মহাকবি পাবলো নেরুদার (১২ জুলাই, ১৯০৪ – ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩) কবিতা যেসব বিষয়ে (ইংরেজি: The subject matter of Neruda’s poetry) রচিত সেগুলো হচ্ছে প্রেম, প্রকৃতি, রাজনীতি, স্পেন এবং অবশ্যই শ্রমিক ও কৃষক। তিনি রাজনীতি করেছেন, মুক্তির লড়াইয়ে ছিলেন, মানুষের মাঝখানে, শ্রমিকের বস্তিতে, কলে কারখানায় কবিতা আবৃত্তি করে বেড়িয়েছেন। জনগণের অগ্রগামি অংশকে সচেতন করার জন্য তিনি অনবরত কাজ করে গেছেন।
কবি পাবলো নেরুদার আত্মজীবনী ‘অনুস্মৃতি’ কিনেছিলাম ২০০০ সালের দিকে। ১৯৯৭ সালে তাঁকে চিনেছিলাম তার অমর কবিতা আর নামে। ভবানীপ্রসাদ দত্তের করা অনুবাদে ‘অনুস্মৃতি’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম জীবনের প্রতি। সেই জীবন শুধু নেরুদার জীবন নয়, আমার নিজের জীবনেরও অনেক আনন্দ মিশে গেছিল হাজারো জীবনের সাথে। অনুস্মৃতি পড়ে আরও ভালো লেগেছিল সমাজতন্ত্র ও স্তালিনকে। আমার জীবনটা ভেতর থেকে বদলে দিয়েছিলেন নেরুদা আর তাঁর ‘অনুস্মৃতি’।
আমি নিশ্চিত নেরুদার জন্ম না হলে আমি অন্যরকম হতাম। এতো শ্রম দিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছি নেরুদার কবিতা থেকে পাওয়া শক্তিতে। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি, নেরুদা যেন আমাকে জাগিয়ে তোলে আর বলে ‘পশুরা জেগে আছে মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করার জন্য আর তুমি এখনো ঘুমোচ্ছো’। আমার মতো বিশ শতকের অনেক তরুণকে তিনি লড়তে শিখিয়েছিলেন সাম্যবাদের জন্য, অনেক কবিকে তিনি সাম্যবাদের পথে এনেছেন।
তিনি মিছিলে, প্রতিবাদে এবং আগুনের হলকায় আমাদেরকে শোনান এমন গান যা দুঃসময়েও অবিরাম গাওয়া যায়। তাঁর ‘কুড়িটা প্রেমের কবিতা এবং একটি হতাশার গান’ গ্রন্থের একটি কবিতার একটি লাইন হচ্ছে ‘আজ রাতে আমি লিখতে পারি সবচেয়ে করুণ পংক্তিগুলো’।[১] এই করুণ পংক্তিগুলোই শক্তি হয়ে বয়ে চলেছে শ্রমিকদের রক্তে আর ধমনিতে। সেই মহান সাধারণ মানুষগুলোর জন্য তিনি লিখেছেন,
“আমাদের এই যুগটা অর্থাৎ যে যুগে যুদ্ধ, বিপ্লব এবং সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন—অনেক কিছুই ঘটেছে বা এখনো অনেক কিছুই ঘটতে চলেছে, এমন একটা সময়কে কবিতার স্বর্ণযুগ বললে বোধ করি বেশি বলা হয় না। এ রকম অবস্থা অনেক কবিকেই বোধ হয় এর আগে দেখতে হয়নি—বর্তমানের কবিরা যা নিয়ত প্রত্যক্ষ করছেন। পৃথিবীর সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ আজ কোনো না কোনো প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন এবং সেসব প্রতিকূলতার প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে এখনকার অনেক কবিতায় আর মিছিলে।”[২]
কবি ও লেখকদের সংগ্রামী ভূমিকার কথা তিনি ভোলেন না। স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি লড়েছেন প্রগতি ও সাম্যবাদের পক্ষে। একজন কবি তার সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে সব সময় সচেতন থাকবেন, এটাই সমাজ আশা করে। কাজেই কবির নিজের মনমাফিক কবিতা লেখার সময় তাকে এটাও মনে রাখতে হবে, যে সমাজের মধ্যে তিনি রয়েছেন তার নির্দেশমতো সত্যাশ্রিত কবিতা লেখার দায়িত্বও তারই। কিন্তু সেই কর্তব্যবোধ থেকে বিচ্যুৎ হয়ে তিনি যদি নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই নিজেকে সমাজসচেতন কবি হিসেবে দাবি করতে পারেন না।[৩] তিনি দেখেছেন যে ‘ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের কাছে সত্যধর্মী কবি খুবই বিপদজনক’।[৪]
স্পেনের গৃহযুদ্ধ তাঁকে সহ লাতিন আমেরিকার অনেক কবিকে আমূল বদলে দিয়েছিল। সেই যুদ্ধে লোরকার মৃত্যু, রক্তক্ষরিত স্বদেশ, আহতদের আর্তনাদ, মাটিতে ছোপ ছোপ রক্ত নেরুদাকে খুবই ব্যথা দিয়েছে। এ সমস্ত বিষয় নিয়ে নেরুদা অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন। এগুলো যেন কবিতা নয়, সভ্যতার প্রাচীন দেয়ালে আঁকা একেকটি লাল ইশতেহার। এক একটি কবিতা যেন বিপ্লবের পোস্টার, আর কোনো কোনো কবিতা যেন গুলিবিদ্ধ বুকের ক্ষত।[৫] ইতিহাসকে কবিতার ভেতরে তিনি ধরতে পেরেছিলেন বলেই একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন যে,
“আমি মনে করি না যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ থেকে কবিতা তৈরি হতে পারে। বলতে হয় যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হচ্ছে এমন একটি বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক সম্ভাবনা সেখানে সকল ধরনের বোধগম্যতা অন্তর্ভুক্ত আছে। কেউ যদি আমার কবিতার মধ্যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ খুঁজে পায়, তাহলে তা পুরোপুরিভাবে আমার ধারণার বাইরে। আমি আমার কাজের মধ্যে বস্তুবাদ, বস্তুবাদী বা ঐতিহাসিক আধ্যাত্মিকতা খুঁজে বেড়াই না। আমি শুধু লিখে যাই। লেখার জন্য আমার প্রয়োজন হয় কেবল লেখার ইচ্ছা এবং কাগজ-কলম। লোকজন যে সমস্ত তত্ত্ব আমার কবিতা সম্বন্ধে তৈরি করে থাকে তা পুরোপুরিভাবে আমার আওতার বাইরের বিষয়। যদি কেউ আমার কাজের সঙ্গে দার্শনিক সম্পর্কসূত্র খুঁজে পায় তাহলে তা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আমি সকল কিছুর জন্য দরজা খুলে রেখেছি।” [৬]
পাবলো নেরুদা বিশ্বাস করেছেন যে, তাঁর আশপাশে এবং যে সমাজের মধ্যে আমরা সবাই জন্মেছি তার ন্যায়, অন্যায়, প্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা ও প্রতিবাদকে তাঁর কবিতার অংশ করতে। তিনি চেয়েছেন, প্রকৃতি ও তার সম্পদ, তার দুঃখ, তার বঞ্চনা, তার অভিযোগকে তাঁর কবিতার মধ্যে ধরে রাখতে, তিনি চেয়েছিলেন, মানুষের হৃদয়ের শব্দকে তাঁর কবিতার মধ্যে প্রকাশ করতে।
কোনো কবি যদি কোনো শব্দহীন, প্রাণের স্পন্দনহীন রাজত্বের মধ্যে থাকতে চেয়ে তার কানের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া মৌমাছির গুঞ্জনধ্বনিকে অস্বীকার করতে চান, মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে তাচ্ছিল্য করেন, তাহলে তা হচ্ছে সেই কবির পক্ষে এক অমার্জনীয় অপরাধ। নেরুদা তাই তাঁর কবিতার শেকড়কে রোপণ করেছিলেন মাটির গভীরে।
একজন কবি তার সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে সব সময় সচেতন থাকবেন, এটাই সমাজ আশা করে। কাজেই কবির নিজের মনমাফিক কবিতা লেখার সময় তাকে এটাও মনে রাখতে হবে, যে সমাজের মধ্যে তিনি রয়েছেন নেরুদার নির্দেশমতো সত্যাশ্রিত কবিতা লেখার দায়িত্বও তাই কবিদেরই। কিন্তু সেই কর্তব্যবোধ থেকে বিচ্যুৎ হয়ে তিনি যদি নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই নিজেকে সমাজসচেতন কবি হিসেবে দাবি করতে পারেন না।[৭]
মানুষকে ভালোবেসেই তিনি আমাদের কাছে আছেন। ভালোবাসার কাছে দায়বদ্ধ, জনগণের মুক্তির জন্য জীবনদানকারী এই মহান মানুষটি বলছেন, ‘ভালবাসা কত ক্ষণিকের, আর বিস্মৃতি কি বিশাল’।[৮] সব রকমের বিস্মৃতির কাছে অপরাজেয় এবং ভালোবাসার কাছে জয়ী এই মানুষটি ভোলা যায় না কবিতায় প্রশ্ন করছেন,
“যদি আমায় জিগ্যেস করো এতোদিন কোথায় ছিলাম
তখন আমাকে বলতেই হবে, ‘এরকমটাই হয়।’
বলতে হবে পাথরের ছায়ায় ঢাকা রুক্ষ মাটির কথা,
নদীর কথা, অসীম ধৈর্য ধরে যে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলেছে:
পাখিরা যা হারিয়েছে সেসব আমি কিছুই জানি না,
পেছনে ফেলে আসা এক সমুদ্র আর আমার বোনের কান্না।
কেন যে এতো প্রান্তর? কেন একটা দিন অন্য দিনের সাথে
তালায় আটকানো? কেন এতো কালরাত্রি গড়গড়ায়
মুখের ভেতরে? কেন এতো লাশ?”[৯]
হ্যাঁ, আজ গোটা দুনিয়ায় লাশ আর লাশ। সেই লাশেরা আজ যদি জীবিত হয়ে আমাকে আপনাকে প্রশ্ন করে কেন আমরা মারা পড়লাম, তাহলে আমাদের জবাব হারিয়ে গেছে পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের ভয়ানক নখরের আঁচড়ে। এই ভয়ানক নখরের নিচেও শ্রেণিসংগ্রাম ও যুদ্ধে ছিলেন নেরুদা। তিনি এক রেডিও সাক্ষাতকারে বলেছেন,
“আমরা আমাদের মহান পূর্ববর্তীদের উদাহরণ অনুসরণ করেছি। আমাদের চোখ রেখেছি জীবনের উপর, জনগণের দুর্ভোগ ও দুর্দশার উপর এবং আমাদের ল্যাটিন আমেরিকার অসাধারণ ভূমি ও চমৎকার আবাসস্থল, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু, সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর। এটা নতুন কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু আমরা এমন একটি নতুন প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম যেখানে শ্রেণিসংগ্রাম অনেক, অনেক বেশি নিদারুণভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল। আমরা শ্রমিকদের আলাদা অথবা সামষ্টিক ব্যক্তিগত জীবন সংগ্রামেও সম্পৃক্ত হয়েছিলাম।”[১০]
আমরা কী সেই জীবন-সংগ্রাম ও যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে পারছি? আজ বাংলায় কত শত কলমবাজ-মতলববাজ ফ্যাসিবাদিদের পক্ষে, গণশত্রুদের পক্ষে, বুর্জোয়াদের রক্ষার জন্য কলম ধরেছে। এরকম এক দুঃশাসনের কালে, নেরুদাকে মনে রাখা সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের সকল সৈনিকেরই অবশ্য কর্তব্য।
তথ্যসূত্র:
১. আজ রাতে আমি লিখতে পারি, কুড়িটা প্রেমের কবিতা এবং একটি হতাশার গান থেকে;
২. পাবলো নেরুদা, অনুস্মৃতি, অনুবাদ ভবানীপ্রসাদ দত্ত, প্রথমা, ঢাকা দ্বিতীয় মুদ্রণ, জানুয়ারি, ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৬৩
৩. পাবলো নেরুদা, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৬
৪. পাবলো নেরুদা, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা
৫. ড. সফিউদ্দিন আহমদ, পাবলো নেরুদার প্রেম ও বিপ্লবের কবিতা, অনন্যা, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পৃষ্ঠা ৩৬
৬. পাবলো নেরুদা, পাবলো নেরুদার রেডিও সাক্ষাৎকার, ভাষান্তর: মেহেদী হাসান, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১৯৭১ সালের শেষের দিকে এই সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ ‘নেরুদা, একজন আমেরিকান কবি’ শিরোনামে রেডিও কানাডা থেকে প্রচারিত একঘণ্টার রেডিও অনুষ্ঠানে প্রথম ব্যবহার করা হয়। সাক্ষাতকারটির লিংকঃ https://arts.bdnews24.com/?p=5234
৭. পাবলো নেরুদা, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৬
৮. আজ রাতে আমি লিখতে পারি, কুড়িটা প্রেমের কবিতা এবং একটি হতাশার গান থেকে;
৯. পাবলো নেরুদা, ভোলা যায় না, অনুপ সাদি অনূদিত, এ পৃথিবীর আবাসভূমি থেকে;
১০. পাবলো নেরুদা, পাবলো নেরুদার রেডিও সাক্ষাৎকার; মেহেদী হাসান অনূদিত, পূর্বোক্ত।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।
কত সুন্দর একটা লেখা। সাইটটিও খুব ভাল।
ভাল লেখা পড়তে ভাল লাগে।