স্যামসন অ্যাগনিসটিজ জন মিল্টনের লেখা একটি ট্রাজেডি নাটক

স্যামসন অ্যাগনিসটিজ (ইংরেজি: Samson Agonistes) মহাকবি জন মিলটনের লেখা একটি ট্রাজেডি নাটক।  এই নাটকটি, “প্যারাডাইস রিগেইনড”-এর সঙ্গে একত্র ১৬৭১ সালে প্রকাশিত হয়। রচনাকাল সম্বন্ধে সঠিক জানা না গেলেও সঙ্গত অনুমান এই হবে যে এটাই তার শেষ রচনা, এরপর তিনি আর কিছুই লেখেন নি।[১]

মিল্টনের আযৌবন বাসনা ছিল নাটক, বিশেষত ট্রাজেডী রচনার, এবং সেটা হবে অ্যাটিক ধ্রুপদী নাটকের আদর্শে লেখা। আদম-হাওয়ার বাইবেলভিত্তিক কাহিনী নিয়ে তার যে এপিক, সেটাও তিনি এক সময়ে নাটকের আঙ্গিকে লেখার কথা ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বাইবেলেরই অন্য এক কাহিনী, স্যামসন কাহিনী, অবলম্বনে তার একমাত্র ট্র্যাজেডী “সামসন অ্যাগনিসটিজ” রচনা করেন।[২]

স্যামসন কাহিনী বাইবেল, পুরাতন নিয়মের (Old testament) “বিচারকগণের বিবরণ” (Book of Judges) ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়ে বিবৃত হয়েছে। প্রধানত এই আকর থেকেই মিল্টন তার প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পেয়েছেন। এ ছাড়া জোসেফাস (Flavius Josephus)-এর ইহুদি পুরাকাহিনী তাঁকে কিছু তথ্য দিয়ে থাকবে। কাহিনীর চুম্বক মিল্টন নিজেই দিয়েছেন। 

কবির অন্যান্য রচনার মতো স্যামসন অ্যাগনিসটিজ রচনার পিছনেও একটি গুঢ় নৈতিক, এমন কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল, অনুমান করা যায়। এই নাটক যে রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের জন্য লেখা হয় নি, কবি স্পষ্ট ভাষায় নিজেই বলে গেছেন। সাধারণ রঙ্গমঞ্চ সম্বন্ধে তাঁর বিরূপতায় তিনি পিউরিট্যান গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম। তবে ট্র্যাজেডীর যে সাহিত্যরূপ তিনি অ্যাথেন্সের তিনজন কবির রচনায় দেখেছেন, সে বিষয়ে তার গভীর প্রত্যয়ের কথা তিনি মুখবন্ধেই বলেছেন, ট্র্যাজেডীকে তিনি থিয়েটার অনুষঙ্গ থেকে আলাদা করে তার দার্শনিক গভীরতায়, তার নান্দনিক মূল্যে মূল্যায়ন করেছেন। ওই তিনজনের সহযাত্রী হতে পারলে তিনি কৃতার্থ হবেন।

নৈতিক ও সাহিত্যিক প্রেরণার বাইরে ছিল আরও এক তৃতীয় প্রেরণা যাকে রাজনৈতিক নামে অভিহিত করা যায়, এমন কি ব্যক্তিগত প্রেরণাও বলা যায়। স্যামসনের মধ্যে মিল্টন নিজেকে আবিষ্কার করেছেন, শুধু অন্ধত্বের কারণেই নয়, বৈবাহিক অভিজ্ঞতার দিক দিয়েও। স্যামসন প্রবঞ্চিত হয়েছে পরপর দুবার, দুই স্ত্রীর দ্বারা। মিল্টন কখনোই তার প্রথমা স্ত্রীর আচরণ ভোলেন নি, শত্রুর হাতে তুলে না দিলেও যে তাকে ত্যাগ করে শত্রু-শিবিরেই চলে গিয়েছিল। রাজতন্ত্রের পুনর্বাসনের পর দেশ তার কাছে শত্রুপুরী গাজায় পরিণত হলো, যেখানে বন্দি ও দৃষ্টিহীন স্যামসনের মতো তিনি বিপন্ন, নির্বান্ধব। দুই পরিস্থিতির মধ্যে এতখানি সাযুজ্যই তাকে ট্র্যাজেডীর বিষয় হিসাবে স্যামসন-কাহিনীর দিকে ঠেলে দিয়েছিল, এই অনুমানে কোনো কষ্টকল্পনা নেই। স্যামসন নিজেই মৃত্যুর বিনিময়ে শত্রুকে পর্যদুস্ত করেছিল, শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিল। সে নিজে যখন পরাজিত, নিঃশেষিত বলে সবাই ভাবছে, তখনই সে পুনরুজ্জীবিত হলো ফিনিক্সের মতো। ইংল্যাণ্ডেও, অনুরূপভাবে যে আদর্শ এখন ভূলুণ্ঠিত, কবির সেই গণপ্রজাতন্ত্রী দেশের আদর্শও একদিন বিজয়ী হবে, জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তিনি চেয়েছিলেন এই বিশ্বাসের কথা বলে যেতে।

ট্র্যাজেডীর নায়ক স্যামসনের সঙ্গে মিল্টনের ব্যক্তিগত সাদৃশ্য যত ঘনিষ্ঠই হোক, স্যামসনকে আমরা বাইবেলের স্যামসন হিসেবেই দেখতে পারি। নিজেকে মিল্টন সযত্নে আড়াল করেছেন। তার ট্রাজেডীতে ব্যক্তিকতার দোষ ঢুকেছে, বলা যায় না। যে-ভাবে ও যতখানি ব্যক্তির ও সমকালের ছায়াপাত ঘটেছে, তাতে নাটকের আবেগমূল্য বেড়েছে বই কমে নি:

প্রায়শঃই তাকে তুমি ফেলে রেখে যাও বিধর্মীর
কিংবা নাস্তিকের ক্রুদ্ধ তরবারী মুখে, তার শব
কুঁড়ে খায় কুকুর শকুনি; কিংবা রাখো বন্দি করে,
কিংবা সময়ের ফেরে অবিচারী আদালত তাকে
দণ্ড দেয়, উপরন্তু অকৃতজ্ঞ জনতার অভিশাপ—;

এই উক্তির মধ্যে রেস্টোরেশনের পর রাজার পক্ষ বিরোধীদের উপর, এমনকি মৃত ও সমাধিস্থ শত্রুর দেহাবশেষের উপর, যে অন্যায় ব্যবহার করেছিল, তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। কে বলবে যে সে-সব দ্ব্যর্থব্যঞ্জক পংক্তিও নাটকীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক নয়? স্যামসনের মুখে স্ত্রীজাতির বিরুদ্ধে যে কঠিন উক্তি, সে যে নারী বিদ্বেষী মিল্টনেরই উক্তি,—জানার পরও তা স্যামসনের উক্তি হিসেবেই গ্রাহ্য। যখন কোরাস বলে,

তবু জানি রূপ যত ক্ষতিকর হোক তার অদ্ভুত ক্ষমতা
কৃত অন্যায়ের পর ঘুরে আসে, ফিরে পেতে চায়
একদার প্রেম, তাকে সহজে ফেরান দায়,
বুকের গভীর হতে বাদ সাধে প্রেম,
প্রণয়ের মনস্তাপ গোপনে অন্তর বিদ্ধ করে। 

তখন তার মধ্যে মিল্টনের ব্যক্তিগত স্বর কোরাসের স্বরের সঙ্গে এমনভাবে মিলে যায় যে আমরা মেরী পাওয়েলের সঙ্গে ডেলাইলাকে মিলিয়ে দিতে পারি, নাটকীয় রসের বিন্দুমাত্র হানি না করেও।

এটা সম্ভব হয়েছে, ধ্রুপদী গ্রিক নাটকের সঙ্গে মিল্টনের গভীর পরিচয়ের ফলে। তিনি নিজেও সাহিত্যের ধ্রুপদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। যদিও তাঁর কবিতায় ও তার বিভিন্ন গদ্য রচনায় তাঁর ব্যক্তিগত উপস্থিতি কম নয়, কিন্তু নাটকে যে নৈর্ব্যক্তিকতার প্রয়োজন, তিনি জানতেন এবং কিভাবে সেটা রক্ষা করতে হয় তাঁর অজানা ছিল না।

বস্তুত নাটকের স্থির লক্ষ্য সামনে রেখেই স্যামসন রচিত হয়েছে। ঘটনার বিন্যাসে, চরিত্র নির্মাণে, যথানির্দিষ্টভাবে কোরাসের ভূমিকা নির্দেশে, সংলাপের নাটকীয়তায় নাটকের দাবিই প্রাধান্য পেয়েছে। স্যামসনের প্লটে আদি আছে অন্ত আছে মধ্য নেই, ড. জনসনের এই আপত্তিও যথার্থ নয়। অতলান্ত অবসাদ থেকে স্যামসনের নিদ্রিত পৌরুষের জাগরণ যা ডেলাইলা, হারাফা ও কর্মচারীর সঙ্গে তার মোকাবিলার মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, মধ্য পর্যায়ের এই পরিবর্তনই ত সঙ্কট মুহূর্তের জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। স্থুল অর্থে ঘটনা না থাকলেই নাটকীয় অর্থে তা শূন্যতা নয়।

পাঁচ অঙ্কে ও বহুদৃশ্যে বিভক্ত নয়, গ্রিক আদর্শে গঠিত মিল্টনের নাটক। গ্রিক ধ্রুপদী ট্র্যাজেডীর অংশ পরম্পরা মিল্টন বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসরণ করেছেন এবং সেই নিয়মে নাটকের অগ্রগতির ধারা এ-রকম :

১ম প্যারডস ১ম এপিসডিঅন ১ম স্ট্যাসিমন ২য় এপিসডিঅন ২য় স্ট্যাসিমন ৩য় এপিসডিঅন ৩য় স্ট্যাসিমন ৪র্থ এপিসডিঅন ৪র্থ স্ট্যাসিমন ৫ম এপিসডিঅন ৫ম স্ট্যাসিমন একসােডাস কোম্পন/বিলাপ। “সূচনা” ও “শোকগীতি”—এই দুই-এর মধ্যে এ ক্ষেত্রেও আমরা পাঁচটি দৃশ্যই পাই, একজন ব্যক্তির আগমন ও প্রস্থানের মধ্যে যে দৃশ্যের বিস্তার। “কোরাস”-এর অবস্থান দুই “দৃশ্যের” মধ্যখানে। ট্র্যাজেডীর এই গঠন, পাত্র-পাত্রীর স্বল্পতা, কাহিনীর সরলতা ও একাগ্রতা, কোরাসের ভূমিকা আদ্যোপান্ত রসের শুদ্ধতা ও গভীরতা—সব মিলিয়ে গঠনে ও প্রকৃতিতে “সামসন” ধ্রুপদী আদর্শের অনুসারী। দর্শক ও পাঠকের মনে ট্র্যাজিক অভিজ্ঞতার যে বর্ণনা আরিস্তোতল দিয়েছেন প্রায় অব্যর্থ সূত্রের আকারে, তারই প্রতিধ্বনি শােনা যাবে, নাটকের শেষে, কোরাসের মুখে:

… এক নব-সম্পদের মতো
মহা ঘটনার অভিজ্ঞতা, শান্তি আর সান্ত্বনার
স্পর্শ শুধু থাকে মনে, উদ্বেগ অশান্তি অপগত।

স্যামসন অ্যাগনিসটিজের সংলাপ অংশ ইংরজি নাটকের প্রচলিত ছন্দ, পাঁচ মাত্রার আয়াম্বিক ছন্দে লেখা। এর মধ্যে ঈষৎ অনিয়মিত পংক্তির যথেচ্ছা ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অনুবাদেরও আঠারো মাত্রার অমিত্রাক্ষর ছন্দের মধ্যে অনুরূপ স্বাধীনতা নেওয়া হয়েছে। ষোল বা বিশ মাত্রার পংক্তির ব্যবহার হয়েছে, যা ইচ্ছাকৃত। কোরাসে মিল্টন গানের জন্য লিরিক রচনা করেন নি, আবৃত্তিযোগ্য কবিতার স্তবকগুচ্ছে রচনা করেছেন অসম পংক্তিতে, এবং অন্ত্যমিলকে সম্মান দেখিয়ে। 

নাটকীয় সংলাপে এক নিরলংকার দৃঢ় ও ঘনবদ্ধ কাব্যভাষা ব্যবহার করেছেন মিল্টন। এই ভাষার চরিত্রগত মিল সময়ের দিক দিয়ে নিকটবর্তী প্যারাডাইস রিগেইনড–এর সঙ্গে, কিছুটা দূরবর্তী প্যারাডাইস লস্ট-এর সঙ্গে নয়। প্যারাডাইস রিগেইনড-এর শব্দরীতির মধ্যে যে ঋজুতা ও শুষ্কতা, “স্যামসন”-এ সেটা আরও এক ধাপ এগিয়ে এসে মাঝে মাঝে প্রায় কঠোরতায় ঠেকেছে, যেন পরিস্থিতির নির্মমতার সঙ্গে এভাবেই বোঝাপড়া করেছেন কবি। এটা ইচ্ছাকৃত, বোঝা যায়, যখন এই রৌদ্রদগ্ধ কঠোরতার মধ্যে হঠাৎ শীতল বাতাসের মতো খেলে যায় ললিত পদ-বিন্যাস, যখন কোরাসের শীতল কাব্যবন্ধে বাজে অন্য এক নরম সুর, যখন মমতায় ও সহানুভূতিতে আর্দ্র হয়ে ওঠে তাদের কণ্ঠস্বর।

শব্দ-ব্যবহারে, বিশেষত খ্রিষ্টীয় অনুষঙ্গমূলক শব্দের অনুবাদে যে-সমস্যা, তার কোনো সম্পূর্ণ সন্তোষজনক সমাধান বোধ হয় নেই। ইংরেজি গড (God or god) এনজেল (angel) আনসার্কামসাইজড নাজারাইট গ্রেস (grace)-এসব শব্দের প্রতিশব্দ পাওয়া দুষ্কর। এ-ধরনের সমস্যা ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন সংস্কৃতির যে-কোনো রচনার অনুবাদেই কম বেশি থাকে। তবু তো ইহুদি ও খ্রিষ্টীয় ধ্যানধারণার একটা বড় অংশ ইসলামেও চলে আসায়, এঞ্জেলকে আমরা ফেরেস্তা বলে চিনতে পারি, গ্রেস-এর সঙ্গে রহমতের মিল খুঁজে পাই। ফলে এই নাটক বাংলা ভাষায় অনূদিত হওয়া এক অমূল্য সংযোজন, যেই কাজে সফল হয়েছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ৩ অক্টোবর ২০২০, “স্যামসন অ্যাগনিসটিজ জন মিল্টনের লেখা একটি ট্রাজেডি নাটক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/literature/samson-agonistes/
২. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, স্যামসন অ্যাগনিসটিজ, বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, মার্চ ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ৯-১৩।

রচনাকাল: ৩ অক্টোবর ২০২০, নেত্রকোনা বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!