সাহিত্য বা কাব্যবিচারে রস বা কাব্যরস বা রসবাদের (সংস্কৃত ভাষা: रस) মূল্য অপরিসীম এবং এটি মূলত সংস্কৃত সাহিত্যের বিষয়। এটি দ্বারা প্রধানত সাহিত্যের বিষয়বস্তুর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই ধারণা কাব্যের শরীর বা রূপ অপেক্ষা রসকেই কাব্যের আত্মা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বুৎপত্তিগত দিক থেকে রস শব্দের অর্থ হলো আস্বাদন। কাব্যের বিষয়বস্তু অনুসারে পাঠকের মনে বিচিত্র ধরনের অনুভূতির জন্ম হয়। দৈনন্দিন জীবনে বস্তুজগৎ থেকে আমরা যে রস আস্বাদন করি — তা বাহ্য ইন্দ্রিয়ের রসনার ফল। সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে হবে অন্তরেন্দ্রিয় মন দিয়ে।
রসের উপাদান চারটি
১. স্থায়িভাব
২. বিভাব
৩. অনুভাব
৪. সঞ্চারীভাব।
এই উপাদানগুলোর স্বরূপ ভালোভাবে বুঝলেই সাহিত্য রসের প্রকাশ বা অভিব্যক্তি অনুধাবন করা সম্ভব। মানুষের বাসনালোকে সর্বদাই অসংখ্য ভাব গূঢ়ভাবে বর্তমান। আমাদের চিত্তজগতের এই সব ভাবের গতিবিধি বিচিত্র। এই ভাবগুলো একটি আরেকটি থেকে স্বতন্ত্র। বিচারের সুবিধার জন্য অলঙ্কারশাস্ত্রবিদরা নয়টি ভাবকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এগুলোর নাম – রতি, হাস্য, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিস্ময় এবং শম। কাব্য বা সাহিত্য পাঠের ফলে বিষয়ের অনুধাবনসূত্রে একেক সময় একেক রূপ ভাবের সৃষ্টি হয়।
ভাবসমূহের রস-পরিণাম নিম্নরূপ
- রতিভাব—শৃঙ্গাররস,
- হাস্যভাব—হাস্যরস
- শোকভাব —শোকরস
- ক্রোধভাব—রৌদ্ররস
- উৎসাহভাব—বীররস
- ভয়ভাব—ভয়ানকরস
- জুগুপ্সাভাব—বীভৎসরস
- বিস্ময়ভাব—অদ্ভুতরস
- শমভাব—শান্তরস।
কেবল কাব্যপাঠের ফলে নয়, যে-কোনো সাহিত্যের বই পাঠের পরিণামে আমাদের চিত্তে একটা রসানুভূতির উদ্ভব হয়। ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় আত্মনিবেদনের যে শান্ত-স্নিগ্ধ রূপ পরিলক্ষিত হয়, তাকে শান্ত রসের কবিতা বলাই যুক্তিযুক্ত। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ কবিতায় একাধিক ভাবের মিশ্রণ আছে। কিন্তু মৌলভাব বিস্ময় এবং পরিণামে পাই অদ্ভুত রসের গভীর আস্বাদন। ‘অমর একুশে’ কবিতায় ক্রোধ এবং উৎসাহ এই দুটি ভাবের স্পন্দন আমরা অনুভব করি। কোথাও কোথাও রৌদ্ররসের প্রকাশ ঘটলেও পরিণামে পেয়ে যাই বীররস।
উপরিউক্ত স্থায়িভাবকে যে-তিনটি উপাদান কার্যে পরিণত করে, সেগুলো হলো – বিভাব, অনুভাব এবং ব্যভিচারী বা সঞ্চারীভাব।
বহির্জগতের বিষয়কে আমরা অনুভব করি বাইরের ইন্দ্রিয় দিয়ে। দুর্ঘটনা দেখলে আমরা শোকাভিভূত হই। সকালের সুন্দর সূর্যোদয়ের দৃশ্যে আনন্দিত হই, উদ্দাম মিছিলের আহ্বানে উৎসাহ বোধ করি – এগুলোরই রসপরিণাম করুণ, শান্ত কিংবা বীররস ।
বিভাব দু প্রকারের হয়
ক) আলম্বন বিভাব: মুখ্যভাবে যে বস্তুকে অবলম্বন (আলম্বন) করে রস উৎপন্ন হয়, তাই আলম্বন বিভাব।
খ) উদ্দীপন বিভাব: যে বস্তু বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা রসকে উদ্দীপিত করে অর্থাৎ রস সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে – তাই উদ্দীপন বিভাব। যেমন সুন্দর জোস্না রাত, মিছিল প্রকম্পিত নগরী, দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত জনপদ, পুত্র শোকাতুরা জননীর হাহাকার – প্রভৃতি উদ্দীপন বিভাব।
বিচিত্র ভাবের প্রকাশরূপই হলো অনুভাব। যেমন ক্রুদ্ধ হলে আমাদের অভিব্যক্তির রূপ পালটে যায়। আবার বেদনার প্রতিক্রিয়া আমাদেরকে করে অশ্রুসজল, অর্থাৎ হৃদয়ের ভাব-বিকারের বহিপ্রকাশই হলো অনুভাব। ব্যভিচারী বা সঞ্চারীভাবের স্থায়ী কোনো স্বীকৃতি বা অস্তিত্ব নেই। কিন্তু বিভাব ও অনুভাবের সংমিশ্রণে রসের সৃষ্টি করে। যেমন আবেগ, স্বপ্ন, লজ্জা, গ্লানি, বিষন্নতা প্রভৃতি সংশিষ্ট স্থায়িভাবের সম্পর্শে একটি রসপরিণামের সৃষ্টি করে। আবেগ থেকে বীররসও হতে পারে। আবার করুণ রসেরও জন্ম হতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, রসের ধারণাটি প্রাচীন। কিন্তু সাহিত্যের রূপের ধারণা পরিবর্তন হয়ে থাকে। রূপকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে রসশাস্ত্রের জন্ম। এরপর সময়ের প্রয়োজনে অনেকগুলো সাহিত্য রূপের সৃষ্টি হয়েছে। উপন্যাস, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ পাঠে আমাদের মধ্যে কোনো না কোনো রসবোধের সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রাথের ‘একরাত্রি’ গল্পে রসপরিণাম নিঃসন্দেহে করুণ, মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তরে’র রসপরিণতিও আমাদের মধ্যে করুণ রসের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিকে’র রসপরিণাম বীভৎস রসের গভীরে নিক্ষেপ করে পাঠককে। এভাবেই আমরা দেখবো, সাহিত্যের শৈলি ও রস পরম্পর অবিচ্ছিন্ন। এ-দুয়ের যথার্থ মিলনেই সাহিত্যের সার্থকতা।
বস্তুসংক্ষেপ: ভাব হলো সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। ভাবজগৎ গড়ে ওঠে মানবহৃদয়, মানবচরিত্র ও বহিঃপ্রকৃতিকে আশ্রয় করে। বাইরের এসব উপাদান শিল্পীদের মনে হৃদয়ভাব জাগ্রত করে। কিন্তু এই হৃদয়ভাবের সার্থকতা নির্ভর করে অন্যের হৃদয়ে তা সঞ্চারিত করার মাধ্যমে। অন্যের হৃদয়ে সঞ্চার করতে হলে তার রূপসৌন্দর্য ও কলাকৌশলে পরিপূর্ণতা থাকতে হয়। একাধিক সাহিত্য রূপের সৃষ্টি লক্ষণীয়। উপন্যাস, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ পাঠে আমাদের মধ্যে কোনো কোনো সাহিত্য রস ও বহুবিধ বোধের সৃষ্টি হয়। রসের ধারণাটি প্রাচীন। সাহিত্যের রূপ ও রস পরস্পর অবিছিন্ন। এ দুয়ের যথার্থ মিলনেই সাহিত্যের সার্থকতা।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।