ধাঁধা বা ধাঁধাঁ হচ্ছে একমাত্র ভাব বা বিষয়কে রূপকের দ্বারা প্রশ্নের আকারে প্রকাশ

ধাঁধা বা ধাঁধাঁ (ইংরেজি: Riddle) হচ্ছে লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা যাতে একটি মাত্র ভাব বা বিষয়কে রূপকের দ্বারা প্রশ্নের আকারে প্রকাশ করা হয়। ধাঁধা হলো প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের ভাণ্ডার, যার মূল উপকরণ দৈনন্দিন জীবনের ও সমাজের নানান উপাদান। ধাঁধাঁর মাধ্যমে মূল বক্তব্যকে প্রচ্ছন্ন ভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়। এই বিশেষ প্রকাশভঙ্গিটি হেঁয়ালির মধ্যেও দেখা যায়।

ধাঁধাঁর মধ্যে একটা সাদাসিধে ভঙ্গি থাকে এবং অপ্রত্যাশিত বা অভাবিত কোনো কিছুর তুলনা বা উপমা এর মধ্যে রূপকাশ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এই সাদৃশ্য ও আপাত-বৈপরীত্যের দ্বান্দ্বিক পরিণতিতে সুপ্রাচীন কাল থেকে ধাঁধা অনগ্রসর এবং অগ্রসর—সমস্ত সমাজেই গড়ে উঠেছে। গ্রামীণ লোকসমাজেও এর প্রচলন থাকলেও নাগরিক সমাজে এর ব্যবহার ক্রমক্ষীয়মাণ। গোষ্ঠীর নিজস্ব কিছু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, কল্পিত অলৌকিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস, বুদ্ধ্যঙ্ক বা I. Q. নির্ণয়ের প্রচেষ্টা, সামাজিক আনন্দ ও ধর্মাচার, লোকাচার ইত্যাদি নানান কারণে ধাঁধার ব্যবহার হয়।[১]

ইংরেজিতে ধাঁধাকে বলা হয় ‘Riddle’। সংস্কৃত ‘দ্বন্দ্ব’ থেকে ‘ধাঁধা’ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। বিভিন্ন প্রদেশে ধাঁধা ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রচলিত; যেমন—বিহারে—‘বাহা’; গুজরাটে উখানো’; ভূপালে—ভুলভুলাইয়া; চট্টগ্রামে— ‘দস্তান’; ময়মনসিংহ-এ ‘ঠল্পক’; সিলেটে— ‘দিঠান’; কুমিল্লায়—‘শিলুক’ ইত্যাদি।

রূপকের দ্বারা যখন একটি মাত্র ভাব বা বিষয়কে প্রশ্নের আকারে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে এককথায় ধাঁধা বলা যেতে পারে। ধাঁধাঁর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, যথা—১. ধাঁধা রূপকাশ্রিত। ২. ধাঁধাঁ প্রশ্ন-উত্তর মূলক; এক পক্ষ প্রশ্ন করে অপরপক্ষ উত্তর দেয়। ৩. ধাঁধা বুদ্ধিদীপ্ত। ৪. ধাঁধা মূলত ঐতিহ্যমূলক (traditional); সেজন্য ধাঁধার একটি সর্বজনবিদিত ও সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর থাকে। ৫. ধাঁধার মধ্যে স্রষ্টার সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। ৬. ধাঁধাঁ রসের সামগ্রী। ধাঁধাঁ বেশ আনন্দদায়ক। ৭. ধাঁধার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সংক্ষিপ্ততা। ৮. ধাঁধার মধ্যে লোকশিক্ষামূলক ভাবনা বর্তমান। ৯. ধাঁধা যৌথভাবে উপভোগ্য। ১০. ধাঁধা লোকসাহিত্যের স্তর অতিক্রম করে শিষ্ট সাহিত্যের মধ্যেও স্থান করে নিয়েছে।

ধাঁধা কত প্রকার

বিষয়বস্তু অনুসারে ধাঁধাকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে, যথা— 

এক. নরনারী ও দেবদেবী বিষয়ক 
দুই. প্রকৃতি বিষয়ক
তিন. গার্হস্থ্যজীবন বিষয়ক 
চার. পশুপাখি ও কীটপতঙ্গ বিষয়ক 
পাঁচ. বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক 
ছয়. কাহিনিমূলক 
সাত. গাণিতিক সংখ্যামূলক
আট. বিবিধ বিষয়ক 

এক. নরনারী সম্পর্কিত একটি ধাঁধায় মানুষের শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্যের অবস্থাকে প্রশ্নের। আকারে তুলে ধরা হয়েছে—

সকালে কে চারি পায়ে হাঁটে?
দ্বিপ্রহরে দুই পায়ে হাঁটে?
সন্ধ্যায় তিন পায়ে হাঁটে?

মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে নিয়ে একটি ধাঁধা রচিত হয়েছে

‘সোনার বরণ দেহ তার তরুণ সন্ন্যাসী,
লোকজন সঙ্গে নিয়ে হইল উদাসী।’ 

দুই. প্রকৃতি নিয়ে অসংখ্য ধাঁধাঁ রচিত হয়েছে, যেমন—ডাব বা নারিকেল নিয়ে রচিত একটি ধাঁধা হলো—মাঠে ঘাটে জল নেই, গাছের মাথায় জল’ কিংবা পাকালঙ্কা নিয়ে রচিত ধাঁধা হলো—একটুখানি গাছে/রাঙা বৌটি নাচে। 

তিন. গার্হস্থ্য বিষয়ক অসংখ্য ধাঁধাঁ রচিত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে মশারি অন্যতম। মশারি নিয়ে রচিত একটি ধাঁধা হলো—‘ঘরের মধ্যে ঘর,/তার মধ্যে পরমেশ্বর।’ 

চার. পশুপাখি কীটপতঙ্গ সংক্রান্ত অসংখ্য ধাঁধাঁ প্রচলিত। সারমেয় ধাঁধার বিষয় হয়ে উঠেছে। ধাঁধাটি হলো—ছাই ভিন্ন শোয় না,/লাথি ভিন্ন ওঠে না। ধাঁধাটি মানুষের স্বভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হয়। কিংবা জোনাকি নিয়ে রচিত একটি ধাঁধা হলো—‘জঙ্গল দিয়া উড়িয়া চলে/পিছ দিয়া আগুন জ্বলে।

পাঁচ. বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নানারকম ধাঁধাঁ রচিত হয়েছে। বাউল গানে ব্যবহৃত হয় একতারা। একটি ধাঁধায় একতারা সম্পর্কে বলা হয়েছে— চার অক্ষরে হয় এক সাধারণ বাদ্যযন্ত্র/ প্রথম দুই অক্ষরে সংখ্যা, শেষ দুয়ে নক্ষত্র। 

ছয়. একটি কাহিনি বা আখ্যানমূলক ধাঁধা হলো—

মা একটিপে মন বাছছে
বাবা আকাশের তারা বোজাচ্ছে। 
দিদি এককে দুই করছে। 
আমি মরা খেয়ে এসেছি।
গিয়ে জ্যান্ত খাবো।

ধাঁধাটির অর্থ হলো—‘ছেলেটির মা ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা একটি ভাত টিপে দেখছে, তার বাবা কোনো জিনিসের ছিদ্র সারাচ্ছে, দিদি কলাই ভাঙছে, ছেলেটি নিজে পান্তাভাত খেয়ে এসেছে, বাড়ি গিয়ে গরমভাত খাবে। এরকম অসংখ্য কাহিনি বা আখ্যানমূলক ধাঁধাঁ লোকায়ত সমাজে প্রচলিত।

সাত. গাণিতিক সংখ্যামূলক ধাঁধায় অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের নানা জটিল হিসাব করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। যেমন—একটি ধাঁধায় বলা হয়েছে—

‘টাকায় কিনেছি খাসি 
লোক জুটেছে বারশ আশি। 
সবাই বলে খাব খাব।
কার কাছে কত নেব?’ 

ধাঁধাটির উত্তর এক কড়া, কারণ ১২৮০ কড়ায় এক টাকা।

লোকায়ত সমাজে প্রচলিত অসংখ্য ধাঁধাকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে আলোকপাত করা হলো। যে সমস্ত ধাঁধাঁ উপরি-উক্ত শ্রেণিবিভাগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়, সেই সমস্ত ধাঁধাকে বিবিধ বিষয়ক’ ধাঁধার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

তথ্যসূত্র

১. চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৮০-৫৮১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!