দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিলো মানব ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ। যুদ্ধের স্থায়ীত্ব ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার আগে থেকেই নাৎসি বাহিনীর সাথে সোভিয়েত বাহিনীর সম্পর্ক ভালো বা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার জন্য জার্মান বাহিনী একটি অভিযান চালায়। এই অভিযান নাম ছিলো “অপারেশন বার্বারোসা”। এই অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিলো ১৯৪১ এর ভেতর রাশিয়ার বিশাল উর্বর ভূমি এবং শিল্পাঞ্চলসমূহের দখল করে নেওয়া; এছাড়াও কমিউনিজমের বিনাশ করা এবং জার্মানির পরবর্তী শত্রুদের বিপরীতে যুদ্ধ পরিচালনার পর্যাপ্ত রসদ যোগানো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি দীর্ঘদিন রাশিয়া অবরোধ করে রাখে। ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মান বাহিনী অভিযান শুরু করে। তবে রাশিয়া আগেই বুঝতে পেরেছিলো; সেজন্য নিজ বাহিনী প্রস্তুত ছিলো। তানিয়া গল্পের কাহিনী শুরু হয় ১৯৪১ সাল থেকেই। তানিয়া দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার জন্মভূমি রাশিয়াকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করতে গিয়েছে; তারপরে জার্মান সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে। তার উপর তানিয়ার চলে বর্বর নির্যাতন। কিন্তু জার্মান বাহিনী তার মুখ থেকে নিজের দল সম্পর্কে কোন তথ্য আদায় করতে পারেনি। তানিয়ার সাহসিকতার কাছে জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়ে। শীতের রাতে উলঙ্গ করে অত্যাচার চালানো হয় অল্প বয়স্ক মেয়েটির উপর। বরফের উপর দিয়ে নগ্ন পায়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তৃষ্ণার্ত তানিয়া পানি খেতে চাইলে এক জার্মান সৈনিক কেরসিন খাওয়ার জন্য হ্যারিকেন এগিয়ে দেয়। আঘাতে নীল হয়ে থাকা ক্ষত শরীরটি যখন ক্লান্ত হয়ে পরে তারপরও নিস্তার পায় না নির্যাতন থেকে।
পরদিন প্রভাতে জনসম্মুখে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। তানিয়া জার্মানদের কাছে যে দেশপ্রেম, বীরত্ব দেখিয়েছে তা রাশিয়ানরা মনে রাখে; এবং তানিয়াকে বীর হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। অপরদিকে জার্মানদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তোলা হয় কাপুরুষতার প্রতীক হিসাবে। ফাঁসি দেওয়ার পরে কয়েক দিন ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হয়। তারপরে লাশের উপর নানা নির্যাতন চালানো হয়। এরপরে কেটে টুকরো করে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ; সেটা অনেকেই জানে বা বলে। গল্পের তানিয়াও ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। তাই আজ তাকে আমরা বিপ্লবী হিসাবে জানতে পাচ্ছি। লেখক পি. লিডভ তার এই গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাশিয়ান বাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ। এছাড়াও সেসময়ের রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক অবস্থাও উঠে এসেছে এই গল্পে। বইটিতে তানিয়ার মায়ের জবানীতে আছে —
‘বিপ্লবের পরে গ্রামখানিতে অনেক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটলো। স্কুলের সংখ্যা দুটির স্থলে দশটিতে দাঁড়ালো। জোয়ান অগ্রগামীরা লাল নিশান উড়িয়ে উইলো গাছের তলা দিয়ে প্যারেড করতে শুরু করলো। তরুণ সাম্যবাদী লীগ প্রতিসন্ধ্যায় সখের থিয়েটার, সাহিত্য এবং সঙ্গীতের আয়োজন করতে লাগলো। ভ্রাম্যমান ক্যামেরার সাহায্য প্রায়ই সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হতে লাগলো। শিক্ষকেরা, ডাক্তারেরা এবং খামারের বিশেষজ্ঞরা বক্তৃতা দিতে লাগলেন। পিপলস হাউজ এবং গ্রন্থাগারগুলোতে সবসময় মানুষে ভর্তি থাকতো।’
গ্রামের উন্নতি ক্রমেই যখন বেড়ে চলছিলো ঠিক তেমন সুন্দর পরিবেশে ১৯২৩ সালে জন্ম হয় জয়া অর্থাৎ তানিয়ার। জন্মের পরে থেকেই জয়া তার জন্মভূমির তৈরি হওয়া পরিবেশ দেখতে থাকে। ছোটবেলা থেকেই সেনাবাহিনীর প্যারেড, জাতীয় সঙ্গীত, যৌথ খামার, বই পড়া ইত্যাদি ভালো লাগতো। ছোট থেকেই সে দেশে সেবা করার জন্য মনঃস্থির করে। তাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়। রাশিয়াকে শত্রু থেকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবন বাজী রাখে। ১৯৪১ সালে ২১ জুন বুঝতে পারে স্বদেশ হুমকিতে আছে। তাই আর সেনাবাহিনীতে ট্রেনিং নিতে থাকে।
একজন যোদ্ধার জীবন বেছে নিতে যে সাহস লাগে সেটা একদিনে হয় না। একটু একটু করে দীর্ঘদিন থেকে নিজেকে তৈরি করতে হয়। ছোটবেলা থেকে তার মাঝে এমন কিছু গুণ বা অভ্যাস ছিলো যা তাকে বিপ্লবী হওয়ার দিকে তাড়িত করেছে। জয়া চরিত্রটি দ্বারা লেখক সোভিয়েত বিপ্লবীদের নৈতিক দৃঢ়তাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার সময় তার মাকে বলে গিয়েছিলো- ‘মা মনি তুমি কেঁদোনা, আমি বীরাঙ্গনার মতো ফিরে আসবো অথবা মৃত্যু বরণ করবো’।
শরীর ও মনের যতটা তেজ থাকলে শত্রু পক্ষ নিজেদের সর্বনাশ বুঝতে পারে সেটার প্রতীক ছিলো তানিয়া। সেই যুদ্ধের সময় অনেক সাধারণ নারী-পুরুষ ছিলো যারা নিজেদের সুখ ও আরামের জন্য দিন গুন ছিলও। চাইলে তানিয়া/ জয়াও তেমন সুখী জীবন বেছে নিতে পারত কিন্তু না, যোদ্ধা হিসাবে তৈরি করে স্বদেশের বিপদে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আর ইতিহাস বীরদের নাম সবসময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
তানিয়া
মূল:পি.লিডভ
অনুবাদ:আহমদ ছফা
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।