ছোটগল্প বা ছোটোগল্প (ইংরেজি: Short story) কথাসাহিত্য বা গদ্য-সাহিত্যের বিশেষ শাখা। আয়তনে ক্ষুদ্র অথচ ব্যঞ্জনাধর্মী সাহিত্যকর্ম। নাটকীয় আকর্ষণীয়তা, উৎকণ্ঠা, চরমমুহূর্ত, দৃঢ় সংবদ্ধ ফর্ম সার্থক ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের মতে ছোটগল্পে ‘ঘটনার ঘনঘটা, বর্ণনার ছটা’ থাকে না, তত্ত্ব, উপদেশও থাকে না, থাকে অতৃপ্তি যাতে মনে হয় শেষ হয়ে না হইল শেষ।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই ছোটগল্পের প্রবর্তক ও সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পকার। ইউরোপীয় সাহিত্যে বোকাচ্চিয়ো-র ‘দেকামেরন’, ভলতেয়ার, দিদেরো, জোলা, মোপাঁসা, স্তাঁদাল, বালজাক, ফ্লোবেয়ার প্রমুখ গল্পকারের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রুশসাহিত্যে গোগোল, চেকভ, তুর্গেনিভ, ম্যাক্সিম গোর্কিকে ছোটগল্পের সার্থক রূপকার বলা যায়।[১]
গল্প শব্দটির অর্থ অনুধাবন যতোটা সহজ, সাহিত্যরূপ হিসেবে ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ নির্ণয় ততোটা সহজ কাজ নয়। আমরা জানি, মানুষের আদিম বৃত্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গল্প বলা এবং শোনা। সেই বৃত্তি ইতিহাসের পথ ধরে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এসে সাহিত্যিকের সচেতন মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়। সাহিত্যের একটি নতুন শাখা হিসেবে ছোটগল্পের উদ্ভব হয়।
ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য
এডগার এ্যালান পো-র ভাবনা অনুসারে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যকে তিনটি প্রধান সূত্রে চিহ্নিত করা যেতে পারে:
১. ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পাঠককে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দান করা, (A sense of the fullest satisfaction), আনন্দ দান করা।
২. ছোটগল্প একটি মানবিক শিল্পরূপ— শিল্পীর জীবনবিন্যাসের ব্যাখ্যা এবং অভিজ্ঞতার ঐক্যবদ্ধ সংহত রূপ।
৩. ঘটনাংশ, চরিত্র, পরিবেশ, ঘটনা খুঁত ভাবসূত্র – এগুলোর সমন্বয়ে ছোটগল্প এক ঐক্যময় শিল্পরূপ।
সময় ও মানবিক রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছোটগল্পের রূপরীতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এডগার এ্যালান পো-র সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ক সূত্রগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক। ব্রার ম্যাথিউজ তাঁর ‘Philosophy of the short story’ (১৮৮৪) প্রবন্ধে ছোটগল্পের স্বরূপ নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন: A short-story deals with a single character, a single event, a single emotion, or the series of emotions cotted forth by a single situation.
‘Single’ শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ম্যাথিউজ পো উচ্চারিত ঐক্যের ধারণাকেই স্বীকার করে নিলেন। এরপর বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধব্যাপী ছোটগল্পের রূপরীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। তার বিষয় ও আঙ্গিকের ধারণারও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। কোনো কোনো সমালোচক ছোটগল্পকে জীবনের Sketch বা খসড়া হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। চিত্রকলার ‘স্কেচ’ এবং ছোটগল্প যে এক জিনিস নয়, এ সত্যটি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হলো হার্শেল ব্রিকেল রচিত ‘What happened to the short story’, (১৯৫১) প্রবন্ধে। তিনি সঙ্গত কারণেই বললেন স্কেচের বৈশিষ্ট্য স্থিতিশীলতা আর ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য গতিশীল।
আয়তন বা আকৃতির ছোটো-বড় দিয়ে নয়, বিষয়ের মধ্যে বড় কোনো ব্যঞ্জনা এবং সমগ্রতা সৃষ্টি হলো কি-না সেটাই সার্থক ছোটগল্পের স্বভাবধর্ম। এ-প্রসঙ্গে মানিকের ‘একরাত্রি’ গল্পটির উলেখ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম পর্যায়ের এই ছোটগল্পে ঘটনা, চরিত্র, পরিবেশ এবং ঘটনান্তর্গত ভাবসূত্রকে নিবিড় সংহত রূপ দিয়েছেন। নোয়াখালির প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেকেন্ড মাষ্টারের স্মৃতিকথনে গল্পের বিষয়বস্তু উন্মোচিত হয়েছে। সুরবালা নাম্মী এক বালিকার সঙ্গে তার শৈশব কৈশোরের সম্পর্ক, পরে মাটশিনী-গরিবালডি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কলকাতায় গমন, সমাজ ও দেশোদ্ধারের প্রত্যাশায় যৌবনের উজ্জ্বল সৃষ্টিশীল মুহূর্তগুলোর অপচয় এবং শেষে একটি সাধারণ বিদ্যালয়ের সেকেন্ড মাষ্টার হওয়ার ঘটনাক্রম অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বিধৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যর্থতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। এ-গল্পে ঘটনা কিংবা চরিত্র কোনোটাই প্রাধান্য পায়নি। সবকিছু মিলিয়ে এক নিবিড় ঐক্যবদ্ধ গল্পরূপ সৃষ্টি হয়েছে। এ-গল্পকে জীবনের খন্ডাংশের রূপায়ণ বলা যাবে না। বরং জীবনের অন্বিষ্ট ভাববস্তুকে একটি চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র আয়তনে তুলে ধরা হয়েছে। স্কেচ বা খসড়া জীবন ধরা দেয় অস্পষ্টষ্ট ব্যঞ্জনাহীন অবস্থায়। কিন্তু ছোটগল্পে ক্ষণকালীন জীবনের মধ্যেও সৃষ্টি হয় চিরকালীন ব্যঞ্জনা। ‘একরাত্রি’ গল্পের শেষে প্রলয়ংকরী রাত্রের অন্ধকারে সেকেন্ড মাষ্টার ও সুরবালার পাশাপাশি অবস্থান সত্ত্বেও যে একাকিত্ব, নৈঃসঙ্গ্য ও বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরা হয়েছে, তার ব্যঞ্জনা চিরকালীন।[২]
উপযুক্ত আলোচনা থেকে ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ের প্রশ্নে আমরা বলতে পারি, ছোটগল্প এমন এক ধরনের সাহিত্যরূপ, যা নির্দিষ্ট ঘটনাংশকে আশ্রয় করে চরিত্র, পরিবেশ ও ভাবসূত্রের মধ্যে নিবিড় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। এই ভাবসূত্র কখনো গভীর কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, কখনো বা নাটকীয় মুহূর্তের উজ্জ্বলতায় আবার কখনো কখনো মানব মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের গভীরতায় নিবিড় রসরূপ লাভ করে।
ছোটগল্পের উপকরণ জীবনের যে-কোনো ক্ষেত্র থেকে গৃহীত হতে পারে। কিন্তু জীবনের যে অংশ লেখকের অন্বিষ্ঠ, তাকে সমগ্র রূপে উপস্থাপন করা সার্থক ছোটগল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ছোটগল্পের গঠন কৌশল
উপন্যাস এবং ছোটগল্পের প্রকরণের পরিভাষা অভিন্ন। যেমন, দৃষ্টিকোণ (Point of view), ঘটনাংশ (Plot), চরিত্রায়ণ (Characterization), পরিচর্যা (Treatment) প্রভৃতি। কোনো ছোটগল্পকে সমগ্র জৈব-ঐক্যে (Organic whole) রূপ পেতে হলে উলিখিত আঙ্গিক-উপাদানের ব্যবহার আবশ্যিক। মানুষের বহির্জীবন কিংবা অন্তর্জীবনের যে-কোনো ক্ষেত্র থেকে ছোটগল্পের উপকরণ আহরিত হতে পারে। নির্মম কঠিন বাস্তব জগৎ, মানবমনের জটিল রহস্য, সংকট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহমান জীবনের যে-কোনো প্রসঙ্গকে গল্পকার গল্পের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।
দৃষ্টিকোণ হচ্ছে জীবনকে দেখা এবং উপস্থাপন করার বিশেষ ভঙ্গি। ছোটগল্পে বিধৃত ঘটনা, চরিত্র ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ যখন গল্পকার নিরাসক্তভাবে উপস্থাপন করেন, তখন প্রয়োগ ঘটে সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের (Author’s omniscient point of view)। নায়ক, কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা গল্পবিধৃত কোনো চরিত্রের কথকতায় গল্পের ঘটনা বর্ণিত হলে, তা বলা হয় উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ (First person’s point of view)। এক্ষেত্রে সমগ্র গল্প ‘আমি’ নামক বক্তার দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় লেখক কিংবা কেন্দ্রীয় চরিত্র অথবা কথক চরিত্র (Teller character) ছাড়াও ঘটনার প্রান্তে অবস্থানকারী কোনো চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের কাহিনী উপস্থাপিত হয়। এ-পদ্ধতিকে বলা হয় প্রান্তিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ (peripheried character’s point of view)। ‘একরাত্রি’ গল্পটি শুরচ হয়েছে এ-ভাবে:
“সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি, এবং বউ-বর খেলিয়াছি। তাহাদের বাড়িতে গেলে সুরবালার মা আমাকে বড়ো যত্ন করিতেন এবং আমাদের দুইজনকে একত্র করিয়া আপনা-আপনি বলাবলি করিতেন, ‘আহা, দুটিতে বেশ মানায়।”
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনো এক স্কুলের সেকেন্ড মাষ্টারের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। উত্তম পুরুষে গল্পের ঘটনা, চরিত্র, চরিত্রের অন্তর্গত জগৎ, পরিবেশ-পরিস্থিতি উপস্থাপন করতে লেখককে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়।
সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ অপেক্ষা কথক চরিত্রের মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে ঘটনা বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের দক্ষতা অতুলনীয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্প সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত। সমাজ ও মানুষের জীবনের যে অনালোকিত প্রান্ত এ-গল্পে উন্মোচিত হয়েছে, লেখকের জীবনাভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য ও গভীরতা ছাড়া তা সম্ভব ছিলো না। ভিখু, পাঁচী ও বশিরের চরিত্রের গতিবিধি ও অন্তঃর্জগৎ অবলোকনের জন্য লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের প্রয়োগই যথার্থ।
প্লট (Plot) বলতে আমরা সাধারণত উপন্যাস, নাটক বা গল্পবিধৃত ঘটনাকে বুঝি। ইতিহাসেও তো ঘটনা থাকে। তাকে তো পট বলি না, গল্প হিসেবেও চিহ্নিত করি না। এর কারণ ইতিহাস হলো ঘটে যাওয়ার কাহিনীর বিবরণমাত্র। আর গল্প উপন্যাসের ঘটনা সময়ের শৃঙ্খলা অনুসারে বিন্যস্ত হয়। এ-কারণেই প্লটকে বলা হয় কার্যকারণ-সম্বন্ধযুক্ত সময়ের বিন্যাস। গল্পবিধৃত চরিত্রও সেই সময়ের মধ্য দিয়ে বহমান।
চবিত্র বা মানব-মানবী যে-কোনো সাহিত্যরূপের মুখ্য উপাদান। দষ্টিকোণ ও প্লটের অনিবার্যতায় গল্পে চরিত্রের অবস্থান নিরূপিত হয়। চরিত্রকে একজন লেখক কী প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করবেন – সেই মনোভঙ্গি থেকেই চরিত্রায়ণ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
ছোটগল্প কেবল বর্ণনাত্মক শিল্প নয়। পরিবেশ পরিস্থিতি ও চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়োজনে গল্পকার তাঁর বর্ণনাভঙ্গিকে (Narrative situation) বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করেন। দৃষ্টান্তসহ বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ‘একরাত্রি’ গল্পে প্রচণ্ড ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে স্কুলের সেকেন্ড মাষ্টার ও সুরবালার পাশাপাশি অবস্থানের চিত্রটি নিম্নরূপ:
“তখন প্রলয়কাল, তখন আকাশে তারার আলো ছিলো না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গেছে – তখন একটি কথা বলিলেও ক্ষতি ছিল না – কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেহ কাহাকেও একটা কুশল প্রশ্নও করিল না। কেবল দুইজনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলাম। পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যুস্রোত গর্জন করিয়া ছুটিয়া চলিল।”
উদ্ধৃত অংশটি কেবল বর্ণনা (Narrative) বা চিত্র (Picture) নয়, এক গভীর কাব্যময়তা এখানে সুস্পষ্ট। সুতরাং এ অংশের Treatment বা পরিচর্যাকে বলতে হবে কাব্যানুগ বা Poetic.
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ’র ‘নয়নচারা’ গল্পের শুরুটা এরকম:
“ঘনায়মান কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটিকে ময়ুরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে। কিন্তু মনের চরে যখন ঘুমের বন্যা আসে তখন মনে হয় ওটা সত্যিই ময়রাক্ষী: রাতের নিস্তব্ধতায় তার কালো স্রোত কল-কল করে, দূরে আঁধারে দেখা তীররেখা নজরে পড়ে একটু-একটু, মধ্যজলে-ভাসন্ত জেলেডিঙ্গিগুলোর বিন্দু বিন্দু লালচে আলো ঘন আঁধারেও সর্বংসহা তারার মতো মৃদু-মৃদু জ্বলে।”
গল্পটিকে সূত্রানুসারে সর্বজ্ঞ-লেখকের দৃষ্টিকোণে উপস্থাপিত মনে হলেও, গভীর বিবেচনায় দুর্ভিক্ষপীড়িত নয়নচারা গ্রাম থেকে শহরে আগত আমুর দৃষ্টিতেই এর ঘটনা ও বিষয় বিন্যস্ত হয়েছে। উদ্ধৃতাংশের প্রতিটি বাক্যই ব্যঞ্জনাময়, প্রতীকী। জনশূন্য রাস্তাটিকে ময়ূরাক্ষী নদী হিসেবে প্রতিভাত হওয়ার কার্যকারণ আমু চরিত্রের দৃষ্টিকোণ প্রয়োগের মধ্যে নিহিত রয়েছে। এ-অংশের পরিচর্যায় কাব্যময়তা ও প্রতীকী (Symbolic) কৌশলের অপরূপ মিশ্রণ ঘটেছে। ছোটগল্পের আয়তন নিয়ে এডগার এ্যালান পো-সহ প্রথম যুগের গল্পকারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু আয়তন ছোটগল্পের স্বরূপ নির্দেশের জন্য যথেষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘পোষ্টমাষ্টার’ এবং ‘নষ্টনীড়’ গল্প আয়তনের দিক থেকে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের ধারক। ‘পোষ্টমাষ্টার’ গল্পের সীমিত আয়তনে দুটি চরিত্রের অন্তর-বাহির সংহত রূপ পেয়েছে। আর ‘নষ্টনীড়’ আয়তনের দিক থেকে উপন্যাসোপম। কিন্তু ঘটনা ও চরিত্রের একাগ্র সমগ্রতা গল্পটিকে অনন্যতা দান করেছে।
ছোটগল্পের রূপবৈচিত্র্য
আধুনিক কালে ছোটগল্প জীবনের বহুমুখী জটিলতার স্পর্শে বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। তবে গঠন-বৈশিষ্ট্য অনুসারে ছোটগল্পকে প্রধানত তিনটি প্রবণতায় চিহ্নিত করা যায় :
১. ঘটনাপ্রধান গল্প
২. চরিত্র-প্রধান গল্প।
৩. ভাব বা বিষয়বস্তু প্রধান গল্প।
গল্প রচনার প্রথম পর্যায়ে ঘটনা প্রধান গল্পেরই আধিক্য ছিলো। ঘটনার বৈচিত্র্য ও ঐক্যই ছিলো ঐ ধারার গল্পের বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিচরিত্রের নানামুখী রূপ বিধৃত হয় চরিত্রপ্রধান গল্পে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অতিথি’, ‘হৈমন্তী’ ও ‘স্ত্রীরপত্র’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘সতী’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তারিণী মাঝি’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ চরিত্র প্রধান গল্পের দৃষ্টান্ত। চরিত্র মানুষের ব্যক্তিত্ব ও অসংগতিত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। চরিত্রপ্রধান গল্প কখনো কখনো বক্তব্যের গভীরতায় বিষয়বস্তু-কেন্দ্রিক হয়ে উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রপ্রধান অধিকাংশ গল্পই এর দৃষ্টান্ত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ সমাজতান্ত্রিক জীবনদৃষ্টির সঙ্গে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনতত্ত্বের সমন্বয়ে এক গভীরতর বক্তব্যের শিল্পরূপ হয়ে উঠেছে। ফলে বিষয়প্রধান গল্পের স্বভাবধর্ম এ-গল্পেও লক্ষণীয়। ভাব বা বিষয়বস্তু প্রধান গল্পে মানুষের বিচিত্র উপলব্ধি, অনুভূতি বা মানসিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটে। জীবনকে গভীর এবং সূক্ষ্মদৃষ্টিতে অবলোকন করার ফলে এ-জাতীয় গল্পে কাব্যময়তা ও দার্শনিক চিন্তার প্রকাশ ঘটে কখনো কখনো। গল্পের এই প্রধান তিনটি ধারাকে বিষয় ও আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আরো উপশাখায় ভাগ করা যায়। অবশ্য এক গল্পে একাধিক প্রবণতার মিশ্রণও ঘটে কখনো কখনো। যেমন,
১. মানব সম্পর্ক বিশ্লেষণমূলক গল্প। ব্যক্তিসম্পর্কের বিচিত্র দিক এই জাতীয় গল্পে বিধৃত হয়।
২. সমাজবিষয়ক। এ-জাতীয় গল্পে সমাজজীবনের বিচিত্র প্রসঙ্গের উপস্থাপন ঘটে। বিশ্লেষণের দক্ষতা ও গভীরতায় রাজনীতির তত্ত্ব, আদর্শ ও ঘটনারও প্রতিফলন ঘটে সমাজ-বিশ্লেষণমূলক গল্পে।
৩. মনস্তাত্ত্বিক। মানবমনের রহস্যময় দিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ-জাতীয় গল্পে বিধৃত হয়।
এই তিনটি উপশাখার মধ্যে প্রেমসম্পর্ক, প্রকৃতির পটভূমিতে মানব অস্তিত্বের কর্ম ও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া প্রভৃতির রূপায়ণ ঘটে।
দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকেও ছোটগল্পকে কয়েকটি উপশাখায় বিন্যস্ত করা যায়। যেমন,
১. রোমান্টিক
২. হাস্যরসপ্রধান বা ব্যঙ্গমূলক।
লেখকের অন্তর্মুখী গীতময় জীবনচেতনা রোমান্টিক গল্পের বৈশিষ্ট্য। হাস্যরসপ্রধান গল্প কেবল বিশুদ্ধ হাসিরই সৃষ্টি করে না, কখনো কখনো গভীর ইঙ্গিতময় বক্তব্যও প্রদান করে। পদ্ধতি বিচারেও ছোটগল্পকে একাধিক শাখায় বিন্যাসিত করা যায়। যেমন,
১. কাব্যিক,
২. রূপকধর্মী
এ-ছাড়া অতিপ্রাকৃত, প্রতীকধর্মী, বিজ্ঞান নির্ভর, ইতিহাস-আশ্রয়ী, গার্হস্থ্য জীবনের প্রাত্যহিকতা নির্ভর, ফ্যান্টাসি বা উদ্ভট বিষয়ের আশ্রয়েও ছোটগল্প লিখিত হতে পারে।
বিগত দুই শতাব্দীতে ছোটগল্পের রূপ ও রীতির বহুমুখী পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের জীবনবিন্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছোটগল্পে বিষয়ের পরিধিও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গল্পের উপকরণের জগৎ হয়েছে বিস্তৃততর। যন্ত্র, কফিন, বাস্তব জীবনের ব্যাখ্যাতীত কোনো বিষয়ও এখন গল্পের উপাদান। ছোটগল্প এমন এক ধরনের সাহিত্যরূপ যা নির্দিষ্ট ঘটনাংশকে আশ্রয় করে চরিত্র, পরিবেশ ও ভাবসূত্রের মধ্যে নিবিড় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। এই ভাবসূত্র কখনো গভীর কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, কখনো বা নাটকীয় মুহূর্তের উজ্জ্বলতায়, আবার কখনো কখনো মানব-মনস্তত্ব বিশ্লেষণের গভীরতায় নিবিড় রসরূপ লাভ করে। ছোট গল্পের উপকরণ জীবনের যে কোনো ক্ষেত্র থেকে গৃহীত হতে পারে। কিন্তু জীবনের যে অংশ লেখকের অন্বিষ্ঠ, তাকে সমগ্র রূপে উপস্থাপন করা সার্থক ছোটগল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
তথ্যসূত্র
১. সুরভী বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যের শব্দার্থকোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ৫১
২. বেগম আকতার কামাল, ভীষ্মদেব চৌধুরী, রফিকউল্লাহ খান ও অন্যান্য, বাংলা ভাষা: সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, পুনর্মুদ্রণ ২০১১, পৃষ্ঠা ১৯-২৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।