স্পার্টাকাস আমেরিকান লেখক হাওয়ার্ড ফাস্টের ১৯৫১ সালের উপন্যাস

স্পার্টাকাস (ইংরেজি: Spartacus) আমেরিকান লেখক হাওয়ার্ড ফাস্টের ১৯৫১ সালের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এটি ৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক দাস বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখিত। বইটি স্ট্যানলি কুব্রিক পরিচালিত ১৯৬০ সালের চলচ্চিত্র এবং রবার্ট ডর্নহেলমের ২০০৪ সালের টিভি অভিযোজনকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

এই উপন্যাস সম্পর্কে হাওয়ার্ড ফাস্ট বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন যেসব কথা তা আমাদেরকে খুব অনুপ্রেরণা দেয়। তিনি লিখেছিলেন,

“যখন আমি এই বই লিখি আমি আশা করেছিলাম এর যথার্থ মম নিপীড়িত মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করবে, পীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের সব সংগ্রামই যে বৃহত্তর ব্যাপক এক সংগ্রামের অঙ্গ এই বোধ জাগিয়ে তুলতে কিছুটা অন্তত সাহায্য করবে। কী কাল, কী স্থান, বিচ্ছেদ কোথাও নেই,– আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী মানুষের যুগযুগব্যাপী অভিযান একদিন ক্ষান্ত হবে, সেই অনাগত দিনে আমরা এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হব, যুদ্ধ ক্ষুধা অন্যায় অবিচার তখন চিরতরে অপসারিত হবে।

যত বই লিখেছি তার মধ্যে ‘স্পার্টাকাস’ আমার সর্বাধিক প্রিয়, যদিও জানি এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা যথেষ্টই আছে। যদিও এই বইয়ের পটভূমি রচনায় প্রাচীন রোমকে এবং নায়ক রূপে দাস-বিদ্রোহের নেতা স্পার্টাকাসকে আমি বেছে নিয়েছি, আসলে কিন্তু এ-সব রূপক মাত্র; এই বইয়ের আসল বক্তব্য স্থান কাল নিরপেক্ষ স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার জন্যে মানুষের সংগ্রাম। ইতিহাসের এই আবরণে আমারই পরিচিত আমারই সমসাময়িক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্যক্তিকে আমি প্রচ্ছন্ন রেখেছি,–তাঁদের মধ্যে এমনও আছেন যাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অকপটে আত্মনিয়োগ করেছেন, আবার সেই সব অমানুষও আছে যারা সব শালীনতা বিসর্জন দিয়ে নির্মমভাবে স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করছে।

যে সত্যটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হচ্ছে আজকের আমেরিকার সঙ্গে প্রাচীন রোমের বিস্ময়কর সাদৃশ্য।

উভয় ক্ষেত্রেই শাসক শ্রেণীর সমস্ত সম্ভাবনা বিলুপ্ত, উভয়ক্ষেত্রেই প্রভুত্বের আসনে যারা সমাসীন তাদের নৈতিক চরিত্র এতই অধঃপতিত যে যা কিছু, অন্যায়, যা কিছু, রুচি ও শালীনতা বিরদ্ধে তারা তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু সেই প্রাচীন কাল থেকে ইতিহাস অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে আমরা আগামীকালের পাশাপাশি বাস করছি, এবং আমি নিশ্চিত আমাদের মধ্যে অনেকেই স্পার্টাকাসের স্বপ্ন পৃথিবীময় বাস্তবে পরিণত হতে দেখে যেতে পারবেন।”

প্রথম রোমান বাহিনীকে পরাস্ত করার পর স্পার্টাকাস সেই একমাত্র জীবিত সৈনিকটাকে বলেছিল। তুমি এই কথাগুলো তোমার সেনেটরদের শোনাবে:

‘সেনেটে ফিরে যাও, ফিরে গিয়ে হাতির দাঁতের এই আসাটা তাদের দিও। আমি তোমাকে প্রতিভূ করলাম। ফিরে গিয়ে তাদের বলো এখানে কি দেখে গেলে। বোলো, আমরা গোলাম-তারা যাদের বলে ‘ইনুস্ট্রুমেন্টুম ভোকেলে’, কথা কয় এমন যন্ত্র। বোলো তাদের- আমরা কি কথা কই। আমরা বলি, দুনিয়া আর তাদের সইতে পারছে না, সইতে পারছে না তোমাদের ওই অপদার্থ সেনেটকে আর অপদার্থ রোমকে। আমাদের হাড়মাংস নিংড়ে তোমরা যে-ধনদৌলত জমা করেছ দুনিয়া আর পারছে না তা সইতে। দুনিয়া সইতে পারছে না তোমাদের চাবুকের গান। মহামহিম রোমানরা ওই একটা গানই জানে। কিন্তু আমরা ও গান আর শুনতে চাই না।

গোড়াতে সব মানুষ এক ছিল, তারা শান্তিতে বসবাস করত, যা কিছু তাদের ছিল তা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত। কিন্তু এখন মানুষ দুরকমের, গোলাম আর মনিব। কিন্তু তোমাদের চেয়ে সংখ্যায় আমরা অনেক অনেকগুন বেশি। তোমাদের চেয়ে আমরা শক্তিতে বড়, মানুষও ভালো। মানুষের মধ্যে যা কিছু ভালো তা আমাদেরই আছে। আমরা আমাদের মেয়েদের ভালোবাসি, তাদের পাশে দাঁড়াই, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একসাথে লড়াই করি। কিন্তু তোমরা তোমাদের মেয়েদের বেশ্যা বানাও আর আমাদের মেয়েদের জানোয়ার করে ছাড়ো। আমাদের সন্তানদের আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলে আমারা কাঁদি, ভেড়ার পালের মধ্যে তাদের আমরা লুকিয়ে রাখি, আরো দুদন্ড যাতে কাছে পাই। কিন্তু তোমরা গরু-ভেড়ার মত বাচ্চাদের আবাদ কর। আমাদের মেয়েদের দিয়ে তোমরা বাচ্চা পয়দা করো, তারপর গোলামবাজারে নিয়ে গিয়ে তাদের বেঁচে আসো যে চড়া দাম হাঁকে তার কাছে।

পুরুষগুলোকে তোমরা কুত্তা বানাও, তাদের এরেনায় পাঠিয়ে দাও যাতে তোমাদের একটু আনন্দ দিতে তারা খুনোখুনি করে মরে; আমরা একজন আরেকজনকে খুন করছি দেখতে দেখতে তোমাদের রোমান ভদ্রমহিলারা কোলের কুকুরটাকে আদর করে দামী দামী খাবার খাওয়াতে থাকে।

তোমরা কি জঘন্য, জীবনটাকে কি কদর্য করে তুলেছ। মানুষের সব স্বপ্ন, তাদের হাতের শ্রম, মাথার ঘাম, তোমাদের কাছে ঠাট্টার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা নিজেদের নাগরিকেরা খয়রাতিতে বাঁচে আর সার্কাসের এরেনায় দিন গুজরান করে। মানুষের জীবনটা তোমাদের কাছে উপহাসের জিনিস, তার সব মূল্য তোমরা নিঃশেষে শুষে নিয়েছ। তোমর বধ করার জন্যেই বধ করো, রক্ত বইতে দেখলে মজা পাও। কচি কচি শিশুদের খনিতে জুতে দিয়ে কয়েকমাসের মধ্যে তাদের খাটিয়ে মেরে ফেল। সারা দুনিয়া লুট করে তোমরা তোমাদের জাঁকজমক গড়ে তুলেছ। এবার তা খতম হলো।

তোমার সিনেটকে বলো, তাদের দিন শেষ হয়েছে। যন্ত্র এই কথা বলে। বলো তোমার সেনেটকে, আমাদের শায়েস্তা করতে পাঠায় যেন তাদের ফৌজ, এবারের মত তারাও আর ফিরবে না, আমরা তাদেরও খতম করব আর তাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলো নিজেদের কাজে লাগাব। এই যন্ত্রের কথা সারা দুনিয়ে শুনবে, দুনিয়ার যেখানে যত গোলাম আছে সবাইকে ডেকে আমরা চিৎকার করে বলব, ওঠো জাগো, শেকল ছিঁড়ে ফেলো। আমরা যাবো ইতালির ভেতর দিয়ে, যেখান দিয়ে যাবো গোলামি-মানুষ আমাদের দলে এসে ভিড়বে। তারপর, একদিন পৌঁছাব আমরা তোমাদের অমরাবতী রোমে। সেদিন আর তা অমর থাকবে না।

বোলো একথা তোমার সেনেটকে। আর বোলো, আমরা কবে আসছি তাদের জানিয়ে দেব। তারপর রোমের পাঁচিলগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দেব। তারপর যেখানে সেনেট বসে আমরা সেই বাড়িতে যাবো, সেখান থেকে, প্রতাপের উচ্চাসন থেকে সেনেটরদের টেনে নামিয়ে আনবো, ছিঁড়ে ফেলবো তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ যাতে তারা উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াতে পারে, আর সেইরকম বিচার পায় আমরা যেমন তাদের কাছে পেয়ে এসেছি।

আমরা কিন্তু তাদের প্রতি সুবিচারই করবো, বিচারে তাদের যা পাওনা তা পুরো মাত্রায় আমরা মিটিয়ে দেব। তাদের প্রতিটি অন্যায় তাদের সামনে তুলে ধরা হবে এবং পুরোপুরি জবাবদিহি তাদের করতে হবে। একথা তাদের জানিয়ে দিও, যাতে তারা তৈরি হওয়ার ও নিজেদের পরীক্ষা করার সুযোগ পায়। তাদের সাক্ষী দিতে দিতে ডাকা হবে এবং আমাদের স্মৃতিতে অনেক ঘটনা জমে আছে।

তারপর, বিচারের পালা শেষ হলে, আমরা আরো ভালো ভালো শহর গড়ব, সুন্দর পরিচ্ছন্ন সব শহর, পাঁচিল দিয়ে তা ঘেরা থাকবে না, মানুষ মাত্রেই সেখানে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারবে। সেনেটের উদ্দেশ্যে এই আমার বক্তব্য। এই কথাগুলো তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিও। তাদের বোলো, স্পার্টাকাস নামে এক গোলাম এই বাণী দিয়েছে…’

তথ্যসূত্র

১. হাওয়ার্ড ফাস্ট, স্পার্টাকাস, অনুবাদ সুনীল চট্টোপাধ্যায়, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা. লি. কলকাতা, প্রথম সংস্করণ, এপ্রিল ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ১৯৬-১৯৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!