রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রকৃতি প্রেম ও প্রকৃতিবাদ এবং বাঙলাদেশের পরিবেশ

রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রকৃতি প্রেম (ইংরেজি: Rabindranath’s love of nature in his literature) বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে প্রকৃতিবাদ তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বাংলা দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতি তুলে ধরেছেন তার সর্বেশ্বরবাদী চিন্তাধারার সাথে মিলিয়ে। যেমন, তার সোনার তরী কাব্যের কবিতাগুলির মধ্যে কবির মানবপ্রীতি, মর্ত্যপ্রীতি এক হয়ে মহত্তর এক অনুভূতিতে মুক্তি পেয়েছে।

মানুষের প্রেম যখন ব্যক্তিপ্রেমের সীমা ছাড়িয়ে দেশ ও কালের মধ্যে বিস্তৃত হয়ে যায় তখন তাকে অনেক সময় দুর্বোধ্য বলে মনে হয়। ‘বসুন্ধরা’ কবিতাটিকে এজন্যই অনেকে অবাস্তব মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে মর্ত্যধরণীর প্রতি কবিচিত্তের অনন্ত আসক্তি, জন্মান্তরের বন্ধন-অনুভব এ কবিতাটিকে এক সুগভীর তাৎপর্য দান করেছে। বসুন্ধরার প্রতি মিলনে ও বিচ্ছেদে মানুষের যে দুর্নিবার আকর্ষণ তা চিরসত্য। মর্তধুলির ঘাসে ঘাসে যে কবিচিত্তের মুক্তি, ধরণী মায়ের শ্যামলাঞ্চলে যে স্নেহের ছায়া তা কবিতাটিতে বাণীরূপ লাভ করেছে।

সোনার তরী রচনার সমকালে লিখিত ছিন্নপত্রাবলীতেও কবিমানসের এই মর্ত্যপ্রীতির মধুরিমা উচ্ছলিত ধারায় প্রবাহিত। এই সময় মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে তার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল বলে কবি নিজেই স্বীকার করেছেন।

সেই পরিচয় থেকেই মর্তমানুষ ও সামগ্রিক বসুন্ধরা কবিকে আকর্ষণ করেছে। সুগভীর প্রীতির বন্ধনে তিনি ধরণীর সঙ্গে আপন অস্তিত্বের বন্ধনকে উপলদ্ধি করেছেন। ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় জন্মান্তরের এই বন্ধনকে যেমন প্রকাশ করেছেন, ‘যেতে নাহি দিব’, ‘অক্ষমা’, ‘আকাশের চাঁদ’, ‘দরিদ্র’ ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ কবিতাবলীতেও নানারূপে নানা ভাবে এই মর্ত্যপ্রীতিকে সঞ্চারিত করেছেন। এ কবিতাগুলির ভাববস্তু এক। ‘বসুন্ধরা’ ও ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন মনে হলেও এদের অন্তর্লীন সুর একই। দুটিতেই মৌখিক প্রেম, মর্ত্যপ্রেমের অমলিন মাধুরী প্রকাশিত। লৌকিক জীবনের চরমতম সত্য— বিদায় গ্রহণ। এই বিদায় কখনো সাময়িক বিচ্ছেদ, কখনো বা মৃত্যু। ‘যেতে নাহি দিব’ এই উচ্চারণ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কিন্তু মানুষে মানুষে এই ভালোবাসার বন্ধন ও আকুল আর্তি সত্ত্বেও একদিন চলে যেতে হয়। সেই বেদনাই ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটির অবয়বে লগ্নিত।[১]

মাঠ ঘাট জল নদী চাঁদ সূর্য সবই যেন বাংলার বাঙালির; সমস্ত প্রকৃতিই ধরা দিয়েছে কবির ছিন্নপত্রে; যে পত্র ফুটিয়ে তুলেছে জন্মভূমিকে অবিস্মরণীয় মর্যাদায়, ফুটিয়ে তুলেছে এক তরুণ মনের কল্পনার রঙিন তুলিতে। যিনি জীবনের প্রথম পর্বে পূর্ববঙ্গে এসে দেখছেন বাংলাদেশের প্রকৃতি আর চিঠির প্রতিটি লাইনের প্রতিটি শব্দ-উপমা-রূপকে তা জমিয়ে রাখছেন। সেই বাংলাদেশের প্রকৃতি বদলে গেছে, হারিয়ে গেছে বহু আগেই, কিন্তু এখনো আছে ছিন্নপত্র।

রবীন্দ্রনাথের কলমে সন্ধ্যা এসেছে তার মায়াময় বহুধরনের রূপ নিয়ে। তিনি সান্ধ্য-প্রকৃতির বিবরণ দেবার সময় আশপাশের পরিবেশকে কাব্যিক ভাষায় তুলে এনেছেন। যেমন

“বহুদূরে একেবারে দিগন্তের শেষ প্রান্তে একটু গাছপালার ঘের দেওয়া ছিল, সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠল – নীলেতে লালেতে মিশে এমন আবছায়া হয়ে এল – মনে হল ঐখেনে যেন সন্ধ্যার বাড়ি, ঐখেনে গিয়ে সে আপনার রাঙা আঁচলটি শিথিলভাবে এলিয়ে দেয়, আপনার সন্ধ্যা তারাটি যত্ন করে জ্বালিয়ে তোলে, আপন নিভৃত নির্জনতার মধ্যে সিঁদুর পরে বধূর মতো কার প্রতীক্ষায় বসে থাকে এবং বসে বসে পা দুটি মেলে তারার মালা গাঁথে এবং গুন গুন করে স্বপ্ন রচনা করে;”[২]

সন্ধ্যার বিবরণ দিতে দিতেই তিনি ঢুকে যান আঁধারের ভেতর। সন্ধ্যায় গাছপালা কুটির সমস্ত একাকার হয়ে একটা ঝাপসা ছেলেবেলাকার রূপকথার জগত তৈরি করে। সেই রূপ কথার জগত পেরিয়ে সেই আঁধারেও থাকে চাঁদ। নদীর ধারে পশ্চিমে সোনালী সূর্যাস্ত আর পূবদিকে রূপের রূপার চন্দ্রোদয়।

চাঁদ এসেছে কবির কাছে প্রেমিকার মতো বা রাধার অভিসারের মতো, তারারা এসেছে জ্বালাময় স্নিগ্ধ বেদনার মতো। কবি পরাবাস্তববাদী ভাবনায় দেখছেন, উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে অথচ ‘রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের তেপান্তরের মাঠ ও সাত সমুদ্র তের নদী ম্লান জ্যোৎস্নায় ধু ধু করছে।’[৩]

সব মিলিয়ে রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রকৃতি প্রেম প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃতির বর্ণনায় এবং নিজস্ব ভাবনার অবয়বে। বর্ণনার আলোকচ্ছটায় ফুটে উঠেছে জলের শব্দ, রোদ্দুরের দিন, বালির চর, ছোট ছোট বনঝাউ গাছ, দুপুর বেলাকার নিস্তব্ধতার ঝাঁ ঝাঁ, মশার ঝাঁক, নাল বনের মধ্যে সাদা সাদা নালফুল, বড় বড় ঘাস, ভরা ভাদরে ভরা নদী, জলে শ্যাওলা ভাসছে, মাঝে মাঝে প্যাঁকের মধ্যে ধানের গাছ, পচা পচা পাটের গন্ধ, অনন্ত কোটি জ্যোতিষ্ক, বসন্তের বাতাস ইত্যাদি হাজারো রকম প্রকৃতির অবারিত বস্তু ও তাদের জীবন্ত উপস্থিতি। 

তথ্যসূত্র

১. মীনাক্ষী সিংহ, বাংলা, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রয়োদশতম পুনর্মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০২০, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২৫।
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮ জানুয়ারি ১৮৯১, ছিন্নপত্র, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে লেখা ১০ নং পত্র, রবীন্দ্রসমগ্র খণ্ড ২২, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬০৮।
৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯ অক্টোবর ১৮৯১, ছিন্নপত্র, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে লেখা ৩৫ নং পত্র, রবীন্দ্রসমগ্র খণ্ড ২২, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৩৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!