অলংকার বা অলঙ্কার বা অলংকারশাস্ত্র (ইংরেজি: Rhetoric) হচ্ছে লিখিত সাহিত্য, রচনা বা ভাষণে বক্তব্য বলিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে বাগ্মিতা বা বাক্যাড়ম্বরের ব্যবহার। আধুনিক কালে ইংরেজি প্রতিশব্দ রেটোরিক অনেক সময় নেতিবাচক অর্থে, শূন্য অর্থহীন আড়ম্বর বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
কবিতার প্রকরণ বা শিল্পরূপ অনুধাবনের জন্য অলঙ্কার, চিত্রকলা বা Image, ছন্দ এবং ছন্দস্পন্দ সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ [অল-কৃ (করা) + ঘঞণ] আভরণ বা অণ। অর্থাৎ যে-সকল উপাদান কবিতার অবয়বকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে সাধারণ অর্থে তাই অলঙ্কার। কিন্তু কবিতা এমন একটি শিল্পমাধ্যম, যেখানে অলংকার বহিরঙ্গ উপাদান হিসেবে গৃহীত হয়নি, অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। অনুভূতি বা চেতনা প্রকাশের প্রয়োজনে কবি প্রথমে অনিবার্য কিছু শব্দ নির্বাচন করেন। অতঃপর চেতনা ও শব্দের এমন একটি মেলবন্ধন ঘটান যেখানে একটি থেকে আরেকটিকে বিছিন্ন করলে কবিতারই অপমৃত্যু হয়।
প্রাচীন গ্রীসে অলংকার বিষয়ক শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। ঐ সময়ে গ্রীক মনীষীরা কাব্যতত্ত্বেরও উদ্ভাবন করেন। এ-দুয়ের মধ্যে তারা সুস্পষ্ট পার্থক্যও নির্ধারণ করেছিলেন। অলঙ্কার বা Rhetoric-এর লক্ষ্য ছিলো কাব্যের বাগ্মিতা ও রচনার গুণাগুণ নির্দেশ করা আর কাব্যতত্ত্ব বা Poetics-এর বিচার্য ছিলো বিভিন্ন সাহিত্য-আঙ্গিকের (যেমন ট্র্যাজেডি, কমেডি, মহাকাব্য প্রভৃতি ও রচনারীতির বিশ্লেষণ। প্রাচীন ভারতেও অলঙ্কারশাস্ত্র এবং কাব্যতত্ত্বের ব্যাপক চর্চা হয়েছে এবং এক পর্যায়ে অলঙ্কার কাব্যতত্ত্বকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। অলঙ্কার সেখানে কবিতার শরীরী প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে। পরবর্তী-সময়ে মানুষের জ্ঞানের বিস্তৃতি, অনুভূতির তীক্ষ্ণতা এর মনোজাগতিক সূক্ষ্মতা অলঙ্কারকে কবিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেছে।
কাব্যপাঠকালে কাব্যের দুটি দিক আমাদেরকে প্রথম আকর্ষণ করে: এক. কাব্যে ব্যবহৃত পদের শব্দ বা ধ্বনি; দুই. তার অর্থ বা Meaning. শব্দ বা ধ্বনি গ্রহণ করি শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে আর অর্থ উপলব্ধি করি মন, অনুভূতি বা বোধ দিয়ে। ফলে, কাব্যের দুটি রূপ প্রকাশ পায়। প্রথমটি বর্ণময় অবয়ব (Concrete) আর অন্যটি অর্থময় চিত্ররূপ (Abstract)। এই রূপগত বিভাজনের ফলেই অলঙ্কার দুই রকমের:
এক. শব্দালঙ্কার,
দুই. অর্থালঙ্কার
শব্দালঙ্কারের নিয়ন্তা হলো শব্দ বা ধ্বনি (Sound)। এই ধ্বনি কখনো পদধ্বনি, কখনো বর্ণধ্বনি আবার কখনো বাক্যধ্বনি। শব্দালঙ্কার প্রধানত কবিতার শরীরী ভূষণকে রূপ দেয়। এই অলঙ্কারের মধ্যে অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি প্রভৃতি প্রধান। অর্থালঙ্কারে শব্দ বা ধ্বনির পরিবর্তে অর্থেরই প্রাধান্য পায়। কবিতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, গভীরতা ও ব্যঞ্জনা অর্থালঙ্কারেই নিহিত। অর্থালঙ্কারের পরিধি বাপক। এগুলোর মধ্যে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, সমাসক্তি, অন্যাসক্তি, বিরোধাভাষ, ব্যাজস্তুতি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
যে অলঙ্কারকে আমরা কবিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেছি, তা আসলে অর্থালঙ্কারের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই ঘটেছে। কবিতার অন্তর্হিত চেতনাকে ব্যঞ্জনাময় ও চিরন্তনতা দানের প্রয়োজনে অর্থালঙ্কারের ভূমিকাই মুখ্য। চিত্রকল্প বা Image কবিতার জন্য অলঙ্কারেরও অধিক। কবির কল্পলোক উপমান এবং উপমেয়ের নৈর্বক্তিকতায় যে মোহনীয় শব্দচিত্র সৃষ্টি করে, তারই তুঙ্গতম পর্যায়ে চিত্রকল্পের জন্ম । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলাকা’ কবিতার একটি অংশ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে:
মনে হল, এ পাখার বাণী
দিল আনি
শুধু পলকের তরে
পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
বেগের আবেগ।
পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;
উদ্ধৃতাংশে শব্দ, ধ্বনি এবং চিত্র কল্পনার অন্তর্ময় প্রয়োগে যে বিমূর্ত (Abstract) ব্যঞ্জনা লাভ করেছে, তার ব্যাখ্যা অলঙ্কারের সূত্র দিতে পারলেও এর অর্থময়তা অনুভূতির গভীরতা দিয়েই অনুধাবন করতে হবে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।