে ওঠে।

জীবন ছুটবে প্রকৃতি ও জনারণ্যের পথে পথে। উপভোগ করতে হবে জীবনের তলানি অবধি। ‘তুমি মৃত্যু জেনেও’ কবিতায় তাই তিনি একাকীত্বের নীরস জীবন থেকে তাঁর প্রেমিককে ডাকেন- নীরস জীবন থেকে আড়মোড়া ভেঙে এসো।

বাইরের প্রকৃতির উপমায় কত অবলীলায় কবি রাতের মানবীয় প্রকৃতিকে নিখুঁতভাবে গেঁথেছেন তার ‘গাঁথুনি’ কবিতায়! কবির ভাষায়- গভীর রাতের পেটে যে কলি যুদ্ধ করে/ তার চোখে স্বপ্ন আছে গোপন প্রেমের/ সেও একদিন ফুল হয়ে সুবাসে ভাসাবে।

কাব্যের নামকরণের সার্থকতা লুকিয়ে আছে তাঁর ‘বিভাজন’ কবিতায়। শ্রমেগড়ে সভ্যতার বাঁকে বাঁকে বিক্ষিপ্তভাবে নির্যাতিত শ্রমিকদের এক স্বপ্নীল উপত্যাকা সৃষ্টির স্বপ্ন দেখেন তিনি। কবির ভাষায়- এই যুগে আমি দেখতে চাই স্বপ্ন/ আমার শ্রমে গড়া সবার আবাসভূমি/ তাই খেটে চলি যৌথ খামার দেখব বলে।

দেশ ও জাতির সীমানা পেরিয়ে কবি ছুটতে চান বিশ্ব বন্ধনের প্রত্যাশায়। বুঁদ হয়ে অপেক্ষা করেন ‘অপেক্ষা’ কবিতায়। ভাবেন, একদিন ব্যক্তিক পথচলা ভুলে সৃজন ঘটবে যৌথ কাফেলার। কবি বলেন- সশব্দ পদচারণা নিয়ে আমি থেকে আমরা অপেক্ষমান।

‘তামাটে মুখ’ কবিতায় কবি তাঁর মানসপটে ছবি আঁকেন শ্রম কিংবা শ্রমিকের। অলস কোমল দেহাবরণ ভুলে রোদে পোড়া তামাটে মুখশ্রী আর শ্রম ক্লিষ্ট কঠিন বাহুতেই কবির ভালোবাসা উপচে ওঠে। তাই তিনি বলেন- তার প্রখর রোদে পোড়া চকচকে পেশি ছিলো/ চার হাত পা ছিলো সভ্যতা নির্মাণের হাতিয়ার।

নিছক প্রেমের বর্ণনা নয়, কবিতায় থাকবে শিকল ভাঙার গান। ‘কবিতা জানাতে চায়’ কবিতায় তাই তো কবি গেয়ে ওঠেন- একটি কবিতা জানাতে চায় কৃষকের ন্যায্য পাওনার ভাষা।

কবিতা স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন ভোলা সারথিকে স্বপ্নের স্রোতে ভাসাতে কবির কতই না আকুতি। গ্রামীণ আবহে জড়ানো বিচিত্র উপমার প্রলোভনে ভরা তাঁর কবিতা ‘ব্রহ্মশৈলী’। যেমন- জগতের স্বাভাবিক সব সুর সঁপে দেব তোর অঙ্গে/ যদি চাস নির্মল ধ্বনি।

পুঁজিবাদী সমাজের জগদ্দল পাথরে পিষ্ট প্রেমিক হৃদয়ের সুপ্ত বীজগুলো আঁধারেই গুমরে মরে এদেশে। তবুও, একদিন পরিবেশের আনুকুল্যে সে স্বপ্নবীজ অঙ্কুরিত হবেই। হয়তো তারই ইঙ্গিত রয়েছে ‘স্বপ্নবাজ বীর’ কবিতায়। যদিও তারা জুজুর ভয়ে আড়ষ্ট এখনও। কবির উচ্চারণ- এখানে জুজুর ভয়ে মাথা নত করে প্রেমিকেরা।

‘আলোর কাছাকাছি’ কবিতায় একটা আলোকোজ্জ্বল দিনের স্বপ্ন দেখেন কবি। সূর্যসম বিপ্লবের অপেক্ষা মাত্র। সবাই যে যার প্রস্তুতির খেলায় মত্ত। আলো আসবেই। কবির ভাবনায়- সেখানেও চাষ হবে বলে কচি পোকারব্যস্ততা চলে।

‘ফুলবাড়ির ফুলগুলো’ কবির এক অনবদ্য সৃষ্টি। এ কবিতায় দেশের সম্পদ রক্ষা আন্দোলনে ভূলুণ্ঠিত শ্রমিকফুলের পাপড়ি উন্মোচন করেছেন নিবিড় মমতায়। কবিতার শুরুটাই যার এ রকম- জানিনা আজ ফুলবাড়ির ফুলগুলো কেমন আছে?

এক ঋতু হতে আরেক ঋতু অবধি ফসলী সেতুবন্ধন সৃষ্টিতে ব্যর্থ ঋণগ্রস্ত কঙ্কালসার বাঙালি কৃষকের চিত্র এঁকেছেন কবি ‘আশা’ কবিতায়। কৃষক কূলের এই ব্যর্থতা ঘুঁচাতে তিনি আশা করেন- এবার একটু সুখে বৃষ্টি নামুক মাটির বুকে।

ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের পুঁজিবাদী যৌনতায় দেশব্যাপী যে ক্ষয় ও ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন, কবির লেখা ‘একটি মৃত্যু’ কবিতা তার নিটোল প্রতিচ্ছবি। কবিতার কথা- ওরা যখন তৃপ্তি মিটিয়ে চলে গিয়েছিল/ তখন তার নিথর দেহ অপেক্ষা করেছিলো/ একটি ভোরের জন্য।

‘ব্যক্তিগত ভাবনা’ কবিতায় কবি মনের একান্ত অভিব্যক্তির স্বরূপ ফুটে উঠেছে। কিন্তু পাঠক যখন কবিতার সাথে একাকার হয়ে যায়, তখন সে ভাবনা হয়ে ওঠে সবার। সামর্থ্য না থাকার চেয়েও বড় কথা, কবি তাঁর মনের মানুষকে যা দিতে চান, তা একেবারে হৃদয় হতে আহরিত স্নিগ্ধতার পরশ। যেমন- তোমাকে দেবার মতো কিছুই নেই কবিতা ছাড়া।

‘রেখা’ কবিতায় কবি অমনোযোগের রুদ্র ভয়াল রূপ দেখাবার চেষ্টা করেছেন। যে রূপের শীতল ছোঁয়ায় জীবন হয়ে ওঠে শৃঙ্খলাহীন। আসে মরুশুন্যতার মতো মরণও। বেশ দ্বিধাহীনভাবে কবি তাই লিখলেন- অমনোযোগে মরুর মতো শূন্যতা/ হৃদয়ে এসে জমা হয়,/ যাকে বলি আমরা ‘মরণ’।

পরিশেষে বলতে চাই, সমাজ বদলাবার জন্য পথে নামবার বিকল্প নেই এবং ছিলোনা কোনকালেই। ইতিহাস সাক্ষী। তবুও কবিতা তার আপন বৈশিষ্ট্যে চির ভাস্বর। কারণ, পথে নামবার প্রেরণা আসে কবিতা থেকেই। যে কবি তাঁর কবিতা দিয়ে এ কাজটি করতে পারেন, সে কবি সার্থক। এ মাপকাঠিতে শিল্প সাহিত্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্রের লীলা ভূমিতে জন্ম নে’য়া দোলন প্রভা একজন সফল কবি এবং তাঁর রচিত কবিতার বই ‘স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে’ বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি।

1 thought on ““স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” কাব্যগ্রন্থের আলোচনা”

Leave a Comment

error: Content is protected !!